গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ১১
 |
| রতন টাটা ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
১৯৯৪ সালে শিল্পনীতি নিলেও সিপিএমের ভেতরের টানাটানিতে রাজ্যে শিল্পায়নের প্রক্রিয়া শুরু হতে দেরি হয়। নব্বইয়ের শেষ ভাগে বদলের চেহারাটা চোখে পড়তে শুরু করে। ঠিক তখনই, ২০০০ সালে জ্যোতি বসুর বদলে মুখ্যমন্ত্রী হলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তারপরেই এমন একটা ধারণা তৈরির চেষ্টা হল, মুখ্যমন্ত্রী বদল করাতেই শিল্পায়নের গতিও বদলাল।
ডঃ অশোক মিত্র মতে, 'শিল্পায়নের জন্য পুঁজিপতিদের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একটি আদর্শসম্মত বিকল্প সুযোগ বামপন্থী নেতা-মন্ত্রীরা হাতছাড়া করেছিলেন। ২০০৪ সালে কেন্দ্রে সরকার গঠনে কংগ্রেস দলকে সমর্থনের সুবাদে বামফ্রন্ট তিনটি সুস্পষ্ট শর্ত আরোপ করতে পারত, (১) পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা পূর্ব ভারতে ব্যাঙ্ক ঋণ অন্তত দশগুণ বাড়াতে হবে, (২) পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্ব ভারতে কৃষি শিল্প পরিষেবা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পাঁচ বছরে দশ গুণ বাড়াতে হবে, (৩) বামদের পূর্বসম্মতি ছাড়া অর্থ কমিশন ও যোজনা কমিশনের সদস্য নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। পাশাপাশি, জমি অধিগ্রহণের সমস্যা নিরসনের জন্য যে কৃষকদের জমি নেওয়া হল, আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট শিল্পের আংশিক মালিকানা তাঁদের প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট করা যেত। কিন্তু বামফ্রন্টের নেতারা সে-সব নিয়ে আদৌ ভাবলেন না, ভাসা-ভাসা সদিচ্ছা-ঠাসা একটি যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে নিশ্চিন্ত মনে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন জানালেন।'
.jpeg)
ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকল আদর্শগত অবস্থান বদলের ছবিটা। বামপন্থীদের সরকার চালানোর অন্যতম কারণ বিকল্প মডেল করে দেখানো। কিন্তু দেখা গেল, আদর্শগত ভাবে বাজার অর্থনীতির ঘোর বিরোধী বামপন্থীরা শিল্পায়নের নামে সেই রাস্তাই বেছে নিলেন। বলা শুরু হল, 'ঘুরে দাঁড়াতে হবে'। অনেকে বলবেন, আদর্শ ধুয়ে খেলে কি কাজের সুযোগ তৈরি হবে? ঠিকই তো। তার মানে কি বামপন্থীদের অর্থনৈতিক ভাবনা কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারে না? পুঁজিবাদ কর্মসংস্থানহীন উন্নয়নের রাস্তায় চলছে, অর্থনীতিবিদদের এই ব্যাখ্যা কি তাহলে ভুল? শাসক দলের ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব মেনেই নিলেন, পুঁজিবাদ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। অর্থাৎ মেনে নেওয়া হল বামপন্থীদের কাছে উন্নয়নের কোনও বিকল্প মডেল নেই, নরেন্দ্র মোদীর 'গুজরাট মডেল'-ই রাস্তা। |
| ব্রিগেডে বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রকাশ কারাত, মনোজ ভট্টাচার্য, সীতারাম ইয়েচুরি |
