গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ২
দেশভাগের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুটি রাজ্য-পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাব। পঞ্জাবে উদ্বাস্তু সমস্যা মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকার দরাজ হাতে সাহায্য করলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে হাত উল্টে বসে ছিল। তবু হাত গুটিয়েই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য সক্রিয় হননি নেহরু মন্ত্রিসভার সদস্য, 'হিন্দুত্ববাদী' নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও। মজার কথা হল, রাজ্যের 'রূপকার' হিসেবে ওই দু'জনকেই চিহ্নিত করার অভ্যাস দিব্যি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে।

বিধানচন্দ্র রায় ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও প্রায় এক কোটি মানুষ আসেন।
স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ অন্য রাজ্যের তুলনায় ক্রমশ কমতে থাকল। রাজ্য থেকে আদায় হওয়া রাজস্বের কত শতাংশ কেন্দ্র রাজ্যকে ফেরাচ্ছে, সেই হিসেবেও পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়তে লাগল। বছরের পর বছর এই ঘটনা চলতেই থাকল।
স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের সবচেয়ে ধনী রাজ্য। মাথাপিছু আয়ে ছিল দেশে এক নম্বর। দু নম্বরে মহারাষ্ট্র। তার দু’দশক পরে, ১৯৬৬ সালে আয়ের নিরিখে দেশে আট নম্বরে জায়গা পশ্চিমবঙ্গের। একদা যে কলকাতা দেশের বাণিজ্য-রাজধানী ছিল, সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে কার্যত সব বাণিজ্যিক সংস্থাই।
১৯৪৮-১৯৬৫ পর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দুর্গাপুরে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানা, ডিভিসি ইত্যাদি তৈরি হয়। এসবের কৃতিত্ব দিয়েই বিধানচন্দ্র রায়কে 'বাংলার রূপকার' বানানোর চেষ্টা হয়।
১৯৪৭-১৯৫৮ পর্বেই উন্নয়নের হারে বাংলাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে মহারাষ্ট্র। ১৯৬৪ সালে বোম্বেতে কারখানায় কাজ করতেন ১৩.৫৩ লক্ষ আর পশ্চিমবঙ্গে ৮.৮৭ লক্ষ। ১৯৬৫ সালে শ্রমিকপিছু উত্পাদনশীলতায় মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, গুজরাট, তামিলনাড়ুর পিছনে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৬৬-৭৬ পর্বে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। কিন্তু কেন?
স্বাধীনতার আগে বাংলার মূল শিল্প ছিল পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং, ইস্পাত, চা।
১৯৫২ সালে কয়লা ও ইস্পাতে মাসুল সমীকরণ নীতি চালু করে কেন্দ্র। কেন? শিল্পে অনুন্নত পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর ভারতকে উন্নত করা। তার ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা ছাড়াও মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়ের মতো আকরিক সমৃদ্ধ রাজ্যগুলিতে শিল্পের বারোটা বাজিয়ে দেয় ওই মাসুল সমীকরণ নীতি। সামনের সারিতে এগিয়ে আসে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু, দিল্লি, পঞ্জাব। বিনা প্রতিবাদে সেই ভয়ংকর নীতিও মেনে নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দুই 'রূপকার' শ্যামাপ্রসাদ ও বিধানচন্দ্র।
সাংবাদিক রণজিৎ রায় 'ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ' বইয়ে লিখেছেন, '১৭৫৭ সালে বাঙলায় ক্ষমতা দখলের পর ব্রিটিশরা তিন-চার দশক ধরে স্রেফ লুটের রাজত্ব চালিয়েছিল।... ১৯৪৭ সালের পর সেই সমস্ত ব্রিটিশ নীতিই প্রয়োগ করা হয়েছে পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে। এই রাজ্যগুলির উপরে তার ফলাফল হয়েছে বিধ্বংসী। লাভবান হয়েছে অন্যান্য অঞ্চলের সামান্য কয়েকটি সুবিধাভোগী রাজ্য, যারা একত্রিত হয়ে স্বাধীন ভারতের ক্ষমতাদণ্ড নিয়ন্ত্রিত করেছে।'
![]() |
| কলকাতা, ১৯৬০। সৌজন্যে : www.indianeagle.com |
ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ধারণা হল, শ্রমিক অসন্তোষ, বনধ-ধর্মঘট, জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন, নকশালপন্থী আন্দোলনের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের সর্বনাশ হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই, ১৯৬৫-৭৫ সময়কালে রাজ্যে কাজের সুযোগ যত কমেছে, ততই শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। তার সঙ্গে খাদ্য সংকট, নকশালবাড়ি আন্দোলন। তারপর বামফ্রন্ট সরকার। এই সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে শিল্পক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে। কিন্তু সেটাই রাজ্যে শিল্পের সর্বনাশের প্রধান কারণ হলে, মহারাষ্ট্রে শিল্পক্ষেত্র উঠে যেত। সেখানে শ্রমিক আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, হরতালটাই এক সময় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে শেষ করতে কংগ্রেসের পরিকল্পনায় বাল ঠাকরে মারকুটে, খুনে শ্রমিক আন্দোলন চালাতেন সেখানে। মহারাষ্ট্র কিন্তু শিল্পে এগিয়েছে গড়গড় করে।
বোধহয়, অন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণকে আড়াল করতেই এ রাজ্যের শিল্প ধ্বংসের কারণ হিসেবে শ্রমিক আন্দোলনকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। সে সময় নতুন ভারী শিল্প তৈরিতে কেন্দ্রের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হত। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হয়েছিল ৪০টি লাইসেন্স। আর মহারাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছিল ১৫০টি। বৈষম্যের ছবিটা স্পষ্ট।
![]() |
| বাল ঠাকরে |
![]() |
| কলকাতা |


.jpeg)


