link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

গাছ কাটা হলে শোকসভা হোক বিধানসভায় #Kolkata-the-Second-Most-Polluted-Metro-of-the-World

দুনিয়ার দ্বিতীয় দূষিত শহর কলকাতা

কলকাতায় এমন একটা জিনিস আছে যা সারা দুনিয়ার কোথাও নেই। বলব তার কথা। তার আগে বলি একজন মানুষের কথা। ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ (Dr Dhrubajyoti Ghosh)। 
সালটা ১৯৮১ হবে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রশ্ন জাগল, কলকাতা শহরের এতো দূষিত জল যাচ্ছে কোথায়? কী হচ্ছে তারপর? উত্তর খোঁজার ভার পড়ল তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ধ্রুবজ্যোতিবাবুর উপর। ভাগ্যিস! 
সব দেখেশুনে চমকে যান ধ্রুবজ্যোতিবাবু। মেতে ওঠেন অচেনার আনন্দে। খাল-নালা ধরে এগিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করলেন ১২,৫০০ হেক্টর বিস্তৃত জলাভূমি। সেখানেই গিয়ে পড়ে কলকাতা মহানগরীর ৭৫০ মিলিয়ন লিটার ময়লা জল। এখানে প্রকৃতিই পরিত্রাতা। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এক পয়সা খরচ ছাড়াই নোংরা জল শুদ্ধ হয়ে যায়। সেই জলে মাছ চাষ হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্য উঁচু কলকাতা কেন অন্যান্য শহরের মতো বর্ষায় বানভাসি হয় না, তারও উত্তর ওই জলাশয়।  
ধ্রুবজ্যোতিবাবুই নামকরণ করলেন পূর্ব কলকাতা জলাভূমি (East Kolkata Wetland)। কলকাতার প্রায় ৬০% কার্বন ডাই অক্সাইড গিলে নেয় ওই জলাভূমি। ধ্রুবজ্যোতিবাবু তাই একে বলতেন 'কলকাতার কিডনি'। তাঁর উদ্যোগেই এই জলাভূমি রামসার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয় (Ramsar Wetland Site)। বিশ্বের ১৬৯ বিলিয়ন হেক্টর জুড়ে ১৮২৮টি আন্তর্জাতিক জলাভূমির (রামসার সাইট) মধ্যে শুধু কলকাতার এই জলাশয়েই প্রকৃতি নিজেই দূষিত জলকে শোধন করে নেয়। সারা দুনিয়ায় এরকম নজির নেই। আর বারবার এর কৃতিত্ব ওই এলাকার মৎস্যজীবী ও কৃষকদেরই দিয়েছেন ধ্রুবজ্যোতিবাবুরা।
ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ ও তাঁর পূর্ব কলকাতা জলাভূমি
‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে ধ্রুবজ্যোতিবাবু ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘বর্জ্যজল আসলে কিছুই না, ৯৫% জল এবং ৫% জীবাণু। এই বিশাল জলাভূমিতে ওই বর্জ্যজলের জীবাণু জলজ বাস্তুতন্ত্রে শৈবাল ও মাছের খাদ্যে পরিণত হয়। ফলে স্রেফ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রেই সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় পুরো জল পরিশুদ্ধ অবস্থায় চলে আসে, বিপুল মাছের ভাণ্ডার তৈরি করে-পুরোটাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে-বিন্দুমাত্রও শোধন করাতে হয় না।’ একবার তিনি জ্যোতিবাবুকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওখানে। জলের বিশুদ্ধতা বোঝাতে আজলা ভরে জল তুলে খেয়েছিলেন।
জলাভূমিতে আছে ৫৮৫২ হেক্টর জলাজমি ও ভেড়ি , ৪৭১৮ হেক্টর ধানের জমি , ৬০২ হেক্টর সবজি ও চাষের জমি, ১৩২৬ হেক্টর বসত জমি। এখানকার ভেড়িতে রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, মৃগেল, সিলভার কার্প, চারাপোনা ইত্যাদি মিষ্টি জলের মাছ পাওয়া যায়।কলকাতা শহরের ২০% মাছের জোগান আসে ওই জলাভূমি থেকে। তার সঙ্গে টাটকা সবজি। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার সম্পদ তৈরি করে এই জলাভূমি। এর উপর নির্ভরশীল রাজবংশী, বাগদি, নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ।
ধ্রুবজ্যোতিবাবুর গুণগান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কথা বলতে চাইছি, কলকাতার দূষণ সম্পর্কে। কী হাল কলকাতার দূষণের?
কংক্রিট গিলছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি

