link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

'বাম'-শূন্য বাংলা? কিছু এলোমেলো ভাবনা / ৯

গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৯

বামপন্থা মানে প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা, তাকে বদলানো। বামফ্রন্ট সরকার তৈরির আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল, একটি অঙ্গ রাজ্যের সরকার কোনও মৌলিক সমস্যা মেটাতে পারে না। তার জন্য বিপ্লব দরকার। সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে কাঙ্খিত বদল সম্ভব নয়। এরকমটাই ছিল ধারণা।
বামফ্রন্ট সরকার চালানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলছিল। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সংসদীয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই ব্যবস্থাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করে করে কাঙ্খিত বদলের দিকে যাওয়া সম্ভব।
যেমন শিক্ষার কথা ধরা যাক। এক সময় বামপন্থীরা মনে করতেন, সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা এই সংসদীয় পথে সম্ভব নয়। বাস্তবে ব্যবস্থাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করেই বদল এসেছে। শিক্ষা এখন মৌলিক অধিকার। 
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও জ্যোতি বসু
ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা, নির্বাচিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মতো যে সব পদক্ষেপ দেখিয়ে 'বিপ্লবী' উল্লাস প্রকাশ করা হয়, সে সবই তো এই সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেই আন্দোলন করে অর্জিত।
সেগুলো প্রয়োগ করলে বেশির ভাগ মানুষের ভালোর জন্য নতুন সম্ভাবনার রাস্তা তৈরি হবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সেই বদল আনতে হবে। অর্থাৎ ব্যবস্থার অংশ হয়েও ব্যবস্থাকে অবিরাম চ্যালেঞ্জ করে যাওয়া যাবে। বেশির ভাগ মানুষের প্রয়োজনে ব্যবস্থাকে বদলের কাজটা চলতে থাকবে। 
বিমান বসু, সীতারাম ইয়েচুরি, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
এই বাস্তব অভিজ্ঞতাটা তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা পেল না। বলা ভাল, দেওয়া হল না। হয়তো 'বিপ্লবী চরিত্র' নষ্টের ভয়ে। ফলে চলাচলটাই এলোমেলো হয়ে গেল। বাস্তবের সঙ্গে তো মিলছে না। ফলে বাস্তবকে বদলের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বন্ধ হয়ে গেল।  'আন্দোলনের সহায়ক শক্তি' বামফ্রন্ট সরকার পরিণত হল স্থিতাবস্থার শক্তিতে। স্রোত হারিয়ে জল থমকে গেলেই তাতে পাঁক জমে। রাজনৈতিক জমিদারির হাত ধরেই সিপিএম নেতারা রাজনৈতিক আমলা হয়ে যেতে শুরু করলেন। গ্রামে-শহরে, সর্বত্র। 
১৯৯১। হাজরা মোড়ে আক্রান্ত মমতা ব্যানার্জি।

ডঃ অশোক মিত্রর কথায়, 'একটা উদাহরণ দিই। ভূমিসংস্কারের কথা ধরা যাক। বর্গাদারদের আইন করে অধিকার পাইয়ে দেওয়া হল। কিছু কিছু ভূমিহীন মানুষ এক ছটাক দু’ছটাক করে জমি পেতে শুরু করলেন। ব্যাঙ্কের ওপর চাপ দিয়ে কিছু কিছু টাকার ব্যবস্থাও হল। কিন্তু এর পরে কী হবে? ওই যে ছোট ছোট জমি, তার উৎপাদনশীলতা তো অত্যন্ত সীমিত। আজ যাকে একটু জমি দিলাম, কাল গিয়ে তো তাকে বলতে পারি না যে, এসো, তোমার জমির সঙ্গে পাশের জমি মিলিয়ে দিয়ে একসঙ্গে চাষ-আবাদ করো, তা হলে উন্নতি হবে। সমবায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করা উচিত ছিল। বীজ, সার, ফসল ইত্যাদি ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমবায় আন্দোলনকে কাজে লাগাতে পারলে কৃষিজীবীর লাভ হত, এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সমবায়ের প্রয়োজন অনেক ভাল বুঝতে পারতেন। কিন্তু সে দিকে নজর দেওয়া হল না। তার পরে ফ্রন্টের সব ভাগাভাগি ব্যাপার ছিল, সমবায় ছিল এক শরিক দলের হাতে। নানা সমস্যা।'

শেষ বার রাইটার্স বিল্ডিং ছাড়ছেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু
অধ্যাপক প্রণব বর্ধনের কথায়, 'অনেক বামপন্থী নেতার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অনেকেই একটা কথা বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গে সমবায় হয় না।' এটা শুনলে আমার ভীষণ রাগ হয়ে যায়। আমি বলি, ‘আচ্ছা, আপনি তো নিজেকে কমিউনিস্ট বলেন। তা, কমিউন তো হচ্ছে সমবায়ের আর একটা উঁচু স্তর, সবচেয়ে উঁচু স্তর। সমবায়ই যদি না হয়, তা হলে কমিউনিজম তো হবেই না, তা হলে নিজেকে কমিউনিস্ট বলবেন না, অন্য কিছু বলুন। সমবায় জিনিসটা যে বিশ্বাস করে না, আমি মনে করি তাঁর নিজেকে কমিউনিস্ট বলার কোনও অধিকারই নেই।' 
ইডেনে নেলসন ম্যান্ডেলার সংবর্ধনা সভায়
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও কলকাতার মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের কথায়, 'বামপন্থী নেতারা যেমন এক দিকে দেশ চালাতে পারেন, তেমনই অন্য দিকে বামপন্থী কর্মী হিসেবে নতুন কী করা যায়, সে সম্বন্ধে তাঁদের চিন্তা করার প্রয়োজন ছিল। যেটা বামপন্থীরা এক সময় করেছেন, যেমন ভূমি সংস্কার নিয়ে, পঞ্চায়েত নিয়ে—কেরলে তো নানা ভাবে করেই চলেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেই ঐতিহ্যটা যেন ছেড়ে দেওয়া হল, যখন দেখা গেল বহু দশক ধরে তাঁরা রাজত্ব করছেন এবং কিছু একটা সমস্যা হলেই বলা হচ্ছে—ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে একটু খবর দাও, তা হলেই সব হয়ে যাবে। এখন, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে খবর দিয়ে সমস্যার সমাধান করাটাকে তো ঠিক 'কমিউনিস্ট সলিউশন' বলা যাচ্ছে না!'
মুকেশ আম্বানি ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
দেশী-বিদেশী বেসরকারি বিনিয়োগে নীতিগত আপত্তির কথা বলতেন বামপন্থীরা। সেই মনোভাব নিয়ে কি বিকল্পের সম্ভাবনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল? 
অধ্যাপক প্রণব বর্ধনের কথায়, 'নয়া উদারতন্ত্র বা ধনতন্ত্রকে শুধু গাল দিয়ে কোনও লাভ নেই, যদি না বিকল্প কিছু করে দেখাতে পারি। 'শিল্প হচ্ছে না' বলে এত শোরগোল, তো, ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান মিলে সমবায় তৈরি করে ঋণ—আজকাল তো ঋণ পাওয়ার নানা সুযোগ—কাঁচামাল ইত্যাদি জোগাড় করা যায়, বিপণনেরও ব্যবস্থা করা যায় সমবায়ের ভিত্তিতেই এবং গোটা উদ্যোগের নিয়ন্ত্রণটা শ্রমিকদের হাতেই থাকবে। এই চেষ্টাটা তো এ দেশের বামপন্থীরা বিশেষ করেনইনি কখনও।'

ভার্গিস কুরিয়েনকে সম্মান আমূলের
ডঃ অশোক মিত্র বলেছিলেন, 'ভার্গিস কুরিয়েন আমার অনেক দিনের বন্ধু, একসঙ্গে কাজ করেছি, তাঁকে বললাম, তুমি পশ্চিমবঙ্গের জন্যে একটা মাদার ডেয়ারি তৈরি করে দাও। তিনি বললেন, তুমি বলছ, আমি নিশ্চয়ই করে দেব। দিলেনও। কিন্তু দু’বছর যেতে না যেতেই দেখা গেল অদ্ভুত ব্যাপার। যে ধারণাটা কুরিয়েনের বরাবর ছিল, তা হল, ছোট বড় সবাই মিলে সমান অধিকার প্রয়োগ করবে, ক্ষুদ্রতম কৃষক বা দুধওয়ালাও দাবি করতে পারবেন যে, এই যে দুধ, মাখন, পনির, এমনকী মিষ্টি দই তৈরির মস্ত ব্যবস্থাটা দেখছ, এটা আমারও। কিন্তু এখানে মাদার ডেয়ারিতে প্রথম থেকেই কে কত মাইনে পাবে, সে সব নিয়ে দল থেকে নাক গলানো শুরু হল। এই নিয়ে আর একটা গল্প শুনেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গে তিনি আরও মাদার ডেয়ারি খুলছেন না কেন, এই প্রশ্নের জবাবে কুরিয়েন নাকি বলেছিলেন, দেয়ার আর টু মেনি বেঙ্গলিজ ইন বেঙ্গল!
২১ জুলাই, ১৯৯৩। রাইটার্স অভিযানে অসুস্থ মমতা ব্যানার্জি।
অধ্যাপক প্রণব বর্ধন বলেছেন, 'আসলে এঁরা 'চলছে না চলবে না' নেতিবাচক বাগাড়ম্বরেই আছেন, গঠনমূলক কিছু করতে বললেই নানা অজুহাত। কিন্তু এই বিকল্প কিছু করে দেখানোর দায়িত্ব না নিলে ধনতন্ত্রকে গাল পাড়ার কোনও হক এঁদের আছে বলেই আমি মনে করি না। ধনতন্ত্রের অনেক সমস্যা, আমি জানি, কিন্তু তোমরা কী করছ? বড় শিল্প না পারলে অন্তত শ্রমিক-নিয়ন্ত্রিত কিছু ছোট আর মাঝারি উদ্যোগ করো, করে দেখাও।' (চলবে)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad