link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

ব্যাঙ্কঋণে মাতব্বর আদানিরাই বুদ্ধ-মমতাদের মডেলে ‘ত্রাতা’ #Alternative-Economic-Development-Model-for-Bengal

সেই সময়। এই সময়।
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক ভবিষ্যত সম্পর্কে এর আগে চারটি লেখা লিখেছি। এটি পঞ্চম ও শেষ পর্ব। আগের লেখাগুলো পড়তে নিচের লিংকগুলোয় ক্লিক করুন।

আগের লেখাগুলোয় বলার চেষ্টা করেছি, অবস্থাটা কী। কিন্তু আসল কথা হল, সত্যি কি ছবিটা বদলানো যায়? গেলে কী ভাবে? আমার মতে, উন্নয়নের আলোচনায়, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কার জন্য উন্নয়ন অর্থাৎ উন্নয়নের সুফল কে পাবে?
এক সময় মানুষের প্রয়োজনের চেয়ে উৎপাদন হত কম। এখন তো তা নয়। এখন মানুষের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। তাহলে কেন ক্ষুধা, দারিদ্র মিটছে না? এর কারণ লুকিয়ে আছে মুনাফা সর্বস্ব অর্থনীতির মধ্যে। যার ফলে মুনাফার পাহাড় যেমন উঁচু হচ্ছে তেমনই কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।কথায় বলে, বিপদের সময়ই আসল ছবিটা চেনা যায়। চেনা যায়, বন্ধু-শত্রু। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার চেয়ে বড় বিপদ মানব সভ্যতার সামনে আসেনি। সেই ভয়ঙ্কর সময়ে কি সবাই বিপদে পড়েছিলেন?
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সমীক্ষা সংস্থা অক্সফাম জানিয়েছে, ভারতে ১০০ কোটি ডলার (প্রায় ৭,৭৫২ কোটি টাকা) সম্পত্তির মালিকের সংখ্যা ১০২ থেকে ৩৯% বেড়ে হয়েছে ১৪২। তাদের মোট সম্পত্তি ৫৩ লক্ষ কোটি টাকা। সবচেয়ে বড়লোক মাত্র ৯৮ জনের মোট সম্পত্তি নিচের দিকে থাকা ৫৫.৫ কোটি মানুষের সম্পত্তির সমান। মাত্র ১০ বিলিওনিয়রের মোট সম্পত্তিতে ২৫ বছর ধরে দেশের বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করা যাবে। ৯৮ জন বিলিওনিয়রের সম্পত্তি কর মাত্র ১% বাড়ালে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের ৭ বছরের খরচ চলে যাবে। অন্য দিকে দেশের ৮৪% পরিবারের আয় কমেছে।


শুধু আমাদের দেশেই নয়, ছবিটা সারা দুনিয়ার। ‘অক্সফ্যাম’ জানিয়েছে, কোভিড-পর্বের প্রথম দফায় গড়ে প্রতি ৩০ ঘন্টায় এক জন করে নতুন বিলিওনেয়ার হয়েছেন। সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৫৭৩। আর প্রতি ৩৩ ঘণ্টায় ২৬ কোটিরও বেশি মানুষ নিদারুণ আর্থিক অনটনে পড়েছেন।
সভ্যতার সর্বনাশের সময়ও বিলিওনেয়ারদের পৌষ মাস। কেন মুনাফা সর্বস্ব অর্থনীতির রাস্তা না ছাড়লে সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য, এটা তারই একটি উদাহরণ। মুনাফাসর্বস্ব অর্থনীতির ধাক্কায় পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ বাড়ে। দুনিয়া ক্রমশ গরম হতে থাকে। বিশ্ব উষ্ণায়ন। মুনাফাসর্বস্ব অর্থনীতি বৈষম্য বাড়ায়। তাকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদের আগুন জ্বলে নানা জায়গায়। রোহিঙ্গা বা উইঘুর নিধন যজ্ঞ চলে বিনা বাধায়। যুদ্ধের আগুনে পুড়তে পুড়তে কোটি কোটি মানুষ জন্মভূমি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে অন্য কোনও দেশে ছোটে। সমুদ্রের তিরে পড়ে থাকে সিরিয়ার শিশু আয়লান কুর্দির মুখ থুবড়ে পড়া মৃতদেহ।
এক সময় আমাদের বোঝান হয়েছে, বাজার অর্থনীতি ছাড়া মুক্তির রাস্তা নেই। ১৯৯১ সাল থেকে আমরা সেই রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। এঁখন বলা হচ্ছে,আমরা অর্থনীতির বাঘ হয়ে উঠেছি। দুনিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ এখন ভারত। বলা হয় না, অসাম্য শিখর ছুঁয়েছে এবং বৈষম্য বেড়েই চলেছে। দুনিয়ার যে দেশগুলিতে অসাম্য সবচেয়ে বেশি ভারত তার অন্যতম। পরিস্থিতি ১৯২২ সালে দেশে আয়কর ব্যবস্থা চালুর সময়ের চেয়েও খারাপ। নিচের ছবিটা দেখুন।