সিপিএম আদর্শগত ভাবে রিটেল ব্যবসায় দেশী-বিদেশী বড় সংস্থার বিনিয়োগের বিরুদ্ধে, এসইজেড মডেলের বিরুদ্ধে। অথচ সেই দলেরই পলিটব্যুরো সদস্য, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রিটেল ক্ষেত্র ওয়ালমার্ট-রিলায়েন্সের মতো বড় সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে জোর গলায় সওয়াল করে যাচ্ছেন। নন্দীগ্রামে এসইজেড করার কথা বলছেন। মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি নিয়ে সমস্যার কথা অনেকের মনে থাকতে পারে। বামপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে, বাজার অর্থনীতিকেই মোক্ষ লাভের পথ ঠাউড়ে এগোতে চাওয়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই হয়ে গেলেন 'বাম' নেতা-কর্মীদের 'ভগবান'। মিডিয়াজুড়ে 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ'-র জয়জয়কার।
 |
| বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও জ্যোতি বসু |
দলের মধ্যে কোনও 'কলকাতার যীশু' প্রশ্ন তুলল না, 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ' কি বামপন্থার রাস্তায় চলছে? বামরাস্তায় হেঁটে কি সংকট কাটানোর উপায় আছে? বামপন্থী হিসেবে পরিচিত অর্থনীতিবিদরা কি বিকল্প কোনও মডেল হাজির করছেন? সেই চর্চার বদলে চলতে থাকল ভজনা, ব্যক্তি ভজনা, বুদ্ধ-ভজনা।  |
| জ্যোতি বসুর মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
৯ নভেম্বর, ১৯৯৪ যাদবপুর স্টেডিয়ামে সিপিআইএম নেতা-কর্মীদের সামনে 'বামফ্রন্টের শিল্পভাবনা এবং আমাদের কর্তব্য' শীর্ষক আলোচনায় জ্যোতি বসু বলেন,
'আমরা এরাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে কী ভাবছি তা সাধারন মানুষকে বোঝাতে হবে এবং তাঁরা নিশ্চই বুঝবেন।...কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন আপনারা তো শ্রেণি সংগ্রামের পথ ছেড়ে দিয়েছেন, আমি বলি, শ্রেণি সংগ্রাম করছি বলেই ১৭ বছর ক্ষমতায় আছি। শ্রেণি সংগ্রাম করছি বলেই শ্রমিকদের অনেক দাবি মালিকদের মেনে নিতে হয়।...শ্রমিকদের বলি দাসখত দেবেন না, ন্যায্য দাবি দাওয়ার জন্য আন্দোলন করবেন। আমরা বলি ধর্মঘটের অধিকার অবশ্যই থাকা উচিত।... শ্রমিকরা যদি নিজেদের অধিকার ছেড়ে দেন তাহলে তো তারা শ্রমিক হওয়ার উপযুক্তই নন।'
 |
| বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কী বলেছিলেন?
'ব্যক্তিগত ভাবে আমি ধর্মঘট সমর্থন করি না। বনধ দেশের ভাল করে না। ঘেরাও বেআইনি, অনৈতিক। ইংরেজি অভিধানে এই শব্দটা আমরা যোগ করেছি। দুর্ভাগ্যবশত আমি এমন একটা দলে আছি যারা ধর্মঘট করে, বনধ ডাকে। আমার কষ্ট হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারি না। ঠিক করেছি, আর চুপ থাকব না।'
দুই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যেই আদর্শগত ফারাকের ছবিটা স্পষ্ট।
(আমার মতে, সময়কে না বুঝেসুঝে, কারণে-অকারণে, যখন-তখন কোনও অস্ত্র ব্যবহার করলে তার ধার কমে যায়। তা বলে সেই অস্ত্র তো নিষিদ্ধ হতে পারে না। লুটে খাওয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে খেটে খাওয়া মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ধর্মঘট। যখন তখন তা ব্যবহার করা যেমন বোকামো, তেমনই ওই অস্ত্র ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা মানে খেটে খাওয়াকে নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধে নামতে বলা।)
 |
| বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রোড শো |
যদি বামফ্রন্ট সরকার বামপন্থা থেকেই সরে যায়, তাহলে আর বামফ্রন্ট সরকার থাকার দরকার কী? (চলবে)