দূষিত কলকাতা

২০২২ সালে দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত শহর দিল্লি। দু’নম্বরে কলকাতা (Kolkata, Second Polluted Metro of the World)। তালিকাটা অতি সূক্ষ্ম দূষিত কণা PM2.5 অনুযায়ী।  PM2.5 হচ্ছে বাতাসে ভাসমান আড়াই মাইক্রন বা তার নিচে চওড়া কঠিন বা জলীয় অতি সূক্ষ্ম কণা (১ ইঞ্চি=২৫,০০০ মাইক্রন)। মোটামুটি ভাবে একটা চুলের ত্রিশ ভাগের এক ভাগ চওড়া। এইসব কণা খালি চোখে দেখা যায় না, দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। শ্বাস নেওয়ার সময় এই সব বিপজ্জনক কণা ফুসফুসে চলে যায়। তার প্রভাব পড়ে সারা শরীরে।
সুইজারল্যান্ডের আইকিউ এয়ার (IQ Air) সংস্থার হিসেবে দুনিয়ার শহরগুলোর বায়ু দূষণে প্রথম পাঁচটি জায়গায় ঘোরাঘুরি করে দিল্লি, ঢাকা, কলকাতা, লাহোর এবং করাচি।
কলকাতায় PM2.5 দূষণের মাত্রা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নির্ধারিত মাত্রার ১৭ গুণ। ২০১৯ সালে এই দূষণে কলকাতায় প্রতি লাখে মৃত্যু হয়েছে ৯৯ জনের, সারা দুনিয়ার শহরগুলোর মধ্যে অষ্টম। (সূত্র: আমেরিকার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংগঠন হেলথ এফেকটস ইন্সটিটিউট (Health Effects Institute, HEI)-এর State of Global Air report-SOGA)।
২০১০-১৯ সময়কালে দূষণের ধাক্কায় কলকাতায় অকাল মৃত্যু হয়েছে ২ লক্ষের বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ ১০৩ শহরের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যায় কলকাতা পাঁচ নম্বরে। জাকার্তা, দিল্লি, সাংহাই ও বেজিং-এর পর। (সূত্র: HEI-এর Air Quality and Health in Cities রিপোর্ট)।
‘C40 Cities’ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, কয়লা চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি কলকাতায় (সারা দুনিয়ার ৯৭ মেট্রো শহরের হিসেব)। দেশে মোট যা তাপবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তার ২০% কলকাতার ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে। 
কলকাতা

জলের নীচে কলকাতা

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাবে বঙ্গোপসাগরে একের পর এক সাইক্লোন হচ্ছে। এরকম তো ছিল না।
দেখা যাবে, এক দিনে এক মাসের বৃষ্টি হচ্ছে। এরকমন বৃষ্টি হলে নিকাশী ব্যবস্থা যতই আধুনিক হোক, জল জমা ঠেকানো যাবে না।দেখা যাবে, অস্বাভাবিক শুকনো গরম পড়ছে। তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ বাড়ছে।
দেখা যাবে, গঙ্গার জলস্তর বাড়ছে। কলকাতাতেও গঙ্গার পারে ম্যানগ্রোভ বাড়ছে। মানে গঙ্গার জলে লবন বাড়ছে।
এসব বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global Warming) প্রভাব।
পৃথিবী ক্রমশ গরম হচ্ছে। বরফ গলছে। সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে।
Climate Central নামে সংস্থা রাষ্ট্রসংঘের Intergovernmental Panel on Climate Change's (IPCC) এবং NASA-র তথ্য বিশ্লেষন করে মানচিত্র তৈরি করেছে। তাদের পূর্বাভাস, ২০৩০ সালের মধ্যে কলকাতার খিদিরপুর, ধর্মতলা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলের নীচে চলে যেতে পারে। কলকাতা ছাড়া দুনিয়ার বড় শহরগুলোর মধ্যে আমস্টারডাম, বসরা, হো চি মিন সিটি, ভেনিস, নিউ অরলিন্সের অবস্থাও একই হবে। ক্রমশ জলের নিচে চলে যাচ্ছে সুন্দরবন। ঘোড়ামারা ও মৌসুনি দ্বীপ জলে তলিয়ে গেছে। এখন মেরু প্রদেশের বরফ গলার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। ফলে জলের নীচে বেশি বেশি করে এলাকা তলিয়ে যাওয়ার গতিও বাড়বে।
এই ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে কিছু লেখা, মানচিত্র ও ভিডিও-র লিংক দিচ্ছি। উৎসাহীরা পড়তে ও দেখতে পারেন।







