সুনীল ছেত্রীকে নিয়ে তৈরি ফিফা ডকুমেন্টারির ঘোষণা |
অফিস থেকে ফিরছি। বাসে একটি কমবয়সী ছেলে পাশে বসা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন।
-মোদীর কামাল দেখেছিস? সব দেশকে নিয়ে কী একটা আছে না, বিশ্বসংঘ নাকি যেন, মোদী তার প্রধান হয়েছে। ভারতকে কে ঠেকায়?
পরে আরও দিন তিনেক বাসে আসতে আসতে একই কথা শুনেছি অন্য তিনটি ছেলের মুখেও। তিন জনই কম বয়সী।
চারটি ছেলেই পার্ক সার্কাসে নেমে ট্রেন ধরে। মানে থাকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোনও জায়গায়। প্রচারটা কোণায় কোণায় থাকা মানুষের মনের কোন কোণায় পৌঁছে গেছে!
মনের মধ্যে ঘুরছে ছেলে চারটের কথা। আর ভীষণ রাগ হচ্ছে। চোখ টিভির পর্দায়। বিশ্বকাপ ফুটবলের (FIFA World Cup 2022) খেলা চলছে। স্পেন বনাম জাপান। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছনোর আশায় থরথর করে কাঁপছে গ্যালারিতে থাকা সামুরাই ব্রিগেড।
আমরা ভারতের মানুষও থরথর করে কাঁপছি। সুপার পাওয়ার হওয়ার নেশা ধরিয়ে আমাদের থরথর করে কাঁপানো হচ্ছে। মোদীর কামাল দেখেছ!
১ ডিসেম্বর, ২০২২ থেকে G-20 সভাপতি হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। নিয়ম হল, G-20-র সভাপতি প্রতি বছর বদলায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সভাপতি হন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রধানরা। সভাপতিত্ব কাল শেষে G-20 শীর্ষ বৈঠক হয় সেই দেশেই। সেই নিয়মেই বালিতে G-20 শীর্ষ সম্মেলনে মোদীর হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট। সেই নিয়মেই পরের G-20 শীর্ষ বৈঠক হবে আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর দিল্লির প্রগতি ময়দানে। নিয়ম অনুযায়ী সেখানে পরবর্তী সভাপতি ব্রাজিলের লুলা দ্য সিলভার হাতে দায়িত্ব তুলে দেবেন বিদায়ী সভাপতি মোদী। অর্থাত্ কোনও দেশের প্রধান G-20 সভাপতি হয়েছেন মানে দুনিয়ায় সেই দেশের প্রভাব বেড়েছে,, তা নয়। অথচ সেটাই গেলানোর চেষ্টা হচ্ছে।
G-4, G-5, G-6, G-7 হয়ে ১৯৯৯ সালে তৈরি হয় G-20 (আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স, জাপান, কানাডাকে নিয়ে তৈরি G-7 অবশ্য এখনও আছে)। বিভিন্ন আর্থিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য তৈরি এইসব আন্তর্জাতিক মঞ্চ। ২০০৯ সাল থেকে G-20 দুনিয়ায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার সদস্য দেশগুলো হল আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক। G-20-র প্রথম ও তৃতীয় সভাপতি হয়েছিলেন আমেরিকার দুই প্রেসিডেন্ট। তারপর থেকে সব সদস্য দেশ একবার করে সুযোগ পেয়েছে। এবার ভারত, পরের বার ব্রাজিল, তারপর দক্ষিণ আফ্রিকা। তাহলেই সব সদস্য দেশ একবার করে সভাপতি হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।
জার্মানির পর স্পেনকেও হারিয়ে দিল জাপান। গ্রুপ শীর্ষে থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষ ষোলোয় পৌঁছে গেল ৬৮৫২ দ্বীপ নিয়ে তৈরি ১৩ কোটি মানুষের দেশ জাপান। ১৩৫ কোটি মানুষের দেশ ভারত ১০০ সৌধে আলো জ্বালছে প্রধানমন্ত্রী G-20 সভাপতি হওয়ার উদযাপনে। এই হুজুগটা তুলে ২০২৪ লোকসভা ভোটে ফয়দা লোটার ছক সাজাতে গোপন বৈঠকও করে ফেলেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। বছরভর নানা কর্মসূচি সম্পর্কে সর্বদল বৈঠকও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেখুন, মোদীর নেতৃত্বে ভারত কেমন সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছে! দেশভক্তি পাবলিক খায় ভাল। তাই দেশভক্তির হুজুগটা বারবার তোলা হয়। ঘরে ভোটের বাদ্যি বাজলেই সীমান্তে বেজে উঠত যুদ্ধের বাদ্যি, কংগ্রেস জমানায়-বাজপেয়ী জমানায়। এখন ছক বদলে গেছে। কখনও সমীক্ষার রিপোর্ট দেখানো হয়, দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদী। কখনও বলা হয়, দেখুন, মোদীর নেতৃত্বে ভারত কেমন দুনিয়ার পঞ্চম শক্তিশালী অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। এক ভারতীয় (গৌতম আদানি) কেমন দুনিয়ার দুই বা তিন নম্বর ধনী হয়ে উঠেছেন। মোদীর ভারত কেমন পাকিস্তান বা চিনকে কথায় কথায় টাইট দিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আরও ৬ ধাপ পিছিয়ে ভারত ১২১টি দেশের মধ্যে এখন ১০৭। চিন প্রথম ১৭ দেশের মধ্যে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল ও মায়ানমার যথাক্রমে ৯৯, ৬৪, ৮৪, ৮১ ও ৭১ নম্বরে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পিছনে শুধু তালিবানের হাতে থাকা আফগানিস্তান।
বিশ্বকাপ ২০২২। শেষ ষোলোয় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া |
১৯৫০-৬০ দশকে ফুটবলে এশিয়ার সেরা দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল ভারত। জাপানের ফুটবল তখন হামাগুড়ি দিচ্ছে। সবে হাঁটতে শিখছে দক্ষিণ কোরিয়া। এবারের বিশ্বকাপে ডেনমার্কের পর পর্তুগালকে হারিয়ে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে গেছে সওয়া ৫ কোটি মানুষের দেশটি। তারাই বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে যাওয়া এশিয়ার একমাত্র দেশ (২০০২ বিশ্বকাপে)। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম বার এশিয়ার (এএফসি-র অন্তর্গত) তিন দেশ (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া) শেষ ষোলোয় পৌঁছল।
কাতারের মাঠে বা জায়ান্ট স্ক্রিনে বা টিভি বা মোবাইলের পর্দায় কোটি কোটি ভারতীয় স্রেফ বিশ্বকাপের দর্শক। খেলা দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস, ছোট ছোট কত দেশ খেলছে, আমরা যে কবে খেলব! প্রতি চার বছর অন্তর এটাই হয়ে আসছে।
নো চিন্তা, ডু ফুর্তি! গুজরাতের মন্ত্রী হর্ষ সাঙ্ঘভির কথা শুনেছেন? ‘আমি তো প্রতিদিন নিয়ম করে ১০০৮ বার মোদী মোদী জপ করি। আপনারাও করুন। জীবনে সাফল্য আসবে।’ এআইএফএফ প্রেসিডেন্ট কল্যাণ চৌবের কাজ কত কমে গেল! সুনীল ছেত্রীরা দিনে ১০০৮ বার মোদী-নাম জপ করলেই কেল্লা ফতে। ২০১৫ সালে ফিফার তালিকায় ভারত ছিল ১৭৩ নম্বরে। এখন ১০৬। উন্নতি হয়নি? ছি-ছি করলেই হল! কাজ নেই, কম্ম নেই, শুধু হাহুতাশ!
