২০২১ বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে বামপন্থীরা একটি আসনও পায়নি। ২০১৯ লোকসভা ভোটেও তাই। এক সময় দেশের বাম-দুর্গ বলে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গে কেন এই অবস্থা হল বামপন্থীদের? সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি পাওয়া দরকার বিলক্ষণ। বামপন্থা মানে তো নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করা কিছু পার্টি আর তার নেতা-কর্মীরা নন। বামপন্থী মানে তো বামফ্রন্টের বিভিন্ন দল, নকশালপন্থী বিভিন্ন দল, এসইউসিআই ইত্যাদি নয়। বামপন্থা একটি ধারণা, যা ছাড়া সভ্যতা অচল। বামপন্থা মানে যা কিছু প্রচলিত তাকে চ্যালেঞ্জ করা। বামপন্থা মানে সুখী-সুন্দর সমাজের লক্ষ্যে বিকল্প রাস্তার খোঁজ।
সত্যি কথা বলতে, খুব বেশি বইপত্র আমার পড়া নেই। জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। খালি চোখে দেখে যেটুকু বুঝি, সেটাই বলার চেষ্টা করছি মাত্র। চেষ্টা করব, যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে কথা বলার। আর একটা কথা স্পষ্ট করেই বলছি, কোনও রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে আঘাত করার কোনও মতলব আমার নেই।
‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’ থেকে ‘আমরা ০...’ হতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ বছর। ২০১১ থেকে ২০২১। ভোটে অনেক দলই হারে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে উবে যায় না। কিন্তু এরাজ্যে সরকারে থাকা বামপন্থী দলগুলোর ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের কথায়,
বামপন্থীরা এমন একটা মার খেলেন-স্বাধীনতার পর থেকে কখনও এমন হয়নি যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলের এক জনও এমএলএ নেই-এটা কী করে সম্ভব হল? আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি, যেখানে একশো বছর ধরে নানা দিক দিয়ে বাম চিন্তা এসেছে, সেখানে এই পরিণতির পিছনে কতটা ভুল আছে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার খুব বড় কারণ আছে।
কোন সময় এই বিপর্যয়? অধ্যাপক প্রণব বর্ধনের কথায় স্পষ্ট পরিস্থিতির গভীরতা, সময়ের বিপন্নতা।
সমস্ত ভারতবর্ষে যা ঘটছে, এই দক্ষিণপন্থী ও মৌলবাদীদের রমরমা, তাতে একটা প্রতিরোধের দরকার...। সেই জন্যে বাম সংগঠনের পুনরুজ্জীবনের ভীষণ প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে তো বিশেষ করে।
সেজন্য সবচেয়ে আগে দরকার আয়নায় মুখ দেখা।কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সিপিএম-সহ বামপন্থী বলে পরিচিত সংসদীয় ধারার দলগুলোর নেতারা নিজেদের দিকে তাকানোর বদলে, ‘ষড়যন্ত্র’, ‘মানুষের না-বোঝা’ ইত্যাদিকেই কারণ চিহ্নিত করেছেন এবং করেই চলেছেন। 'আমাদের কিছু ভুল ছিল, কিন্তু আমরা তৃণমূলের চেয়ে ভাল', 'আমরা সৎ তাই ভোট পাই না'-এরকম মনোভাব নিয়েই চলতে চান এবং চলছেন। তাঁদের মনোভাব হল, আমরা সবই ঠিক করেছি। আবার ক্ষমতায় এলে সেই কাজই করব। মানুষ ভুল করেছেন।
ভিন্ন মত শুনলে ভেবে দেখার বদলে রে রে করে তেড়ে যান, এর-ওর-তার 'দালাল' দেগে দেন। (এই সংস্কৃতিটা সরকারে থাকার সময়ও ছিল। এটা কি মার্কসবাদীদের সাধারণ সমস্যা?)
সরকার চালানো বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলোর নেতারা মনে করেন, আদর্শগত বা রাজনৈতিক নয়, কিছু সাংগঠনিক ভুলেই এই অবস্থা। সেই সব সাংগঠনিক সমস্যা কাটিয়ে ফেলতে পারলেই তাঁরা ফের স্বমহিমায় আবির্ভূত হতে পারবেন। সেই সাংগঠনিক ভুল মেরামতের চেষ্টা করতে করতে আরও দুর্বল হয়ে পড়েন ক্রমশ।
অধ্যাপক প্রণব বর্ধনের কথায়,
চিন্তা করার কথা বললেই বামপন্থী নেতারা দুটো জিনিস বলেন। একটা হল, আমাদের কিছু কিছু কৌশলগত অ্যালায়েন্স করতে হবে, দেখতে হবে কার সঙ্গে জোটা যায় ইত্যাদি। আর বলেন, তৃণমূলের সন্ত্রাস। আর হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই বলেন, আমাদের কিছু ভুল হয়েছিল। কিন্তু জনসাধারণের কাছে পরিষ্কার নয়, ভুলটা ঠিক কী। জনসমক্ষে বলা উচিত, এই এই ভুল হয়েছিল। এটা বলেও লাভ নেই যে, সেই সব ভুল নিয়ে পার্টির ভেতর আলোচনা হচ্ছে। ও সব ছেঁদো কথা আর কেউ শুনতে চায় না। সব কিছু খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে, বিচার করতে হবে। বামপন্থী নেতাদের ওই ‘ভুল হয়েছিল’ শুনলে আমার ‘সোনার কেল্লা’-র সেই বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে, দুষ্টু লোকেরা যাকে ভুল করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের কাহিনি শোনাতে গিয়ে সে বলেছিল, ‘মিসটেক, মিসটেক’! মাঝে মাঝে মনে হয়, এঁরাও যেন মাথা নেড়ে বলছেন, ‘মিসটেক, মিসটেক’।
রাজ্যের বামপন্থী বলে পরিচিত নেতাদের ভাবগতিক দেখে ‘জলসাঘর’ সিনেমার বিশ্বম্ভর রায়ের কথা মনে পড়ে। জমিদারি ডুবে গেছে কিন্তু বিশ্বম্ভরদের জমিদারি গুমর যায়নি। তেমনই পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী বলে পরিচিত নেতাদের রাজত্ব গেলেও ঔদ্ধত্য যায়নি। সর্বজ্ঞ ভাবটাও যায়নি।
কোনও বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির ভাল-খারাপ নির্ভর করে তার আদর্শগত ও রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর। কিছু সাংগঠনিক সমস্যার কথা বলে তা আড়াল করা অপরাধ। মতাদর্শ ও রাজনীতিতে ভুল থাকলে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বড়সড় সমস্যা তৈরি হয়। নেতা-কর্মীদের মধ্যে গোলমেলে নানা ধারণা ও অভ্যাস গড়ে ওঠে। সময়কে বুঝে নিয়ে সময়ে সময়ে আদর্শগত ও রাজনৈতিক অবস্থান বদলাতেও হয়। সে সব না করে শুধু চুলের রং বদলে সমস্যা মেটে না। সমস্যাটা নেতাদের চুলের রঙে নাকি বুড়ো হয়ে যাওয়া ধারণার সাদা চুলে সেটা ভাবা দরকার।
চৈতন্য-বিদ্যাসাগর-রামমোহন-লালন ফকির-হরিচাঁদ গুরুচাঁদ-ডিরোজিও-রেনেসাঁ-সিপাহী বিদ্রোহ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুভাষচন্দ্র- সূর্য সেন-বেগম রোকেয়া-সাঁওতাল বিদ্রোহ-তিতুমীর-স্বাধীনতা সংগ্রাম-তেভাগা-ভাষা আন্দোলন, নানা ঘটনার প্রভাবে বাংলার মন ক্রমশ বামপন্থী হয়েছে। রম্যলেখক হিসেবে পরিচিত শিবরাম চক্রবর্তীর ‘মস্কো থেকে পণ্ডীচেরী’ বইটি পড়লে টের পাওয়া যাবে সেই উনিশশো কুড়ির দশকেও বাংলার মন কতটা বামপন্থী ছিল। পরবর্তীতে তেভাগা আন্দোলন-খাদ্য আন্দোলন-জমির আন্দোলন-উদ্বাস্তু আন্দোলন তাকে আরও পোক্ত করেছে। নকশালপন্থী আন্দোলন তো সারা দুনিয়ার নজর টেনেছিল।
গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা ও বহুমাত্রিকতার উপর গড়ে ওঠা বাঙালি-বামপন্থার মাঠটা কিন্তু পার্টিতান্ত্রিক বামপন্থার চেয়ে অনেকটাই বড়। কোনও রাজনৈতিক দলের হাত ধরে এই বামপন্থার মাঠ তৈরি হয়নি। বরঞ্চ ওই মাঠ চষে ফসল তুলেছে কিছু রাজনৈতিক দল। ‘আমরা, শুধুমাত্র আমরাই সঠিক ও সেরা’-এই দলতান্ত্রিক বামপন্থার চশমা পড়ে বাঙালি-বামপন্থার চরিত্র বোঝা অসম্ভব।
২. বামপন্থী বলে চিৎকার করা মানুষগুলোর দরিদ্র মানুষদের থেকে দূরে চলে গিয়ে আক্ষরিক অর্থে পুঁজিপতিদের প্রতি প্রেমের টান।