কলকাতার মাটির নীচে

সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতায় প্রতিবছর গড়ে ১১ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার জলস্তর নামছে।
এখন কলকাতা পুরসভার ১৪৪ ওয়ার্ডে প্রায় ৩৫০ ডিপ টিউবওয়েল আছে। শ্যালো প্রায় ১২ হাজার। রোজ ৪০-৪৫ কোটি লিটার জল তোলা হয় কলকাতার মাটির নীচ থেকে। এটা সরকারি হিসেব। বাস্তবে মাটির নীচ থেকে জল তোলা হয় আরও অনেক বেশি।
ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমলে আর্সেনিকের বিপদ বাড়ে। রাজ্যের ১০৭ ব্লক আর্সেনিক কবলিত। কলকাতার ৭৭ ওয়ার্ড আর্সেনিক কবলিত। ৩৭ ওয়ার্ডে আর্সেনিকের মাত্রা ০.৫ মিলিগ্রামের বেশি। এই সব ওয়ার্ডের বেশির ভাগই দক্ষিণ কলকাতায়।
মাটির নীচের জলস্তর কমা মানে জলসংকটের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া। মাটির নিচের জলস্তর কম মানে ধসের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া। কলকাতায় ইদানিং ধস বাড়ছে।
World Wildlife Fund (WWF)-এর রিপোর্ট বলছে, জলসংকটের বিপদের মুখে দেশের ৫ শহর: চেন্নাই, হায়দরাবাদ, কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বই। তাদের পূর্বাভাস, ২০৫০ সালের মধ্যে তীব্র জল কষ্টে ভুগবে পৃথিবীর ১০০ শহর। তার অন্যতম কলকাতা।
জলসংকট মানে কী, সেটা তো ২০১৯ সালে চেন্নাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
মাটির নিচের জলস্তর বাড়াতে ভূপৃষ্ঠ থেকে জল নিচে পাঠাতে হবে। একে বলে রিচার্জিং। বৃষ্টির জল ছাড়া আর কী উৎস আছে? বৃষ্টির জল ধরে রাখতে হলে পুকুর, ডোবা ইত্যাদি জলাশয় বাড়াতে হবে। এ নিয়ে প্রশাসনের তরফে অনেক কথা বলতে শোনা যায় আর তারপর দেখা যায় নতুন নতুন জলা বা ডোবা ভরাট করে বাড়ি বানাচ্ছে প্রোমোটারের দল। রাজনৈতিক নেতা-সরকারি কর্তাদের হাতযশ ছাড়া সেটা যে হওয়া সম্ভব নয়, তা বুঝতে বিশেষ বুদ্ধি লাগে না।  

দূষিত আলোর কলকাতা

সরকার ছুটছে আলোর পিছনে৷ যেন কলকাতাকে আলো ঝলমলে করে দেওয়া না গেলে আর উন্নয়ন কী হল! রাস্তাঘাট তো আছেই, তার সঙ্গে অফিস ভবন, সেতু, ফ্লাইওভার, আবাসিক বাড়ি...সর্বত্র আলোর বন্যা৷ কে এদের বোঝাবে দিনের আলোর মতো রাতের অন্ধকারও জীবনের পক্ষে জরুরি। রাতকে দিন বানানো কাজের কথা নয়। এর ফলে তৈরি হয় আলোর দূষণ।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত আলো মানুষের মাথাব্যথা, চর্মরোগ, শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদের কারণ হতে পারে৷ রাতের ঘুম ব্যাহত হওয়ায় মানসিক উদ্বেগ বাড়তে পরে, বাড়তে পারে যৌন অক্ষমতা৷ দৃষ্টি ক্ষমতাও কমে যেতে পারে৷
বাস্তুতন্ত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে রাতের অতি আলো। নিশাচর কীটপতঙ্গ রাতের আলোয় ভয় পেয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগমিলনে বাধা তৈরি হচ্ছে। জুঁই, টগর, হাসনুহানা, কচু, ঘ্যাঁট কচুর মতো ‘অ্যারেসি’ এবং ‘লেগিউমিনোসি’ (শিম্ব গোত্রীয়) প্রজাতির উদ্ভিদরা সব থেকে বেশি সঙ্কটে পড়ছে৷ আবার ‘অ্যাফিড’ জাতীয় পতঙ্গরা রাতেই ডুমুর ফুলের খোলসের ভিতরে ডিম পাড়তে যায়৷ ফুল লুকোনো থাকে কলস আকৃতির মেকি ফলে৷ এর মধ্যে অন্য কোনও কীটপতঙ্গ ঢুকে পরাগমিলন ঘটাতে পারে না৷ তাই ডুমুর জাতীয় গাছে ফল ও বীজ উত্‍পাদনে এ সব নিশাচর কীটপতঙ্গ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়৷ আলোর দাপটে পলিনেশন বা পরাগমিলন থমকে যাচ্ছে৷ (কলকাতায় আলো দূষণ)
আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্রভাবে উদ্ভিদের স্টমাটা বা পত্ররন্ধ্রও সারারাত খোলা থাকছে৷ ফলে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় রস বাষ্প আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ তাতে জলের অভাব ঘটছে উদ্ভিদের দেহে৷ তাই গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে৷ উদ্ভিদের শারীরবৃত্তিয় কাজে দিন-রাতের নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে। তাতে ব্যাঘাত ঘটায় ফুল ফোটা, কুঁড়ি তৈরিতে বাধা হচ্ছে। 
রাতের আলোর দাপটে প্যাঁচা, বাদুড়, চামচিকের মতো নিশাচর প্রাণী কলকাতা থেকে কার্যত উধাও৷ শিয়াল, ভামেরও দেখা পাওয়া যায় না। সারা রাত আলো জ্বলে থাকায় অনেক জলজ প্রাণীর জীবনও বিপন্ন৷ ব্যাপক প্রভাব পড়ছে পাখিদের জীবনে। উল্টো দিকে রাতের আলোয় প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় ইঁদুর-ছুঁচোর সংখ্যা বাড়ছে। উল্টো দিকে, জলাশয়ের জলের নীচে থাকা ছোট ছোট প্রাণী রাতে খাবারের খোঁজে উপরে উঠে আসে। কিন্তু কাছাকাছি আলো থাকলে তারা আর বেরোয় না। তাতে ওই সব প্রাণী যেমন বিপদে পড়ছে তেমনই বিপদ হচ্ছে মাছেদেরও।
রাজনীতির দেখনদারিতে যেখানে যতগুলো খুশি আলো বসানো হচ্ছে। কারণ কলকাতাকে লন্ডন বানাতে হবে। যেখানে সোডিয়াম লাইট আছে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হল ত্রিফলা, তারপর বসানো হল এলইডি। রাজনীতির লোকেরা জানেনই না রাতের আলো নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নীতি নিয়েছে আমেরিকা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও তাই। রাতের লন্ডনের রাজপথের আলো নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ 
শব্দদূষণও ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে। দেশের যে ৫ শহরের শব্দদূষণ নিয়ে চিন্তা বেশি তার একটি কলকাতা। তবে এখানে সে সম্পর্কে লিখছি না।
দেউচা-পাঁচামি

আমাদের পরিবেশ চিন্তা

সাধারণ ভাবে আমাদের উন্নয়ন ভাবনায় পরিবেশ বিশেষ গুরুত্ব পায় না। আমজনতা পরিবেশ বলতে বুঝি, ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান’ কিংবা ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’। কিছু মানুষ পরিবেশ, পরিবেশ করে খানিক চেঁচামেচি করেন। কিন্তু তাঁদের সাইড করে ফেলাটা খুব কঠিন হয় না। তাতেও না হলে বরুণ বিশ্বাস বা তপন দত্তের মতো খতম করে দিলেই হল। 
আমার এক বন্ধু অর্থনীতিতে খুব পণ্ডিত। রাজনৈতিক কাজেও উৎসাহী। ওঁরা কয়েকজন ঠিক করলেন দেউচা পাঁচামিতে প্রস্তাবিত কয়লাখনির বিরোধিতা করবেন। কথায় কথায় বলেছিলাম, শুধু কয়েক ঘর আদিবাসী মানুষকে অন্যত্র সরানো হবে, এই কারণে আমি ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু দুনিয়ায় উষ্ণায়ন ঠেকাতে কয়লা, পেট্রোল ইত্যাদির ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত হচ্ছে। সে সময় ওই প্রকল্প হচ্ছে। আমি তাই দেউচা পাঁচামি প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কিছুদিন পর ওই বন্ধু বেশ রেগেমেগে ফোনে বলল, পুলিশ আদিবাসীদের পেটাচ্ছে। তাঁদের কী করে এখন পরিবেশের কথা বলব? সে বুঝতেই চাইল না, ওখানকার মানুষদের নয়, অন্য জায়গার মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করতে চাই পরিবেশের কথা। 
ওই বন্ধুর মতো মানুষের এই অবস্থা হলে সাধারণ চেহারাটা কেমন হবে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমরা আমজনতা বুঝতেই পারি না, পরিবেশ দূষিত হলে বিপদটা আমাদের, বিপদটা আমাদের স্বাস্থ্যের, আমাদের সন্তানদের জীবনের, আমাদের জীবিকার, আমাদের জীবনের। 
তাতে সুবিধা হয়েছে নেতা-মন্ত্রীদের। এক মন্ত্রীর নেতৃত্বে লেক টাউনে ভিআইপি রোডের ধারের নয়ানজুলি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। তাতে আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোর দাম বেড়েছে। পরিবেশ আদালত নয়ানজুলি ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু শুনতে কারও বয়েই গেছে। এই হল আমাদের সিস্টেমের বাস্তব চেহারা। 
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি

পরিবেশ ও আমরা-ওরা

উন্নয়ন যজ্ঞে কী ভাবে বলি হয়েছে পরিবেশ? পূর্ব কলকাতা জলাভূমির কথাই বলি। এক সময় নুনের ভেড়ি নামে পরিচিত ওই জলাভূমির একাংশেই বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে তৈরি হয়েছে সল্টলেক। ইস্টার্ন বাইপাস, তথ্য প্রযুক্তি নগরী সেক্টর ৫, নিউটাউন তৈরিতেও ওই জলাভূমি নষ্ট হয়েছে। ১৯৯২ সালে জ্যোতি বসুর সরকার ওই জলাভূমির ২২৭ একর জমি ভরাট করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা করে। পিছন থেকে ধ্রুবজ্যোতিবাবুর মদতে মামলা করলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান বনানী কক্কর। হাইকোর্ট রায় দিল, জলাভূমি ভরাট করা যাবে না। পরবর্তীতে বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক রায়ে ওই জলাভূমিতে জমি কেনাবেচা নিষিদ্ধ হয়। তারপরও ‘জনস্বার্থে' সুপ্রিম কোর্ট ওই জলাভূমি এলাকায় জল প্রকল্প তৈরির অনুমতি দেয়। 
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠীর সঙ্গে বারাসাত থেকে রায়চক এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির চুক্তি করেছিল। সেজন্য ওই জলাভূমি নষ্ট করতেই হত। পরে অন্য কারণে ওই পরিকল্পনা বাতিল হয়।
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সাড়ে ছয় কিমি লম্বা ফ্লাইওভার, সোলার প্রজেক্ট, ইকো পার্ক ইত্যাদি তৈরির নামে জমি গেলার মতলব হয়েছিল। হয়েছিল বলাটা ভুল হচ্ছে। ২০১৭ সালে শোভন চ্যাটার্জি পরিবেশমন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র থাকার সময় ফ্লাইওভারের পরিকল্পনা হয়। শোভনবাবুর নেতৃত্বে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি রক্ষার সরকারি কমিটি (EKWMA) ফ্লাইওভার তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। জলাভূমির স্থলভাগের অংশের জমি ‘বিচক্ষণতার সঙ্গে’ ব্যবহারের তত্ত্ব হাজির করেন শোভনবাবু।  জানিয়ে দেন, দরকারে আইনও বদলে ফেলা হবে। সব ক্ষেত্রে যুক্তি একটাই, ‘জনস্বার্থ’। হইচই হওয়ায় সরকার কিছুটা ব্যাকফুটে গেলেও পরিকল্পনা বাতিল হয়নি এখনও। একটি নতুন উড়ালপুলের যাত্রাপথের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উড়ালপুলের দুই নকশার যাত্রাপথ প্রায় এক। 
ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের তথ্যানুসন্ধান বলে, ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই জলাভূমির ৭৭% এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুনাফার লোভ, উন্নয়নের নির্বোধ কাণ্ডারীদের অজ্ঞতা কলকাতার অস্তিত্বের সামনেই বিপদ তৈরি করে দিচ্ছে। তার সঙ্গে আছে শয়তানি ষড়যন্ত্র। কলকাতার দূষিত জল বয়ে নিয়ে আসা খালগুলির নাব্যতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে। ফলে নোংরা জল ঠিকমতো জলাভূমিতে পৌঁছচ্ছে না। তাতে একদিকে নোংরা জল পরিশোধনের কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে না, অন্য দিকে ধান-সবজি ও মাছ চাষ মার খাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পলি জমতে জমতে এই অঞ্চলের জলাশয়গুলিরও নাব্যতা কমেছে। কিন্তু প্রশাসন নালা বা জলা, কোনওটিরই সংস্কার করছে না। কোনও চাষি জলাশয় সংস্কার করতে গেলে জলাভূমি আইনের নামে তাঁকে বাধা দিচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। জীবন-জীবিকার সুযোগ ক্রমশ কমতে থাকায় মৎস্যজীবী ও কৃষকদের জলাভূমি বাঁচানোর তাগিদ কমছে। তাঁরাই তো এতদিন বুক দিয়ে জলাভূমিকে আগলে রেখেছেন। জলাশয়গুলির হাতবদল ও বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে অনেক বছর আগেই। জমি ব্যবসায়ী ও প্রোমোটররাও লোভ দেখাচ্ছে। জলাভূমি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলাভূমি দখল বাড়ছে।
‘কলকাতার উন্নয়ন’ হচ্ছে ‘কলকাতার কিডনি'-কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে । এই কীর্তি দেখে কালীদাসও লজ্জা পেতেন। 
সরকারি হিসেব বলছে, জলাভূমির প্রায় ৪০% বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণ হয়েছে। অভিযোগ পেয়েও পুলিশ থাকে হাত গুটিয়ে। জলাভূমি ভরাটের ছবিটা উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে। সিএজি রিপোর্টে নির্দিষ্ট করে কয়েকটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সহ বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা অবৈধ ভাবে জলাজমি কব্জা করে কংক্রিটের নির্মাণ করেছে। বাসন্তী হাইওয়ের উপর বেআইনি প্লাস্টিক এবং রাবার কারখানারও উল্লেখ আছে রিপোর্টে। তবু ‘কলকাতা ওয়টেল্যান্ডস ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ ক্যাগ রিপোর্টে। জাতীয় পরিবেশ আদালতে রাজ্য সরকারের জমা দেওয়া অ্যাকশন টেকন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারেরই দায়ের করা ৩৫৭ অভিযোগের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মাত্র ৫ ক্ষেত্রে।

দূষণের রাজনীতি

একবার শীতের সন্ধ্যায় গাড়িতে আগ্রা থেকে দিল্লি ফিরছিলাম। জাতীয় সড়কে ওঠার কিছুক্ষণ আগে থেকে যে অভিজ্ঞতা হয় তা জীবনে ভুলতে পারব না। ভাষায় প্রকাশ করাও অসম্ভব। মনে হচ্ছে যেন অতি ঘন সাদা মেঘের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি। মেঘ নয়, আসলে ধোঁয়াশা। গাড়ির সামনে-পাশে তিন-চার ফুটের পর থেকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। থোকা থোকা-দলা দলা-খুব ঘন ধোঁয়াশা। মাঝরাস্তায় দাঁড়ানোর উপায় নেই। অন্য গাড়ি এসে ধাক্কা মেরে দিতে পারে। ডান দিকে ডিভাইডারের দাগে চোখ রেখে কোনও রকমে এগনো।
দিল্লির দূষণের কথা শুনেছিলাম। তার জেরে ট্রেন-প্লেন বাতিলের কথা শুনেছিলাম। ঠেকে শিখলাম, দূষণ কী জিনিস! 
দূষণে জেরবার দিল্লির পরিত্রাণের রাস্তা কি? যে যখন সরকার চালায় তাকে বেশ করে খিস্তি করো। তাতে যদিও দূষণ কমে না, কমার কথাও নয়। তবে ভোটের লাভ হয় কখনও কখনও।  
দিল্লি দেশের রাজধানী। কেন্দ্রীয় সরকারের হেডকোয়ার্টার।
দিল্লিতে একটা নির্বাচিত রাজ্য সরকার আছে।
দিল্লিতে তিনটে পুরসভা।
শুধু দিল্লি নয়, দূষণ ছড়িয়ে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। আশপাশের বিভিন্ন রাজ্যকে যুক্ত দূষণ ঠেকানোর বন্দোবস্ত করতে হবে। নেতৃত্ব দেওয়া দরকার কেন্দ্রীয় সরকারের। কখনও তা হয়নি। হয় না। এখন যেমন আপ সরকারের তুমুল সমালোচনায় মেতেছে বিজেপি। অথচ তাদের হাতেই কেন্দ্রীয় সরকার, তাদেরই এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। আপ সরকারের সমালোচনায় মেতেছে কংগ্রেস। অথচ এই সেদিনও দিল্লির সব কিছুই ছিল তাদের হাতে। 
পরিবেশ ও দূষণ কোনও ভাবেই রাজনৈতিক দলাদলির বিষয় নয়। যদিও সেটাই আমাদের দেশের রীতি।
সমস্যাটা শুধু দিল্লি বা কলকাতার নয়, বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, PM2.5 দূষণে দুনিয়ার প্রথম ৫ দেশের মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) দূষণে দুনিয়ার প্রথম ৫ দেশ হল চিন, আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া এবং জাপান। PM2.5 এবং CO2, দুই দূষণের তালিকার প্রথম পাঁচে আছে শুধু ভারত। সমীক্ষা বলছে, চিন দূষণ কমাতে পারছে কিন্তু ভারতে বাড়ছে।  
কী হতে পারে এই দূষণের ফল? অ্যালার্জি-কাশি-হাঁপানি-ব্রঙ্কাইটিস-সিওপিডি-সহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ, উচ্চ রক্তচাপ-ইসকেমিক হার্ট-সহ বিভিন্ন হার্টের রোগ, ক্যান্সার, স্টেজ টু ডায়াবেটিস, স্নায়ুরোগ, চোখের সমস্যা ইত্যাদি মারাত্মক রোগ বাড়ছে এই দূষণের জন্যই। গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে। শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশের ক্ষতি হতে পারে। অটিজমের আশঙ্কা বাড়ে।
সম্প্রতি দূষণে নাকাল দিল্লিতে থেকে ফিরে অনেককেই বলতে শুনেছি, যেন গ্যাস চেম্বারে ছিলাম।
প্রতিদিনের জীবনে হাতেগরম প্রভাব দেখছি। তবু উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত থেকে যায় পরিবেশ দূষণের কথা। কিন্তু উন্নয়ন যদি দূষণ বাড়ায়, দূষণ যদি রোগ বাড়ায়, তাহলে আখেড়ে সে উন্নয়নে লাভ কী?

চলো পাল্টাই

পৃথিবীর মনোভাব যদিও বদলাচ্ছে। কোটি কোটি মানুষ বুঝতে পারছেন, প্রকৃতি পরিবেশকে বাঁচাতে না পারলে, ভবিষ্যত অন্ধকার।দক্ষিণ কোরিয়ার সিওলের চিয়ং গে চিয়ং খালের উপর পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা উড়ালপুল‌ ছিল। সেই উড়ালপুল ভেঙে খালকে তার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০২১-২০৩০ রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক পালনের ডাক দিয়েছে। বেশ কিছু দেশ চমকে দেওয়ার মতো বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। তার মধ্যে পাকিস্তানও আছে। (বিস্তারিত জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।)
আমাদের দেশ? মুম্বইয়ে মেট্রো তৈরির জন্য হাজার দুয়েক ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলা হবে। একনাথ শিন্ডে সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটাই ছিল প্রথম সিদ্ধান্ত। 
বকখালিতে হেনরিস আইল্যান্ডে অনেকেই গেছেন। সরকারি উদ্যোগে বিরাট এলাকার ম্যানগ্রোভ কেটে তৈরি হয়েছে ওই পর্যটন কেন্দ্র। সঙ্গে কয়েকটা ভেড়ি।
এমনিতেই সমুদ্রের জলস্তর বাড়তে থাকায় বিপন্ন সুন্দরবন। মরার উপর খাঁড়ার ঘা, সুন্দরবনে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কেটে মাছের ভেড়ি তৈরি হয়েই যাচ্ছে। 
তবে সবই নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক কাজও হচ্ছে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় প্রকৃতি উদ্ধারের কাজ বেশ বড় চেহারায় চলছে।(জানতে এখানে ক্লিক করুন।)
বিপদের কথা হল, উন্নয়নের পরিকল্পনায় পরিবেশবিদ, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা কার্যত ব্রাত্য থাকেন। পরিকল্পনা করেন রাজনীতির লোকেরা।
কলকাতার সামনে বড় বিপদগুলো হল: 
১. বায়ুদূষণ। সারা দুনিয়ায় দ্বিতীয় দূষিততম শহর কলকাতা। 
২. মাটির তলার জল কমছে। যে কোনও সময় জলসংকট দেখা দিতে পারে।
৩. সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে। গঙ্গার জলস্তর বাড়ছে। জলের নীচে জলে যেতে পারে কলকাতা।
৪. বিপন্ন সুন্দরবন। যদিও সাইক্লোন ক্রমশ বাড়ছে। সাইক্লোনের মুখে কলকাতার নিরাপত্তা বিপন্ন। 
৫. বিপজ্জনক চেহারা নিচ্ছে আলো ও শব্দদূষণ। (প্লাস্টিক দূষণ, শক্ত বর্জ্য সংক্রান্ত আলোচনা এখানে করিনি) 
কলকাতা বরাবরই অপরিকল্পত শহর। তার উপর স্বাধীনতার পর লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর চাপ। দূষণ কমাতে মোটা এলাকার মধ্যে রাস্তার ভাগ বেশি হওয়া দরকার। কিন্তু কলকাতায় বরাবরই তা কম। 
কিছু পার্ক বা খেলার মাঠ আধুনিক সময়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন শহুরে বনাঞ্চল। কিন্তু প্রয়াত মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে মেয়ো রোড ক্রসিংয়ে তৈরি হয়েছে একমাত্র শহুরে বনাঞ্চল।
পরবর্তীতে সল্টলেক, সেক্টর-৫, পাটুলি উপনগরী, নিউটাউন-রাজারহাট, সেক্টর-৫ ইত্যাদি যা তৈরি হয়েছে, সেখানেও পর্যাপ্ত রাস্তা, শহুরে বনাঞ্চল, বিজ্ঞানসম্মত নিকাশী ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।
