স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরা |
এই লেখা পড়ার আগে, পূর্ববর্তী পর্ব বাংলাকে ডুবিয়েছে জঙ্গি আন্দোলন? পড়ে নিলে ভাল হয়
পরিযায়ী শ্রমিক। করোনার ধাক্কায় লকডাউনের সময় শব্দটার সঙ্গে আমাদের অনেকের পরিচয় হয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতির বিবর্ণ একটা ছবি। কোন কোন রাজ্য থেকে বেশি পরিযায়ী শ্রমিক ছিল? উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, ছত্তিসগড়। স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন উত্তরপ্রদেশ থেকে। তবু দেশের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি হল উত্তরপ্রদেশ। তা থেকে স্পষ্ট হওয়া উচিত, উন্নয়ন নেহাতই রাজনৈতিক বিষয় নয়। এতে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোই প্রধান।
তালিকায় থাকা রাজ্যগুলোর দিকে আরেকবার চোখ রাখ যাক। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওডিশা-মানে পূর্ব ভারতের সব রাজ্য। আর পাশের মধ্যপ্রদেশ। সব কটি রাজ্যই খনিজ সম্পদে ঠাসা। সেই রাজ্যগুলোর পিছিয়ে পড়ার এক ও একমাত্র কারণ ১৯৫২ সালে জওহরলাল নেহরু সরকারের চালু করা মাসুল সমীকরণ নীতি।
সংক্ষেপে বলতে গেল, প্রধান খনিজ সম্পদ ও ইস্পাত পরিবহণের খরচ এক হয়ে যায়। ‘ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’ বইয়ের লেখক রণজিৎ রায় একটা হিসেব দিয়েছেন।
১৯৭০ সালের হিসেবে জামশেদপুর থেকে হাওড়া ও বোম্বাই পর্যন্ত ১ টন ইস্পাত আনার ভাড়া ছিল যথাক্রমে ৩০ টাকা এবং ১২০ টাকা। তার মানে জামশেদপুর থেকে ওই দুই শহরে ২ টন ইস্পাত নিয়ে যাওয়ার মোট ভাড়া ছিল ১৫০ টাকা। মাসুল সমীকরণ নীতির জেরে কলকাতা ও বোম্বের খরিদ্দার একই ভাড়া দেবেন। মানে দুজনই দেবেন ৭৫ টাকা করে। একজন শিল্পপতি কলকাতায় ইস্পাত ব্যবহার করে শিল্প করলে বোম্বের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রতি টনে ৯০ টাকা করে অবস্থানগত সুবিধা পেতেন। মাসুল সমীকরণ নীতিতে কলকাতার সেই সুবিধা তো চলেই গেল। উল্টে এখানকার শিল্পপতিকে বোম্বের শিল্পপতির জন্য প্রতি টনে ৪৫ টাকা করে ভর্তুকি দিতে বাধ্য করা হল। কয়লার ক্ষেত্রেও তাই।
এরপর নির্বোধ না হলে কোনও শিল্পপতি পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে শিল্প গড়তে আসবেন? সমুদ্র পরিবহণের সুবিধা দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলোয় অনেক বেশি।
পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিল্পোন্নত ছিল পশ্চিমবঙ্গ। মাসুল সমীকরণ নীতির সবচেয়ে বড় ধাক্কাও লাগল এই রাজ্যেরই। মুখ থুবড়ে পড়ল এখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। আগের পর্বে আমাদের রাজ্যের আর দুই প্রধান শিল্প পাট ও চা কেন ও কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা বলার চেষ্টা করেছি।
পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে ইস্পাত, কয়লা ইত্যাদি একই পরিবহণ খরচে দেশের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলেও, তুলা বা তৈলবীজের ক্ষেত্রে ওই নীতি থাকল না। সেগুলো কিনতে অতিরিক্ত মাসুল গুণতে হত।
নেহরুর যুক্তি ছিল, পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোকে এগিয়ে দিতেই এই নীতি। বাস্তবে দেখা গেল, এই নীতিতে সবচেয়ে বেশ লাভবান হয়েছে পশ্চিম ভারতের দুই রাজ্য মহারাষ্ট্র ও গুজরাত, যে দুই রাজ্য মিলে ছিল শিল্পোন্নত অবিভক্ত বোম্বে প্রদেশ। মাসুল সমীকরণ নীতিতে উপকৃত হয়েছে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোও। আজকের শিল্পোন্নত রাজ্যগুলোর তালিকা দেখলেই সেটা স্পষ্ট হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পূর্ব ও মধ্য ভারতের রাজ্যগুলোর অবস্থার দিকে।
এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা অপরাধ।
শিল্পক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের পিছিয়ে পড়ার আরেকটা কারণ হল লাইসেন্স নীতি। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত নতুন শিল্প তৈরিতে কেন্দ্রের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক ছিল। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে তীব্র বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।
১৯৫৬-’৬৭ মহারাষ্ট্র পায় ২৭৪১ লাইসেন্স আর পশ্চিমবঙ্গ ১৬৪৯। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হয়েছিল ৪০টি লাইসেন্স। আর মহারাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছিল ১৫০টি।
ফিলিপস কলকাতার কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর অনুমতি চায়। কিন্তু বিদেশি কোম্পানি বলে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ পুনেতে সেই অনুমতি দেওয়া হয়।
হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস তৈরির অনুমতি দিয়েছিল মোরারজি দেশাই সরকার। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর জানিয়ে দেয়, কেন্দ্র বা কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ওই প্রকল্পে থাকবে না। এমনকি সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিপদের অজুহাতে অনুমতিও আটকে দেওয়া হয়। সেই সময় গুজরাতে পেট্রোকেমিক্যালস কারখানা তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। সীমান্তবর্তী রাজ্যের বাহানায় সন্টলেক ইলেকট্রনিক্স তৈরির অনুমতিও আটকে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ না পাকিস্তান, ভারতের নিরাপত্তায় প্রধান বিপদ কে, সেটা সবার জানা। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গে প্রতিরক্ষাগত সমস্যার অজুহাতে কারখানা তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু পাকিস্তান সীমান্তের কাছে থাকা গুজরাতে সেই অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়।
গার্ডেনরিচে সিইএসসি-র বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিতে ১২ বছর সময় নেয় কেন্দ্রীয় সরকার।
এরকম উদাহরণ আরও অনেক আছে। এই সত্যকে আড়াল করা অপরাধ।
এসব কারণকে দূরে ঠেলে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়নের ধাক্কাতেই রাজ্য থেকে শিল্প বিদায় নিয়েছে। কিন্তু জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুরুর অনেক আগে থেকেই তো আমাদের রাজ্য শিল্পে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে।
কোনও সন্দেহ নেই, ১৯৬৫-৭৫ সময়কালে রাজ্যে কাজের সুযোগ যত কমেছে, ততই শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। তার সঙ্গে খাদ্য সংকট, নকশালবাড়ি আন্দোলন। তারপর বামফ্রন্ট সরকার। এই সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে শিল্পক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে। কিন্তু সেটাই রাজ্যে শিল্পের সর্বনাশের প্রধান কারণ হলে, মহারাষ্ট্রে শিল্পক্ষেত্র উঠে যেত। সেখানে শ্রমিক আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, হরতালটাই এক সময় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে শেষ করতে কংগ্রেসের পরিকল্পনায় বাল ঠাকরে মারকুটে, খুনে শ্রমিক আন্দোলন চালাতেন সেখানে। মহারাষ্ট্র কিন্তু শিল্পে এগিয়েছে গড়গড় করে।
আসলে শ্রমিক আন্দোলনকে কাঠগড়ায় তোলা মূল সমস্যাকে আড়াল করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার লড়াইকে দুর্বল করার ছক। ধর্মঘট শ্রমিকদের একটি অস্ত্র। এই অস্ত্রের যাচ্ছেতাই রকমের উপব্যবহার হয়েছে। তা বলে অস্ত্র বাতিলের পক্ষে সওয়াল তো শ্রমিকের অধিকারের বিরুদ্ধে।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বড় গলা করে বারবার বলেন, তিনি বনধ বা ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। তাঁর পূর্বসূরী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমি এমন একটা দলে আছি যারা বনধ ডাকে, ধর্মঘট করে৷’ ঠিক এটাই বোঝান হয় কর্পোরেট পুঁজি ও মিডিয়ার তরফে। মজার কথা, ওই দুই মুখ্যমন্ত্রীর আমলে সরকার ও বেসরকারি ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার আসল কারণগুলো দু দফায় বলার চেষ্টা করেছি। তাকে আড়াল করে বুদ্ধ-মমতার চটকের টি-২০ রাজনীতি আসলে অপরাধ, রাজ্যের মানুষের সঙ্গে জেনেবুঝে করা প্রতারণা।