link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

'বাম'-শূন্য বাংলা? কিছু এলোমেলো ভাবনা / ৫

গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৫

আশির দশকের শেষ বা নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই শুরু হল কৃষিক্ষেত্রে উলটপুরাণ।

ভূমিহীন ও প্রান্তিক মানুষকে জমি দেওয়া হয়েছে কিন্তু জমির আকার তো খুব ছোট। নিজের জমি, এই আবেগে সবটুকু সামর্থ দিয়ে কৃষক, বর্গাদার চাষ করেছেন। তাতে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এভাবে তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না। জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমছে। কৃষক পরিবারে পরবর্তী প্রজন্ম এসে যাওয়ায় জমি আরও ছোট ভাগ হচ্ছে। চিকিৎসা, বিয়ে বা পরিবারের অন্য কোনও সংকটে কৃষক জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। জমির আয়তন কম হওয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানোও যাচ্ছে না। খেতের আল দিতে প্রচুর জমি নষ্ট হচ্ছে। উৎপাদিত ফসল বিক্রির ব্যবস্থাপনাও দুর্বল। চাষ করে আর পেট ভরানো যাচ্ছে না। ব্যাপক হারে জমির হাতবদল শুরু হল। ২০০৪ সালে রাজ্য সরকারের প্রকাশিত তথ্য বলছে, গ্রামীণ বাংলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে কোনও জমি নেই।  

প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্র
ডঃ অশোক মিত্রের কথায়, 'ভূমিসংস্কারের পরবর্তী অধ্যায়ে উৎপাদন বাড়ানোর চিন্তা করা হয়নি। সমবায় নিয়েও তেমন আলোচনা হয়নি। ছোট চাষিরা জমি পেলেও জীবিকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পারলেন না। কয়েক বছর পর থেকেই তাঁদের অনেকে মাঝারি বা বড় জোতদারদের কাছে জমি বিক্রি করে ফের ভূমিহীন খেতমজুর হয়ে গেলেন। এই মাঝারি ও বড় জোতদাররা এখন রীতিমত জমিদার, অনেকে জমির মালিকানার ঊর্ধ্বসীমার আইনি ব্যবস্থার ফাঁকফোকরও রপ্ত করে ফেললেন। আবার তাঁদের হাতেই দলের গ্রামীণ নেতৃত্ব, তাঁরা পঞ্চায়েতেরও মাতব্বর, প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও তাঁরা শিক্ষক। তাঁরা নামেই বামপন্থী, মানসিকতায় সম্পন্ন শ্রেণিভুক্ত।'

সাংবাদিক-গবেষক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া হিসেব, মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলার মোট ৬০১৯টি গ্রামে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে, পঞ্চায়েত সদস্যদের ৫৩.৮ শতাংশই ৬ একরের বেশি জমির মালিক বা শিক্ষক বা সমাজসেবী। পঞ্চায়েত সদস্যদের মাত্র ৮.৩ শতাংশ হলেন কৃষি মজুর। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া দরিদ্র মানুষ মোট পঞ্চায়েত সদস্যদের মাত্র ৫ শতাংশ।'

পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড় বদল। গ্রামীণ বাংলায় জন্ম নিল নতুন রকম জমিদারি, রাজনৈতিক জমিদারি। যার প্রতীক হয়ে উঠল সিপিএমের লোকাল কমিটিগুলো, গ্রামীণ বাংলার আর্থিক-সামাজিক- রাজনৈতিক সব ক্ষমতার কেন্দ্র। বাম জমানাতেই তৈরি হতে শুরু করল অনুজ পাণ্ডেরা (আজকের ভাদু শেখদের পূর্বসুরী বলা যায়)। হয়তো সে কারণেই সমবায় চাষে উৎসাহ দেখা যায়নি। কৃষি সংকটের চরিত্র বুঝে সমাধানের পরিকল্পনা হয়নি। সমবায় গড়ে উঠলে সেটাই হত গ্রামীণ বাংলার আর্থিক ক্ষমতার কেন্দ্র। তাতে লোকাল কমিটির ক্ষমতা বিলক্ষণ কমত।

সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দল নির্ভর একটা সমাজ-কাঠামো, পার্টি-সমাজের চারা ক্রমশ ডালপালা মেলতে শুরু করল। শুরু হল, শুধু পার্টির পরিচয়ে কোনও মানুষকে দেখার অভ্যাস। সেখান থেকে অনিবার্যভাবেই এল 'আমরা-ওরা'র ভাবনা। সিপিএমের অনেক শীর্ষ নেতার কথাতেও ক্রমশ তা প্রকাশ পেতে শুরু করল। ('আমরা ২৩৫ ওরা ৩০', নন্দীগ্রামের মানুষের 'লাইফ হেল' করে দেওয়া, 'পেড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন' ইত্যাদি ইত্যাদি)। স্পষ্ট হল, ওটাই নতুন সিপিএমের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। স্বাভাবিক ভাবে ক্রমশ সেটাই পরিণত হল রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে।

দেখা যাচ্ছে, কৃষিতে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখা গেল না। শিল্পক্ষেত্রেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হল না। তৈরি হল বড় সংখ্যায় দিনমজুর ইত্যাদির মতো অসংগঠিত শ্রমিক। ক্রমশ বাড়ল পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাও। কোথাও কাজের সুযোগ নেই। বিপুল বেকার বাহিনী। কেবলমাত্র পার্টির সঙ্গে লেগে থাকলেই আয়ের সুযোগ (আইনী কম, বেআইনী বেশি) তৈরি হতে পারে। প্রথম দিকে পার্টির লোকেদের পুরসভা, শিক্ষকতা নানা জায়গায় চাকরি দেওয়া হয়েছে। পার্টির ছত্রছায়ায় গড়ে উঠল প্রোমোটারি ব্যবসা। পার্টিতন্ত্রের শিকড় আরও গভীরে ঢুকল। সমাজের মধ্যেই যেন আরও একটা সমাজ হয়ে উঠল। তার চলাচল সাধারণ সমাজের মতো নয়। বাম রাজনীতিও ক্রমশ পাওয়ার জায়গা হয়ে উঠল। কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, পার্টি আমাকে কী দিয়েছে? আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পার্টি যাঁদের চাকরি দিয়েছে, তাঁদের অনেকেই পার্টির কাজ থেকে সরে গেছেন। 

ডঃ অশোক মিত্রর কথায়,  'পার্টি এক সময় বশ্যতা আর দক্ষতার তফাত করতে ভুলে গেল।...বামফ্রন্টের প্রধান দলে যাঁরা যোগ দেন, তাঁদের মধ্যেও কিছু বিশিষ্ট, সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন। স্বয়ং জ্যোতি বসু অত্যন্ত দায়িত্বশীল, সৌজন্যপূর্ণ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সামগ্রিক নেতৃত্বের যে চাপ,       উঁচুদরের প্রবীণ নেতারা সেই চাপটা আটকালেন না।
('খেয়াল করুন, ডঃ মিত্র কিন্তু 'আটকাতে পারলেন না' কথাটা না বলে বললেন 'আটকালেন না'।)

আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ধান্দাবাজির রাজনীতিই প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়ে নিল। যত দিন গেছে সেই বিপজ্জনক প্রবণতা ক্রমশ বেড়েছে। তৃণমূল জমানায় তা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad