গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৩
ক
১৯৭৭। কংগ্রেসের একদলীয় সরকার বাতিল করল দেশ। কেন্দ্রে তৈরি হল প্রথম অকংগ্রেসী সরকার। চৌধরী চরণ সিং-এর নেতৃত্বে দেশের প্রথম জোট সরকার। তারপরেই এরাজ্যে বিধানসভা ভোটের দিন ঘোষণা হল। লোকসভা ভোটে জনতা পার্টির সঙ্গে বাম দলগুলোর আসন রফা হলেও বিধানসভা ভোটে হল না। তার ফলেই কয়েকটি বাম দল একজোট হয়ে বামফ্রন্ট গড়ে ভোটে আলাদা লড়ার সিদ্ধান্ত নিল। সবাইকে চমকে দিয়ে ২৯৪ আসনের মধ্যে ২৩১টি পেল বামফ্রন্ট। চমকে গিয়েছিলেন বামপন্থী নেতারাও।
![]() |
| মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন জ্যোতি বসু। ২১ জুন, ১৯৭৭ |
সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামপন্থীরা জনতা পার্টিকে ৫৬% (মতান্তরে ৫১%) আসন এবং মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি ছিল। নিজেরা সরকার গড়তে পারার সামান্য কোনও ইঙ্গিত পেলেও কি বাম নেতারা অধিকাংশ আসন জনতা পার্টিকে ছাড়তে রাজি হতেন?
একবার জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখন ভেবেছিলেন আপনারা সরকার তৈরি করবেন? জবাবে বলেছিলেন, 'আমার কথা ছেড়ে দাও, প্রমোদ দাশগুপ্ত, অশোক ঘোষের মতো নেতারাও ভাবতে পারেননি। মনে রাখবে, মানুষ ইতিহাস তৈরি করেন। তাঁরা কখন যে কী করবেন অনেক সময় সেটা কল্পনাও করা যায় না।'
ইতিহাসে এরকম 'চান্স ফ্যাক্টর' অনেক সময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও হল। রাজ্যে গড়ে উঠল বামফ্রন্ট সরকার। শুধু দেশের নয়, সারা দুনিয়ার বাম আন্দোলনের নতুন পরীক্ষা শুরু হল।
সরকার গড়ার ব্যাপারে নেতাদের কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা বলতে, দুটো যুক্তফ্রন্ট সরকারের ২১ মাসের ছোট্ট ইনিংস। কিন্তু শুরুতেই বামফ্রন্ট সরকারের কাজে নতুন ভাবনার ছাপ।
খাস জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে বিলি, অপারেশন বর্গার মাধ্যমে বর্গাদারদের অধিকার নিশ্চিত করা আর ত্রিস্তর নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা-এই তিনের ধাক্কায় গ্রামীণ বাংলার সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির বড়সড় বদল ঘটল। একটা কথা বলে রাখা জরুরি, এগুলো সবই আইনে ছিল। কিন্তু আগে কেউ প্রয়োগ করেনি।
রাজ্যে কৃষি উৎপাদন বাড়ল। ১৯৪৯-১৯৮০ সময়কালে রাজ্যে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার ছিল ১.৭৪%। জনসংখ্যা বেড়েছে তার চেয়েও বেশি হারে। ১৯৮১-১৯৯১ সময়কালে সেই হার বেড়ে হয় ৬.৫%, রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বা দেশের কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশি। মৈত্রীশ ঘটক, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পল গার্টলার তাঁদের যৌথ গবেষণায় দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে ধানচাষে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অন্তত এক তৃতীয়াংশ অপারেশন বর্গার ফলে সম্ভব হয়েছে।
প্রান্তিক মানুষের হাতে পয়সা আসায় রাজ্যের ভেতর বাজারও বাড়ল। ছোটখাটো নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হল।
গরীব মানুষ আত্মসম্মান নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। প্রশাসন পরিচালনার ভার পেলেন। প্রশাসনিক কাজের ভার পেলেন প্রচুর মহিলাও।
নির্বাচিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের (participatory form of democracy) ভিত্তি তৈরির কাজটা করল। পরে সারা দেশের জন্য সেই মডেল নিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী।
সদ্যোজাত বামফ্রন্ট সরকারের কাজকর্ম চোখ টানলো সারা দুনিয়ার।
![]() |
| প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শপথের পর রাইটার্সের সামনে সরকারি কর্মীদের সভায় জ্যোতি বসু |
এক সময় কেউ মাস্টারমশাইদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইতেন না। তাঁদের বেতন ছিল খুবই কম। বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতনের ব্যবস্থা করল। বেতন বাড়ল। তার চেয়েও বড় কথা আত্মসম্মান পেলেন শিক্ষকরা, যাঁরা সমাজ গড়ার কারিগর।
![]() |
| জ্যোতি বসু, ভিপি সিং, এনটি রামা রাও, করুণানিধি, দেবীলাল, রামকৃষ্ণ হেগড়ে |
খ
আগেই বলা হয়েছে, শিল্প তৈরিতে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স তৈরির অনুমতি দিতে আপত্তি করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় নিরাপত্তা জনিত কারণে পশ্চিমবঙ্গকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। মজার কথা, পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গুজরাটে কিন্তু রিয়ালেন্স শিল্পগোষ্ঠীকে পেট্রোকেম তৈরির লাইসেন্স দেওয়া হয়। অর্থাৎ রাজ্যের শিল্পে পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ কেন্দ্রের নীতি ও মনোভাব।
![]() |
| রেল রোকো |
তার মানে কি শিল্প ক্ষেত্রে রাজ্যের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার জন্য বামফ্রন্ট সরকার, বাম আন্দোলন বিশেষত বাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কোনও নেতিবাচক ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে। একটানা ৩৪ বছর যারা রাজ্য চালিয়েছে তাদের দায়িত্ব থাকবে না?
![]() |
| জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
আগের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে কেন রাজ্যের মূল শিল্প পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং চা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেনই বা হলদিয়ায় পেট্রোকেম, সল্টলেকে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স, বক্রেশ্বরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। একই সঙ্গে শিল্পায়ন সম্পর্কে রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের দূরদৃষ্টির অভাব, স্বচ্ছ্ব ভাবনা না থাকাও রাজ্যের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। প্রচলিত ধ্যানধরাণার বাইরে বেরোতে দেরি হওয়ায় সুযোগটা কাজে লাগায় অন্য রাজ্য। ১৯৮৫ সালেই রাজ্যে যৌথ উদ্যোগে বড় শিল্প তৈরির সিদ্ধান্ত হলেও শাসক শিবিরের রাজনৈতিক গোঁড়ামি প্রশাসনিক উদ্যোগের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৯১ সালে উদার অর্থনীতির যুগ শুরুর পরে মাসুল সমীকরণ নীতি ও লাইসেন্স প্রথা উঠে যায়। প্রাথমিক ভাবে বামেরা উদার অর্থনীতির সম্পূর্ণ বিরোধিতার রাস্তায় যায়। দলের ভিতরের টানাপোড়েন সামলে রাজ্যের নতুন শিল্পনীতি বানাতে তিন বছর সময় লেগে যায় জ্যোতি বসুর। ততক্ষণে অন্য রাজ্য বিনিয়োগ টানতে শুরু করে দিয়েছে। নতুন শিল্পনীতি নিয়ে রাজ্যের বাম শিবিরের দ্বিধা ও অস্বচ্ছ্বতাও বড় বাধা তৈরি করেছিল।
শিল্পায়নের উপযোগী পরিস্থিতি তৈরিতে ট্রেড ইউনিয়নের মনোভাব বদল ছিল অন্যতম প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু পুরোনো অভ্যাস থেকে সরা যায়নি। অযথা বনধ- ধর্মঘট, ধ্বংসাত্মক আত্মঘাতী আন্দোলন অনেকক্ষেত্রে শিল্পপতিদের বিমুখ করেছে। রাজ্যের শিল্পে বাধা তৈরি করেছে। ক্রমশ তার সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে দাদাগিরির অভ্যাস।
