আগের পর্ব:
‘মিসটেক’, ঔদ্ধত্য ও বাঙালি বামপন্থা
রাজনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে অর্থনীতি। তাই পশ্চিমবঙ্গে কেন বামপন্থী বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত উবে গেল, তার কারণ খুঁজতে রাজ্যের অর্থনীতির অতীত-বর্তমানটাও দেখা দরকার।স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের সবচেয়ে ধনী রাজ্য। মাথাপিছু আয়ে ছিল দেশে এক নম্বর। সেই রাজ্য এখন ধুঁকছে। কথাটা আমাদের সবার জানা। কারণ হিসেবে আঙুল ওঠে রাজনীতির দিকে, বিশেষত বাম রাজনীতি ও বামফ্রন্ট সরকারের দিকে। এখনকার তৃণমূল সরকারের দিকেও আঙুল ওঠে। একটা ছোট্ট তথ্য জানাই। স্বাধীনতার সময় ১ নম্বরে থাকা পশ্চিমবঙ্গ ১৯৬৬ সালেই চলে যায় ৮ নম্বরে। তখনও তো বামফ্রন্ট সরকার হয়নি, এমনকি যুক্তফ্রন্ট সরকারও নয়। নকশালবাড়ির বজ্র নির্ঘোষ তখনও শোনা যায়নি। তৃণমূলের সরকার তো আরও অনেক পরের কাণ্ড। তদ্দিনে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মাত্র দু’জন-ডঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং প্রফুল্লচন্দ্র সেন।
তাহলে?
বৈষম্য ১
দেশভাগের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতের দুটি রাজ্য-পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাব। পঞ্জাবে উদ্বাস্তু সমস্যা মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকার দরাজ হাতে সাহায্য করলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে হাত উল্টে বসে ছিল।
১ ডিসেম্বর, ১৯৪৯। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে লেখেন,
‘...আপনার সম্ভবত ধারণা হয়েছে যে আপনার সরকার এই রাজ্যকে ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য হিসেবে দিয়েছে।...১৯৪৮-৪৯ এবং ১৯৪৯-৫০ কেন্দ্রীয় সরকার এই রাজ্যকে মোট তিন কোটি টাকা সাহায্য দিয়েছে। আর ঋণ পাঁচ কোটি টাকা।...১৬ লক্ষ উদ্বাস্তুর জন্য দু’বছরে মাথাপিছু কুড়ি টাকা...অনেক মনে হচ্ছে? পশ্চিম পাকিস্তানের খাতে দেওয়া সাহায্যের সঙ্গে তুলনা করার পরেও?’
বৈষম্যের কথা মেনেছিলেন নেহরু। তবে ওটুকুই। তার আগেই ১৬ অগাস্ট, ১৯৪৮ বিধানচন্দ্রকে লেখা চিঠিতে নেহরু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের মনোভাব,
‘...আগেও বলেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর মানুষ এ পারে চলে এলে সেই সমস্যার কোনও সমাধান নেই... আমি এখনও মনে করি, যে ভাবেই হোক, এই উদ্বাস্তুর স্রোত রোধ করা প্রয়োজন।’
তারপর ১৯৭১। তখনও আরেক দফা উদ্বাস্তুস্রোত আসে পশ্চিমবঙ্গে। বাবার রাস্তাতেই হাঁটেন ইন্দিরা।
বৈষম্য ২
স্বাধীনতার আগে দেশের আয়করের অংশ পাওয়ায় আর্থিক ভাবে এগিয়ে থাকা দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও অবিভক্ত বোম্বাই প্রদেশের (এখনকার মহারাষ্ট্র ও গুজরাত মিলিয়ে) ভাগ ছিল ২০% করে। স্বাধীনতার ঠিক পরেই পশ্চিমবঙ্গের ভাগ কমে হল ১২%, কিন্তু বোম্বাইয়ের বেড়ে হল ২১%। অথচ দুই প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল কমবেশি দুই কোটির কাছাকাছি। তার ওপর বিপুল উদ্বাস্তু আসায় আমাদের রাজ্যের জনঘনত্ব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়ে যায়। তবু ১৯৬১ সালে আয়কর বণ্টনের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ ছিল সবচেয়ে কম।
বৈষম্য ৩
পাটশিল্প ছিল বাংলার অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। পাট চাষ হত মূলত অখণ্ড বাংলার পূর্বাংশে। দেশভাগের পরে সেই অংশ চলে যায় বাংলাদেশে। ফলে পাটশিল্পে কাঁচামালের ঘাটতি তৈরি হয়। তার উপর দুনিয়াজুড়ে পাটের বিকল্প ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ায় বড়সড় ধাক্কা খায় রাজ্যের পাটশিল্প। আমদানী শুল্কের বাধা তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন দেশীয় শিল্পকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আশ্চর্যের হলেও সত্যি, বাংলার প্রধান দুই শিল্প চা ও পাটকে বাঁচাতে সেই সক্রিয়তা দেখা যায়নি।
অন্য দিকে, স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত পাটজাত শিল্পের রফতানি শুল্কের ৬২.৫% পেত উৎপাদনকারী রাজ্য, কেন্দ্র পেত ৩৭.৫%। স্বাধীনতার পরে ঠিক হল, কেন্দ্র পাবে ৮০% আর উৎপাদনকারী রাজ্য পাবে ২০%। পাটজাত শিল্পে আমাদের রাজ্যের কার্যত একচেটিয়া দখল ছিল। কাজেই এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি এবং বিপুল আর্থিক ক্ষতি হল বাংলারই।
বৈষম্য ৪
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বরাদ্দের দিকে চোখ রাখা যাক।
উপরের তালিকার সংখ্যাগুলোই বৈষম্য ও বঞ্চনার ছবিটা স্পষ্ট করছে। আর কোনও ব্যাখ্যা দরকার নেই।
বৈষম্য ৫
সবচেয়ে বড় ক্ষতি করল মাসুল সমীকরণ নীতি। সে সম্পর্কে আলোচনা করব পরের পর্বে।
সাংবাদিক রণজিৎ রায় ‘ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘১৭৫৭ সালে বাঙলায় ক্ষমতা দখলের পর ব্রিটিশরা তিন-চার দশক ধরে স্রেফ লুটের রাজত্ব চালিয়েছিল।... ১৯৪৭ সালের পর সেই সমস্ত ব্রিটিশ নীতিই প্রয়োগ করা হয়েছে পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে। এই রাজ্যগুলির উপরে তার ফলাফল হয়েছে বিধ্বংসী। লাভবান হয়েছে অন্যান্য অঞ্চলের সামান্য কয়েকটি সুবিধাভোগী রাজ্য, যারা একত্রিত হয়ে স্বাধীন ভারতের ক্ষমতাদণ্ড নিয়ন্ত্রিত করেছে।’
রাজনৈতিক স্বার্থে কিছু এলোমেলো কথা বলা নয়, যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে রাজ্যের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার কারণ খোঁজা প্রয়োজন।
রাজ্যের অর্থনীতির বিপর্যয় সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অমিতাভ গুপ্তের লেখাটি পড়তে পারেন। এখানে ক্লিক করুন।