গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ১২
আদর্শগত, রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় ভেজাল থাকলে যখন যেমন তখন তেমন চলাটাই রীতি হয়ে যায়। বাস্তবকে আড়াল করতে ফানুস ফোলাতে হয়। তখন দল ও সরকারের লাগাম একই দিনে জন্ম নেওয়া দুই নেতার হাতে। তাঁরাই তখন বদলে যাওয়া সিপিএমের প্রতীক।
 |
| সুজন চক্রবর্তী, মধুজা সেনরায় ও শতরূপ ঘোষের ভোটপ্রচারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক প্রয়াত অনিল বিশ্বাস কৌশলে সমাধানের ওপর জোর দিতে গিয়ে দলের ভিতরেই ষড়যন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়ে দেন। সে সময় 'অনিলায়তন' খুব পরিচিত একটা শব্দ হয়ে ওঠে। আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠিত করলেন উদ্ধত ব্যক্তিবাদকে।
 |
| অনিল বিশ্বাস |
২০০৬ সালে অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে বুদ্ধবাবুই ছিলেন সিপিএমের একমাত্র মুখ। রাজ্যে রোড শো-র সংস্কৃতি চালু হয় তাঁর হাত ধরেই। 'ওঁর (মমতা ব্যানার্জি) নাম মুখে আনতে আমার রুচিতে বাঁধে' বলা বুদ্ধদেব ২০০৬ সালে ভোটে জেতার পরেই হুংকার ছাড়েন, 'আমরা ২৩৫, ওরা ৩৫। ওদের কথা কেন শুনব?' এ তো উদ্ধত হুমকির ভাষা।
.jpg) |
| অসুস্থ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখতে তাঁর বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি |
মজার কথা, সিপিএমের গোড়া থেকে মাথা অনেকেই মনে করেন অনিল-বুদ্ধ যুগই স্বর্ণযুগ। অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে নানা সমস্যায় ল্যাজেগোবরে সরকার, দল। তখন অনেককেই আক্ষেপ করতে শুনেছি, এখন যদি অনিল বিশ্বাস থাকতেন!
.jpeg) |
| বিমান বসু ও অনিল বিশ্বাস |
খেয়াল করলে দেখা যাবে, শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতারা নন, ততদিনে সিপিএমের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন ছাত্র-যুব আন্দোলন করে উঠে আসারাই।
 |
| প্রমোদ দাশগুপ্তর সঙ্গে বিমান বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী |
ডঃ অশোক মিত্রর কথায়, 'আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই দেখা যাচ্ছিল পার্টির মধ্যে নেতারা কেউ কেউ একটু অহঙ্কারে ভুগছেন, চাটুকারদের দ্বারা পরিবৃত হচ্ছেন, চাটুকাররা বাছা বাছা ক্ষমতার জায়গায় পৌঁছচ্ছেন, তাঁরা আবার তাঁদের চাটুকার তৈরি করছেন। এই ভাবে বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত তৈরি হল, পুরো দলটায় ঘুণ ধরল।
যে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে পার্টিতে নতুন আগমনপ্রার্থীদের যাচাই করা হত, আমার মনে হয়, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সেটা ঢিলে হয়ে গেল। প্রবীণ নেতারা একটু অন্যমনস্ক, একটু শ্রান্ত, তার সুযোগ গ্রহণ করলেন কিছু কিছু নবীন, ভূতপূর্ব ছাত্রনেতা কিংবা যুবনেতা, তাঁরা এই প্রবীণ নেতাদের প্রধান উপদেষ্টা ও সহায়ক হলেন এবং তাঁদের যারা সমর্থক ও পেটোয়া মানুষ, তারা কাতারে কাতারে পার্টিতে ঢুকে পড়ল।
উনিশশো নব্বইয়ের দশকে এবং এই শতাব্দীর প্রথম দশকের গোড়ার দিকে বামফ্রন্টের প্রশাসন এবং তার নানান শাখাপ্রশাখা যে ধরনের মানসিকতা নিয়ে কাজকর্ম করছিল, তাতে কিছু লোকের মনে গভীর অসন্তোষ এবং বিরক্তি জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কোনও বিকল্প দেখছিলেন না। মন্দের ভাল হিসেবে তাঁরা বামফ্রন্টকে সমর্থন করছিলেন। জ্যোতি বসু তখনও বেঁচে। তাঁর সম্বন্ধে বাঙালির, বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজের মনে এক আশ্চর্য স্বপ্নালু মায়াবোধ ছিল। এখনও আছে।'
 |
| প্রকাশ কারাত, বিমান বসু, সীতারাম ইয়েচুরি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
শিল্প করতে হলে জমি লাগবে। আগে দলের নীচুতলার সাহায্যে মানুষের সঙ্গে কথা বলে উন্নয়নের কাজে জমি নেওয়া হয়েছে (উদাহরণ হিসেবে হলদিয়া পেট্রোকেমকে ঘিরে বিভিন্ন শিল্প বা ইএম বাইপাস তৈরির কথা বলা যায়)। কিন্তু বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক কায়দায় মানুষকে বলে দেওয়া হল শিল্পায়ন প্রক্রিয়া কোথায়, কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। তার পরিণতিতেই সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। উল্লেখ করছি ১৪ নভেম্বর, ২০০৭ আনন্দবাজারে প্রকাশিত অশোক মিত্রর লেখার কিছু অংশ। (মূল লেখাটি উদ্ধার করতে পারিনি। তাই ইংরেজি থেকে অনুবাদে বাধ্য হয়েছি।
.jpeg) |
| জ্যোতি বসুর বাসভবনে মমতা ব্যানার্জি, মাঝে ফিরহাদ হাকিম |
'দেশ ও রাজ্যের প্রবীণতম রাজনৈতিক নেতা (পড়ুন জ্যোতি বসু) মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সমাধানের কিছু রাস্তা নিয়ে আলোচনা করলেন। সরকারকে তা জানানো হল। কিন্তু তারা এগোল না। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ নেতা অশোক ঘোষ সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেন। শাসক দলের পরোক্ষ চাপে তা ভেস্তে গেল।...