রাজ্যের শিল্পায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কর্মসংস্কৃতি। এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বাম শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠনগুলোর অবিবেচক ভূমিকা। যেন ধরেই নিয়েছিলেন, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাঁরাই। তাই নেতাদের কাজকর্ম না করলেও চলবে। তাঁদের ইচ্ছেতেই কারখানা চলবে। শ্রমিক-কর্মচারিদের স্বার্থ রক্ষায় সবচেয়ে আগে যে শিল্প বাঁচাতে হবে, সেই প্রাথমিক বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলেন বহু শ্রমিক নেতা।
![]() |
| জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
ডঃ অশোক মিত্র বলেছিলেন, 'আমার মনে পড়ছে, উত্তর চব্বিশ পরগনার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা অনেক দিন ধরে বন্ধ হয়ে ছিল। সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ হল, ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে ঋণের ব্যবস্থা করা হল। যাতে খুব ভাল ভাবে পরিচালনা করা যায় সে জন্য শ্রমিকদের মধ্যে থেকে দু-এক জন প্রতিনিধি নেওয়া হল। এক জন শ্রমিক নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। তাঁকে বার বার বলা হল, আপনাকে দেখতে হবে যেন কোনও টাকাপয়সার অপচয় না হয়, যাতে উৎপাদন বাড়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সপ্তাহ বাদে আমার চোখে ভিরমি লাগল—দেখি, সেই শ্রমিক নেতা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির একটা গাড়ি নিয়ে সারা কলকাতা আর চব্বিশ পরগনা চক্কর দিচ্ছেন। এই রকম ছোট ছোট অনেক ঘটনা আছে।'
![]() |
| দেশে প্রথম মোবাইল ফোন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুখরামের সঙ্গে কথা বলছেন জ্যোতি বসু। ৩১ জুলাই, ১৯৯৫ |
রাজনৈতিক কারণেই রাজ্য সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবও তৈরি করা হয়েছিল। জ্যোতি বসুর সময়ই সল্টলেকে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্সের সূচনা হয়। সূচনা হয় তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের। ভারতে প্রথম মোবাইল ব্যবহারকারী ছিলেন জ্যোতি বসু ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুখরাম। জ্যোতি বসুরা যে আধুনিক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন না, তা স্পষ্ট। তবু এখনও অনেকেই বলেন, জ্যোতি বসুরা কম্পিউটারের বিরুদ্ধে ছিলেন। আধুনিক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। বাস্তবে অপরিকল্পিত কম্পিউটার ব্যবহারে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিরোধিতা করেছিল বামেরা। শিল্প গড়তে হবে মানে শিল্পপতিদের অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র দিতে হবে?
![]() |
| বিধানসভায় অসীম দাশগুপ্ত, সূর্যকান্ত মিশ্র, নিরুপম সেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
বামফ্রন্ট সরকার শিল্পায়নের উদ্যোগ সম্পর্কে রাজ্যের মানুষের মধ্যে এই নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়াও এগোনোর ক্ষেত্রে ছিল বড় বাধা। পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময় মনে হয়েছে, ওই কথা শাসক দলের শীর্ষ স্তর থেকে নীচুতলার নেতা-কর্মীরাও বিশ্বাস করতেন।
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে গুরুত্ব দিয়েছিল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বছরের পর বছর রাজ্য দেশের মধ্যে পয়লা নম্বরে ছিল। কিন্তু তাতে বিপুল বেকারত্বের চাপ সামলানো যায়নি। সে সময় পর্যটন-সহ বিভিন্ন পরিষেবা ভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া হয়নি।
ফল?
১৯৭৭-৭৮ সালে কর্মসংস্থানের বিচারে পশ্চিমবঙ্গে ছিল দুয়ে। দশ বছর পরে চলে যায় চার নম্বরে। (চলবে)

.jpeg)



.jpeg)


.jpeg)