সারা দুনিয়াতেই ছবিটা এরকম (ব্যতিক্রম বলতে অন্য রকম অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে চলতে চাওয়া কিছু দেশ)। সম্পদ সামান্য কিছু হাতে জমছে। কঠিন ভাষায় বললে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটছে। মুনাফার সামনে সামান্য প্রশ্ন তৈরি হলেই ছাঁটাই। মেটা (ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ), টুইটার, মাইক্রোসফট, আমাজন, হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করছে। এই মুনাফাসর্বস্ব অর্থনীতি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, লকডাউনের সময় ব্যবসা নেই বলে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার মালিক কলকাতার একটি নামী হোটেল সংস্থা তাদের HR বিভাগের কর্মীদের ছাঁটাই করে। অন্তত এক কর্মী আত্মঘাতী হন। একটি নামী বেসরকারি বিমান সংস্থা তাঁর মাঝারি স্তরের এক কর্মী বেতন পেতেন মাসে চার হাজার টাকা। যে ব্যবস্থা অমানবিক, সে কীভাবে মানবিক দুনিয়া তৈরি করবে?বিশেষত আমাদের দেশে উন্নয়নের আলোচনা করতে গেলেই এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়, পুঁজির মালিকদের তুষ্ট করা না গেলে হবে না। কিন্তু কাদের টাকায় চলছে তাঁদের ব্যবসা? 
কোভিড পরবর্তী দুনিয়ার অর্থনীতিতে ঝড় তুলে দেওয়া গৌতম আদানির কথা ধরা যাক। মার্চ, ২০২২ নগদ ও ব্যাঙ্ক মিলিয়ে আদানি গোষ্ঠীর হাতে ছিল মাত্র মোট ২৬ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। মোট ধার ২.২ ট্রিলিয়ন টাকা (১ ট্রিলিয়ন= ১ লক্ষ কোটি), গত এক বছরে বেড়েছে ৪২%। এপ্রিল-জুন, ২০২০ আদানি গোষ্ঠী ৪৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তার ৪০% অর্থাৎ ১৮,৭৭০ কোটি টাকাই ঋণ দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। অর্থাৎ আদানিরা ঋণ নিচ্ছে সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে যেখানে সাধারণ মানুষের টাকা জমা রাখা আছে (এ সম্পর্কে জানতে ক্লিক করতে পারেন এখানে অথবা এখানে)। অভিযোগ উঠছে, আদানিদের কয়লা ব্যবসাকেও সাহায্য করতে নিয়ম বদলাচ্ছে কেন্দ্র (পড়তে এখানে ক্লিক করুন)।