.jpeg) |
| ফরওয়ার্ড ব্লক রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জি |
নন্দীগ্রামেই অবশ্য প্রথম রক্ত ঝরেনি। তার আগে সিঙ্গুর অধ্যায়ও আছে। বামফ্রন্ট সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা চায় না। বেসরকারি শিল্প তৈরিতে আগ্রহী। তাই দেশী-বিদেশী শিল্পপতিদের জন্য জমি অধিগ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হল। যেহেতু নির্বাচনী ইশতাহারে শিল্পায়নের কথা ছিল এবং তাঁরা ২৩৫ আসনে জিতেছেন, তাই প্রস্তুতির কোনও দরকারই ছিল না! হঠাত্ কৃষকদের বলা হল, জমি ছেড়ে দাও। প্রভুরা এখানে শিল্প গড়বেন। সরকার সিঙ্গুর থেকে সামান্য কিছু শিখলে নন্দীগ্রামে আরও সতর্ক হত। তা হল না। যথারীতি ঔদ্ধত্য।...
 |
| ভোট দিয়ে বেরিয়ে সপরিবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
সমস্যাটা শুধু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে নিয়েই না। সমস্যাটা আরও গভীর ও গুরুতর। বামফ্রন্টের বিরাট জয়ের পরে বছর দেড়েক কেটেছে। এটুকু সময়েই ঔদ্ধত্য আর নির্বুদ্ধিতার কত নজির তৈরি হয়ে গিয়েছে!
যে ভাবে হোক রাজ্যের সব গলিঘুঁজির দখল নিতে হবে। আমাদের ইচ্ছেয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান হবেন। আমাদের প্রার্থী হেরে গেলে বলব, অশুভ শক্তি জিতল। আমরা ওঁকে তাড়িয়ে ছাড়ব।
শুধু সাধারণ মানুষই নন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে পরামর্শ দিলেন অর্থনীতিবিদরাও। (ভাবা হল) ওঁরা তো বই পড়েন, সরকার চালানোর কী বোঝেন! প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, পার্টি কমরেড প্রভাত পট্টনায়েকও ছাড় পেলেন না।
আমরা সবজান্তা সরকার। ক্রিকেট-কবিতা-থিয়েটার-সিনেমা থেকে জমি অধিগ্রহণের ম্যাজিক, সব আমরা সব জানি। আমরা ২৩৫ আসন পেয়েছি।
...এর চেয়ে বেশি আসনে জিতলেও জ্যোতি বসু কখনও এই ঔদ্ধত্য দেখাননি।'
 |
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রণাম বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জির |
সিঙ্গুরের কথা ধরা যাক। অনিচ্ছুক কৃষকরা কী বলেছিলেন? তাঁরা জানতেন ওখানে কারখানা হলে জীবন বদলে যাবে। তাঁদের একটাই আপত্তি ছিল, সরকার কেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে জমি নিল না? অর্থাত্ আত্মসম্মানের প্রশ্ন। ১৯৭৭ পরবর্তী সময়ে যে আত্মসম্মান তাঁদের দিয়েছিল জ্যোতি বসুর সরকার। শিল্প গড়তে দেব না, এ কথা তো ছিল না। দাবি ছিল, রাস্তার উল্টো দিকের জমিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক কারখানা। কেন হল না? কার আপত্তিতে?
 |
| ব্রিগেড সমাবেশে প্রকাশ কারাত, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও সীতারাম ইয়েচুরি |
২০০৭ সালের ১১ মার্চ ব্রিগেডের সভায় বলেছিলেন, 'ওরা মাঠে নামছে। আমরাও নামব।…কার কী ক্ষমতা আছে দেখি এবার।…অতীতেও এমন অবস্থা হয়েছে। তবে এখন আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।' ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়েই সিঙ্গুরের কারখানা উল্টোদিকের জমিতে সরল না। মনে রাখা দরকার, শালবনীতে কারখানা তৈরির কাজে কিন্তু বাধা আসেনি। অর্থাৎ আন্দোলন শিল্পায়নের বিরুদ্ধে ছিল না। আদতে বামমনস্ক বাংলার আপত্তি ছিল শিল্পায়নের নামে বামরাস্তা ছাড়ার বিরুদ্ধে। (চলবে)