আমাদের পরিবেশ উদ্য়োগ মানে, ক্রংক্রিটের ফুটপাথে ঘটা করে গাছ পুঁতলেন মন্ত্রী। বাঁশের বা লোহার বেড়ায় ঘিরে দেওয়া হল। কয়েক সপ্তাহ পর যা হওয়ার তাই হল, গাছ গেল মরে। 
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়, দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে জলাশয়গুলো। কিন্তু সরকারি হিসেবেই, ২০১০ সালে কলকাতা পুরসভা এলাকায় জলাশয় ছিল প্রায় ৭২০০। ২০২১ সালে সেই সংখ্যা হয়েছে ৩৭২০। কিন্তু ‘এনভায়রমেন্ট রিপোর্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ২০২১’-এর প্রথম খণ্ডের ২১৬ নম্বর পৃ্ষ্ঠায় রাজ্য সরকার জেলাগুলিতে পুকুর, জলাভূমি, জলাধারের তথ্য় দিয়েছে। সেখানে রয়েছে কলকাতার নামের পাশে লেখা, ‘নো ডেটা।’
পূর্ব কলকাতা জলাভূমির অংশ বা তার আশপাশে থাকা ৭ নম্বর বরোর অধীনস্থ ট্যাংরা, তপসিয়া, তিলজলায় কলকাতার মধ্যে জলাশয় ভরাটের সংখ্যা সব থেকে বেশি। পুরসভার রিপোর্ট বলছে, গত কয়েক বছরে ওই সব এলাকায় ২৫-৩০% জলাশয় কমে গিয়েছে। 
যাদবপুর, বেহালা, জোকা, পর্ণশ্রী, টালিগঞ্জ, কুঁদঘাট, বাঁশদ্রোণী এলাকায় একের পর এক জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কুঁদঘাটে জলাশয়ের অনেকটা অংশ দখল করে তৈরি হয়েছে তৃণমূলের পার্টি অফিস। 
জলাশয়গুলোকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি বেকার ছেলেমেয়েদের আয়ের উৎস হিসেবেও গড়ে তোলা যায়। তাতে জলাশয়গুলো বাঁচানোর কাজও সহজ হতে পারে। 
পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। ২০২৬ সালের মধ্যে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে সম্পূর্ণ জবরদখলমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে রাজ্য সরকার। খরচ ধরা হয়েছে ১১১ কোটি টাকা। কেন্দ্রের কাছে অর্ধেক টাকা চেয়েছে রাজ্য। কিন্তু এখনও কোনও উত্তর নেই। 
আর দরকার       
শহরের সমস্ত নিকাশী খালগুলো দ্রুত সংস্কার করা দরকার। 
রাতের আলো নিয়ন্ত্রণে কড়া মনোভাব দরকার। এজন্য টাকার খুব দরকার পড়ে না, দরকার বুদ্ধি ও ইচ্ছা।
সবচেয়ে জরুরি প্রশাসন ও আমজনতার সচেতনতা বাড়ানো। ঘটা করে গাছ লাগানো, লম্বা লম্বা মিছিল, সেমিনার করে কতটা লাভ হবে সন্দেহ। সবচেয়ে বেশি দরকার বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করাটা। 
সত্যি যদি কোনও দিন কবীর সুমনের গানের লাইনকে সত্যি করে, গাছকাটা হলে শোকসভা হয় বিধানসভায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
Keya Ghosh বলেছেন…
দূষণের রাজনীতি নয়‌ শুধু রাজনীতির দূষণ দূর করলে তবেই সদিচ্ছা ও সদর্থক ভাবনা আসবে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে। নাহলে বছরের পর বছর পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার নিয়ে পরীক্ষার খাতায় শুধুমাত্র রচনা লেখা হবে নম্বর পাওয়ার জন্য ... পাতার পর পাতায় রিপোর্ট জমা হবে তথ্য দিয়ে।

Top Post Ad