অপেক্ষায়

দেখা যাবে, সরকারি ব্যাঙ্কগুলো মাঝেমধ্যেই ধনকুবেরদের ঋণ মকুব করে। স্টেট ব্যাঙ্ক ২০১৪-২০২২ সময়কালে ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পত্তির মালিকদের ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে দিয়েছে, যদিও কাদের ঋণ মকুব হয়েছে সেই তালিকা প্রকাশ্যে আনছে না তারা। ব্যাঙ্কের টাকা জালিয়াতি করে নীরব মোদীরা বিদেশে পালালেও তাঁদের ঋণ মকুব করে সরকার। একই সঙ্গে রান্নার গ্যাস, পেট্রোল-ডিজেল-কেরোসিন-সারে ভর্তুকিও কমায় সরকার।
দেশের মানুষের টাকায়, সরকারের সম্পূর্ণ সাহায্য নিয়ে ব্যবসা করে মুনাফার পাহাড় বানান গৌতম আদানিরা। আর আমাদের বোঝানো হয়, ওদের বিনিয়োগ না এলে হাল ফিরবে না। ওঁদের মুনাফার পাহাড় বাড়লেও আমজনতার কী হয়? গুজরাতের দিকে চোখ রাখলেই সেটা বোঝা যাবে। এ ব্যাপারে আগের একটি লেখা পড়ে দেখতে ক্লিক করুন এখানে)। ওই মডেলকে বলা হয়, কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন মডেল। 
আজকাল আর ডানপন্থী-বামপন্থী ভাগাভাগি করা যায় না। সবাই একই অর্থনৈতিক মডেলের সমর্থক। (পড়তে পারেন এই লেখাটি বা এই লেখাটি)। বিজেপি-সিপিএম বলছে, বিনিয়োগ কোথায়? তাদের ঠাণ্ডা করতে তৃণমূল বলছে, গৌতম আদানি ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। হলদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে। খাওয়ার তেল তৈরিতে ৭৫০ কোটি টাকা ঢেলেছে। টাটারা খড়্গপুরে ৬০০ কোটি টাকা ঢালছে। সিপিএম জমানায় তো সব শেষ হয়ে গেছিল। তেড়ে উঠে সিপিএম বলছে, টাটারা সিঙ্গুরে আসছিল। সালেম আসছিল নন্দীগ্রামে। সব তো তৃণমূল শেষ করে দিয়েছে। বিজেপি মুচকি হেসে বলছে, আমরা এলে গুজরাতের মতো সুরসুর কতরে শিল্পপতিরা এখানে বিনিয়োগ করতে চলে আসবেন। কে বলবে, ওই মডেলে ক্ষুধা-দারিদ্র-বেকারি যায় না? অথচ  অর্থনৈতিক মডেলই তো আদর্শগত ফারাকের অন্যতম ভিত্তি। 


তাহলে কি উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ লাগবে না? আলবৎ লাগবে। ব্যক্তিগত-বেসরকারি-সরকারি-সমবায়, কোনও পুঁজিই অচ্ছুৎ নয়। কিন্তু বিনিয়োগ হবে রাজ্য়ের প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে। বিনিয়োগ হবে রাজ্যের সুবিধার দিকে তাকিয়ে। আমার মতে, প্রয়োজন সংসহত উন্নয়নের মডেল (যেখানে অসাম্য দূর করা, কর্মসংস্থান তৈরি, দুর্বলতর অংশে আর্থিক ক্ষমতায়ন, পরিবেশ বাঁচানো শুধু নয় তাকে আরও সুন্দর করা, মানবাধিকার ইত্যাদি)। কর্পোরেট পুঁজির বিকল্প হতে পারে ভারতের সনাতন সমবায় ব্যবস্থা। সমবায় ভারতীয় সমাজের বহু শতকের অভ্যাস। প্রাকৃতিক উপাদানের মতোই উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মানবসম্পদ, আমাদের রাজ্যে যা অত্যন্ত উন্নত। আমাদের রাজ্যে ভূমিসংস্কার ও অপারেশন বর্গার ধাক্কায় উৎপাদন বৃদ্ধি দেখিয়েছিল মানবসম্পদের খেল। দুনিয়াজুড়ে তা নিয়ে অনেক গবেষণাও হয়েছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ইন্টারনেট। 5G। 
অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিস্তারিত পরিকল্পনা তো করতে পারেন শুধু বিশেষজ্ঞরা। আমি দু পাতা অর্থনীতি পড়া লোক। কেন চালু আর্থিক মডেল নিয়ে চললে সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য, কেন তা মানুষের জীবনের সমস্যা মেটাতে পারে না, কেন বিকল্প মডেল নিয়ে ভাবা দরকার সে সম্পর্কে নিজের ভাবনার কথাই লিখছি শুধু। লিখছি, আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রগুলোকে কেন গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে আমার মতামত। সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে সমবায় প্রথার মতোই স্বনির্ভর গোষ্ঠী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ নয় কোনও ভাবেই। বরং সরকারি মালিকানা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। 


