গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ১৩
 |
সিঙ্গুর সমস্যা নিয়ে রাজভবনে বৈঠকের পর মমতা ব্যানার্জি, পার্থ চ্যাটার্জি, রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ধাক্কায় দেশের বহু পুরোনো জমি অধিগ্রহণ আইন বদল হল। পরবর্তীতে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি বলল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভুল হয়েছে। কিন্তু এবার ভোটের আগেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললেন, 'নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে এখন শ্মশানের নীরবতা'-র কারণ বিরোধীদের 'কুটিল চিত্রনাট্য'। অর্থাৎ তাঁর বা তাঁদের কোনও ভুল ছিল না। দলের লোকেরা কেউ প্রশ্ন করলেন না, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত তবে ভুল ছিল? কোন রাজনৈতিক ভুল ছিল নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে?
 |
| বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও সূর্যকান্ত মিশ্র |
কী ভাবে, কার জন্য উন্নয়ন সেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই বামপন্থী মনোভাব। কিন্তু বাজার অর্থনীতির মডেল মেনে দেশী-বিদেশী শিল্পপতিদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন আনন্দবাজারের 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ'। স্থানীয় মানুষের আবেগকে পাত্তা না দিয়ে চরম ঔদ্ধত্য দেখালেন।
অশোক মিত্র লিখলেন, 'সিপিএম নেতৃত্ব লোভে অন্ধ হয়ে গেছেন। আর পার্টিও পরিণত হয়েছে সমাজবিরোধীদের দ্বারা চালিত তোষামুদে ও ভাঁড়েদের খোলা মাঠে।...সর্বস্তরে স্তাবকদের দাপট। দলীয় মাতব্বরদের বিক্রমে মানুষ একটু একটু করে সরে যাচ্ছেন। রাজ্যে দল থেকে গণতন্ত্র উধাও, শুধুই কেন্দ্রিকতার দাপাদাপি। নেতারা এসে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন, তাঁরা থামলে কেউ সাহসে ভর করে প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাইলে তাঁকে বকুনি দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়।'
 |
| সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। কলকাতায় নাগরিক মিছিল |
প্রবীণ কৃষক নেতা বিনয় কোঙার নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় নির্বিকার চিত্তে স্থানীয়দের 'লাইফ হেল' করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সিপিএমে হিরো হয়ে গেলেন।
 |
| বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, বিনয় কোঙার |
অশোক মিত্র লিখলেন, 'জ্যোতি বসুর জন্য কষ্ট হয়। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন তাঁর সঙ্গে আমরা চার মন্ত্রী শপথ নিয়েছিলাম। তাঁর বন্দী শাহজাহানের দশা দেখে বুক ফেটে যায়। বিভিন্ন সময়ে তিনি যে পরামর্শ দেন দলের রাজ্য নেতারা তা কানেও তোলেননি। কোনও কথা পছন্দ না হলে দলীয় মুখপত্রেও তাঁর কথা ছাপা হয় না।'
 |
| অনিল বিশ্বাস, শ্যামলী গুপ্ত, সুভাষ চক্রবর্তী, জ্যোতি বসু |
ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ের গতি ক্রমশ বাড়লেও বামফ্রন্ট সরকার টিকে থাকছিল। সেটা বদলাল ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে তুমুল জয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে। সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের উপর থেকে মানুষের ভরসা উবে গেল। জন্ম নিল সীমাহীন ঘৃণা। পরিণতি ২০১১। ৩৪ বছর পরে ক্ষমতাচ্যুত বামফ্রন্ট।ডঃ অশোক মিত্র বলেছিলেন, 'মানুষ বোকা নয়, তাঁরা সবই দেখেছেন, প্রথম দিকে নিঃশব্দে মেনে নিয়েছেন, তার পর এক সময় তিতিবিরক্ত হয়ে ভেবেছেন যে, ঢের হয়েছে, আর পারছি না। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, শালবনির পরে যেটা হল, লোকে মনে করল, যে-ই আসে আসুক, এদের আর নয়।'
(চলবে)