কৃষিক্ষেত্র

কৃষক কৃষকই থাকব। কৃষিজমি কৃষিজমিই থেকে যাবে। এ কোনও কাজের কথা নয়। এ হল ক্ষমতা সর্বস্ব রাজনীতির বিপজ্জনক শিক্ষা। আমাদের রাজ্যে চাষবাস লাভজনক নয়, সেটা কারও অজানা নয়। কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করে কৃষিকাজে নামতে চান না। কৃষিজমির ওপর জনসংখ্যার চাপও খুব তীব্র। সবচেয়ে বড় কথা গ্রামীণ বাংলার বেশিরভাগ পরিবারই ভূমিহীন। তার ওপর তাঁরা খেতমজুরি, জনমজুরি করেন বা কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন শহর অথবা বাইরের রাজ্যে কাজে চলে যান। এই ছবিটা কয়েক দশকের।
তাহলে কি চাষবাস তুলে দেওয়া হবে? একদমই তা নয়। তাহলে মানুষ খাবে কি? তবে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গড়তে কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমাতে হবে। সেজন্য এখন কৃষির উপর নির্ভরশীল বড় অংশের মানুষের বিকল্প পথে আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
১) কোন ফসল কতটা দরকার, কোন জমিতে কোন ফসল (চা-ধান-আলু-পাট-গম-চা-আখ-ফুল-তৈলবীজ ইত্যাদি) হবে, এলাকা-রাজ্য-দেশ-বিদেশের চাহিদার ধরণ মাথায় রেখে তৈরি হোক সেই পরিকল্পনা। আমাদের পরিবেশে অন্য কোনও ফসলের চায (যেমন ভেষজ উদ্ভিদ) সম্ভব কিনা, সম্ভব হলে কোথায় হবে? কৃষির সঙ্গে জড়িত সব অংশের মানুষের সহমতের ভিত্তিতে কাজটা করতে হবে।
২) কৃষিতে আয় বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু ছোট জোতে তা হওয়ার নয়। তাই সমবায় চাষ ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। জমির মালিকানা ব্যক্তি কৃষকের হাতে রেখেও সে কাজ করা সম্ভব। একসঙ্গে চাষ হলে আলের জন্য নষ্ট হওয়া বিরাট পরিমাণ জমিও চাষের কাজে লাগানো যাবে। 
৩) দূরের সময়ের দিকে চোখ রেখে সার ও কীটনাশক হিসেবে কোনও রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুরোটাই হবে জৈব পদ্ধতিতে চাষ। ওই পদ্ধতিতে চাষ ছাড়া রফতানির ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে জৈব সার ও কীটনাশক তৈরি ও বিক্রিতে অনেকের কর্মসংস্থানও হবে। পরিবেশ বান্ধব ফসলের জন্য এবং পরিবেশকে দীর্ঘমেয়াদে রক্ষায় মাটির নিচ থেকে জল তুলে চাষ নিষিদ্ধ করতে হবে। 
৪) উত্‍পন্ন ফসলের বিক্রিবাটার কাজও সমবায়ই দেখবে। তাতে ব্যক্তি কৃষকের দরদামের ক্ষমতাও বাড়বে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ইত্যাদি সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা উচিতও নয়, সম্ভবও নয়। বিক্রির ক্ষেত্রেও সমবায় গড়া যেতে পারে। তাতে কর্পোরেটের হাতে থাকা একচেটিয়া রিটেল ব্যবসার সঙ্গে টক্কর দেওয়া যাবে। মানবসম্পদের ম্যাজিক এক্ষেত্রেও দেখানো যেতে পারে। 
৫) প্রয়োজনীয় পুঁজি মূলত জোগাবে ব্যাঙ্ক আর সমবায় ব্যাঙ্ক। তার বাইরে কোনও ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, প্রয়োজনে কর্পোরেট বিনিয়োগও হতে পারে, কিন্তু তা হবে সমবায় মারফত। তাঁদের সামনে গলায় গামছা দিয়ে দাঁড়াতে হবে না। তবে কৃষিচক্রে কোনও ভাবেই মহাজন-ফড়ে-দালাল থাকবে না। 
৬) আমাদের রাজ্যের বিশেষ পরিস্থিতিতে মহাজন-দালাল-কর্পোরেটের মতোই বিপদ দলীয় রাজনীতি। সমবায় প্রথায় কৃষকের জীবনমানের উন্নতি ঘটলে রাজনৈতিক দলগুলো কালো-কারবার চালানোর লোক পাবে না। গ্রামীণ ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক ক্ষমতার নতুন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে সমবায়গুলো। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে বিরোধিতা আসাটাই স্বাভাবিক। (আমাদের রাজ্যে কৃষি ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা অন্য লেখায় লিখেছি। পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন)।  
৭) পুরো কৃষিপ্রক্রিয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপও কার্যত থাকবে না। নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্র তৈরি করা ও নজরদারির বাইরে সরকারের তেমন কোনও ভূমিকা থাকাটা উচিত নয়। কিছু হলেই সরকারের দিকে আঙুল তোলা বিরোধিতার রাজনীতির চরিত্র হতে পারে। কিন্তু তা স্বনির্ভরতার বিরুদ্ধে। সরকারের ওপর নির্ভরতা যেমন ব্যক্তি মানুষকে আত্মনির্ভর করায় বাধা তৈরি করে তেমনই ব্যক্তি মানুষের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও করে। পুরো কৃষিপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতেও এটা দরকার। এই কাজ করা না গেলে পেশাদারী দক্ষতায় কৃষিপ্রক্রিয়া চালানো যাবে না। সরকার এবং রাজনৈতিক দলের হাত ধরে মহাজন-ফড়ে-কর্পোরেট কৃষিপ্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়বে। 
একমাত্র এই প্রক্রিয়ায় যেমন কৃষিজমির উপর নির্ভরশীল মানুষদের অবস্থার উন্নতি করা যাবে, তেমনই মহাজন-ফড়ে-দালাল-কর্পোরেটের মোকাবিলাও  করা যাবে। এই প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বড় বড় কর্পোরেটের হাতে কৃষি ও কৃষকের আত্মসমর্পণ ঠেকানো সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়া কৃষির উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনার রাস্তা তৈরিতেও সাহায্য করবে। আবারও বলছি, কৃষকদের মনস্তত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। জমির সঙ্গে, কৃষির সঙ্গে কৃষকের মমত্ব, ভালবাসা যেমন জড়িয়ে থাকে, যেমন খাদ্য নিরাপত্তা বোধ জড়িয়ে থাকে, তেমনই জড়িয়ে থাকে তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ। তার মানে এই নয় যে কৃষক বাস্তবকে অস্বীকার করে স্রেফ আবেগের ভিত্তিতে চলতে চান, নিজের-পরিবারের ও সমাজের ভালমন্দ বুঝতে পারেন না। অনেক পণ্ডিত মানুষের চেয়েও একজন কৃষক সেটা ভালই পারেন। (কিউবার কৃষিক্ষেত্রের কিছু অভিজ্ঞতা জানতে এখানে ক্লিক করুন)।

বেঙ্গল বিজনেস সামিট

স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজ্যের অর্থনীতি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে। সে সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন আগে লিখেছি। যে ব্যাখ্যাগুলো প্রচলিত, তাতে অর্থনীতি নেই, আছে রাজনৈতিক বিদ্বেষ। সেগুলো অতি সরলীকরণ। দেশভাগের ফলে অর্থনীতির উপর বিপুল মানুষের চাপ তৈরি হলেও পঞ্জাবের মতো বাংলা কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য পায়নি। দেশভাগের ফলে বিশেষত পাট শিল্প বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে, যেমন ধাক্কা খেয়েছে প্লাস্টিকের একচেটিয়া আধিপত্যে। মাসুল সমীকরণ নীতি পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির শিল্পকে কার্যত শ্মশানে পরিণত করেছে। শিল্পে লাইসেন্সে বৈষম্যও আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মনোভাব ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মনোভাব খানিকটা দায়ি। আর দায়ি আমাদের মানসিকতা। এসম্পর্কে আমার ভাবনা আরও খানিকটা বিস্তৃতে পড়ে ক্লিক করুন এখানে ও এখানে
আমাদের রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মরত। আবার আমাদের রাজ্যে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি অত্যন্ত উন্নত মানের মেধাসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদে আমরা এগিয়ে, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুবিধাজনক জায়গায়, সে সব বিবেচনায় রেখেই পরিকল্পনা দরকার। আমাদের রাজ্যে জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। একলপ্তে বিরাট জমি পাওয়া অসম্ভব (যেমন সিঙ্গুরে টাটা ন্যানো বা নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের ক্ষেত্রে ছিল)  আমাদের রাজ্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোন কোন ক্ষেত্র সম্ভাবনাময়, সে সম্পর্কে আমার মতামত সংক্ষেপে জানাচ্ছি। 5G প্রযুক্তির সুযোগ বিশেষ ভাবে কাজে লাগানোর কথা বিবেচনায় রাখা দরকার। 



নিচে কিছু ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করছি। তবে তালিকাটি গুরুত্ব অনুযায়ী সাজানো নয়।
১) তথ্যপ্রযুক্তি২) পর্যটন (অত্যন্ত অবহেলিত কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময়)
৩) গেমিং (এখন দুনিয়ায় বিপুল আকার এই শিল্পের। অনেক ক্ষেত্রে সতর্কতা দরকার কিন্তু বন্ধ করার অসম্ভব ভাবনা নিয়ে চলাটা ঠিক হবে না। গেমিং শিল্পের আয়তন এখন হলিউডের চেয়েও বড়)
৪) বিনোদন (সিনেমা-গান-ওয়েব সিরিজ-বিজ্ঞাপন-বই ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নত মানের নানা নতুন সৃষ্টি। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বাউল-ভাওয়াইয়া ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের ধারা, ছৌ ইত্যাদি লোকশিল্পের ধারা। দক্ষিণ ভারত ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে। মনে রাখা দরকার,  দুনিয়ায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষীরা পাঁচ নম্বরে। হিন্দি ছাড়া আরও কোনও ভারতীয় ভাষার এই বিরাট বাজার নেই। দৃঢ়ভাবে মনে করি, বাংলাদেশকে ছাড়া এই কাজে সফল হওয়া অসম্ভব। এই সম্ভাবনা ব্যবহারের কথা অতীতের বোদ্ধা-সংস্কৃতি বা বর্তমান টলিউডি স্বরূপ-মোহতা মডেলে কল্পনাও করা সম্ভব নয়।)
৫) খেলা (বিশেষত ফুটবল, দাবা, কবাডি, টেবল টেনিস. তিরন্দাজি ইত্যাদি। দুনিয়ায় স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিউবায় গিয়ে দেখেছিলাম, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ বিনিময় প্রথায় চলে। কিউবার তাদের উন্নত ব্য়বস্থাকে কাজে লাগিয়ে ব্রাজিল ভেনেজুয়েলাকে খেলাধুলো ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সাহায্য করছে। বিনিময়ে ব্রাজিল দিচ্ছে বাস, ভেনেজুয়েলা দিচ্ছে জ্বালানি তেল। আমাদের এখানে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে এই বিনিময় প্রথা চলতে পারে বা যৌথ ভাবে খেলাধুলোর জন্য কাজ করা যায়। তাতে সব রাজ্যই আর্থিক ভাবে লাভবান হবে।)
৬) ডেয়ারি, পোল্ট্রি, পশুপালন (অতি অবশ্যই সমবায় ভিত্তিক), ৭) জৈব সার ও কীটনাশক
৮) কৃষিভিত্তিক শিল্প (ফুল, সবজি ইত্যাদি। আবার ধরা যাক, উত্তরবঙ্গের মাটি ও আবহাওয়া ধূপকাঠি তৈরির বাঁশের ফলনের উপযুক্ত। তবে এখনও সে রকম কোনও কাজ হয়নি। ধূপ ও ধূপকাঠি ঘরে ঘরে তৈরি হতে পারে। ফলে এই শিল্পকে ঘিরে বড়সড় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। ধূপ রফতানি করে প্রত্যেক বছর ভারতের চারশো কোটি টাকার বেশি আয় হয়। গোটা বিশ্বের ধূপ শিল্পের ১০ শতাংশই ভারতের দখলে।)
৯) স্বাস্থ্য ও শিক্ষা (রাজ্যের সাধারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বলছি না। তাতে সরকারি ক্ষেত্রই গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারতে নজর রেখে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিপুল সম্ভাবনা ব্যবহার করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসা ও যোগা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। নানা কারণে চিন-জাপান-কোরিয়ার মত দেশগুলির সঙ্গে আমাদের রাজ্যের যোগাযোগ ভাল। ওই বাজার ধরতে সনাতন ভারতীয় পদ্ধতিগুলোর কথা ভাবা যেতে পারে।)
১০) ওষুধ (বিশেষ গুরুত্ব ভেষজে) ও কেমিক্যাল
১১) বস্ত্র (তাঁত, ফ্যাশন ডিজাইনিং ইত্যাদিতে বাড়তি গুরুত্ব। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে)
১২) চামড়া১৩) পটারি, ডোকরা সহ বিভিন্ন লোক হস্তশিল্প, মিষ্টি, 
১৪) চা১৫) মাছ১৬) পাট
১৭) কচুরিপানা, বাবুই ঘাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ ব্যবহার (অন্য লেখায় কচুরিপানা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি। পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন।) 
১৮) বিড়ি (অত্যন্ত অমানবিক পরিবেশ, কম মজুরিতে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। মনে রাখবেন, রাজ্যে ৩৪ বছর গরিবের সরকার এবং ১১ বছর গরিবদরদী সরকার [মোট ৪৫ বছর] রাজত্ব করার পরও এই হাল। দেশে বিড়ি শিল্পে যুক্ত মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমাদের রাজ্যে। নানা কারণে আমাদের রাজ্যে এই শিল্প তুলনামূলক ভাবে সুবিধাজনক জায়গায় আছে। তামিলনাড়ু থেকে বেশ কিছু কোম্পানি চলেও এসেছে।)
১৯) আবাসন ও হোটেল২০) ইস্পাত২১) ইঞ্জিনিয়ারিং
২২) গাড়ি (বিশেষত ইলেকট্রিক, ব্যাটারি, সিএনজি, বায়ো ডিজেল চালিত)
২৩) অপ্রচলিত শক্তি তৈরির যন্ত্রাদি, ২৪) বায়োডিজেল ২৫) অলঙ্কারশিল্প ইত্যাদি।
আরও অনেক ক্ষেত্রের কথা অনেকের মাথায় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষেত্র নির্বাচনে আমার ভাবনাতেও অনেক অবাস্তবতা থাকতে পারে। আমার মোদ্দা কথা, সত্যিকারের উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে হলে মনোভাব বদলাতেই হবে। চাকরির নিশ্চিন্তি ছেড়ে ব্যবসায় নামা। কর্পোরেট পুঁজি নির্ভর ভাবনা ছেড়ে সমবায়-মানবসম্পদ-নিজস্ব সম্পদের ভরসায় যুদ্ধে নামা। মুনাফার পাহাড়া গড়া উন্নয়ন নয়, চাই সুসংহত পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন।

আচার্য স্যর প্রফুল্লচন্দ্র রায়

প্রফুল্লচন্দ্র রায় কাজ করতেন দেশজ পদ্ধতিতে, দেশজ উপাদান ব্যবহার করে। প্রাচীন ভারতে রসায়ন-ভাবনা কতটা আধুনিক ছিল সেটা বোঝাতে লিখেছিলেন ‘A history of Hindu chemistry’। আমরা পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকেছি। প্রফুল্লচন্দ্ররা ব্রাত্য হয়েছেন। দুর্বল হয়েছে বেঙ্গল কেমিক্যালস। সনাতন ভারতের ঝাণ্ডা ওড়ানো কেন্দ্রের সরকার এখন সেই প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যের রাজনীতির, আমাদের রাজ্যের মানুষের তাপউত্তাপ নেই। আমরা ব্যস্ত ‘চোর ধরো, জেল ভরো করতে’। ভোটের অঙ্কেই আমাদের যাবতীয় আগ্রহ। এক দল পাল্টে আরেক দলেই আমরা খুশি। কিন্তু দরকার তো এক উন্নয়ন ভাবনা পাল্টে আরেক উন্নয়ন ভাবনা। কথায় বলে, মানুষ যেমন হয় সে তেমনই শাসক পায়। এই সহজ সত্য উপলব্ধি করতে না পারলে আক্ষেপের ভুলভুলাইয়া থেকে বেরনোর কোনও রাস্তা নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
Saswata Chatterjee বলেছেন…
অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা
পড়ে সমৃদ্ধ হলাম

Top Post Ad