মোদীর নামগান করতে রাজি না হলে অসুবিধা নেই। মমতা কম্পার্টমেন্টাল মুখ্যমন্ত্রী নাকি শুভেন্দু আরএসি বিরোধী দলনেতা, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করুন। কিংবা কার সঙ্গে কার সেটিং? মোদী-মমতা নাকি রাম-বাম নাকি ফিস ফ্রাই সেটিং নাকি তৃণমূল+কংগ্রেস? এসব ভারী গভীর চিন্তার বিষয়। ভারত কেন বিশ্বকাপের ধারেকাছে পৌঁছতে পারছে না, ফুটবলের মক্কা নামে পরিচিত কলকাতার ফুটবল কেন গোল্য়লায় গেল, সে সব স্রেফ ছেলেমানুষী চিন্তা।
হিঙ্গলগঞ্জের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তিনি গরম জামাকাপড় কিনে এনেছিলেন কিন্তু মঞ্চে আনা হয়নি। ১৭ মিনিট পরে বিডিও অফিস থেকে গরম জামাকাপড়, কম্বল এলো। তিনি বিলি করলেন। পরদিনই শুভেন্দু অধিকারী সরকারি বিজ্ঞপ্তি ফাঁস করে দিলেন। মমতার টাকায় নয়, ওই গরম জামাকাপড় কেনা হয়েছে সরকারি টাকায়। ওই অনুষ্ঠানে গরম জামা বিলির কথাই ছিল না। পরে বিডিওদের বিলি করার কথা। তাই সেগুলো ছিল বিডিও অফিসে। সেখান থেকে আনিয়ে বিলি করে মমতা বাহাদুরি দেখালেন।
সাধারণ মানুষের এসব ভাবার বা জানার কথা নয়। ভাবেনও না, জানেনও না। প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী বা নেতাদের উপর বহু মানুষের অন্ধ বিশ্বাস, প্রশ্নহীন আনুগত্য, ভরসা। সেই নেতারা জেনেবুঝে তাঁদের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি করছেন। সেই নেতারা বাংলার ফুটবল, ভারতের ফুটবলের উন্নতির কথা ভাববেন? শুধু ফুটবল কেন, কোনও খেলার উন্নতির জন্য তাঁদের কোনও ভূমিকা আছে? কেউ নিজের চেষ্টায় সফল হলে, পদক জিতলে, তাঁদের বদলে আলো নিজেদের উপর ফেলার চেষ্টা আছে।
বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থা কব্জা করার চেষ্টাতেও কোনও ঘাটতি নেই। সৌরভ গাঙ্গুলির সিএবি সভাপতি হওয়ার কথা নবান্ন থেকে ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সৌরভ আচমকা উড়ে এসে ব্রিজেশ প্যাটেলকে সাইডলাইনের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বোর্ড সভাপতি হয়ে গেলেন। আবার এক বছর পর সরে গেলেন। বসানো হল এবং সরিয়ে দেওয়া হল বলাটাই ভাল। কিন্তু অমিত শাহের ছেলে সচিব ছিলেন ও থাকলেন। আড়ালে কী হল সেটা স্পষ্ট করে কেউ না বলে দিলেও সবাই বুঝলেন।
ক্রিকেট ভারতের ধর্মে পরিণত হয়েছে। কপিলদেবের হাতে বিশ্বকাপ ছিল সূচনা। বেটিং ধাক্কায় ভেঙে পড়তে বসা ভারতীয় ক্রিকেট মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ক্যাপ্টেন সৌরভের হাত ধরে। এসব তো মাঠের গল্প। মাঠের বাইরে নীরবে জমি তৈরি করে গেছেন জগমোহন ডালমিয়া, রাজ সিং দুঙ্গারপুর, এন কে পি সালভে, আই এস বিন্দ্রাদের মতো একের পর এক ক্রীড়া প্রশাসক। সরকার নাক গলায়নি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না। প্রয়োজন মত সরকারি সাহায্যও জুটেছে।
এখন জমি তৈরি। নতুন নতুন প্রতিভা উঠে আসা এখন জলভাত। বানিজ্য সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইপিএল নতুন নতুন প্রতিভার বিশ্ব পরিচিতির মুক্তাঙ্গন, বিভিন্ন দেশের সেরা খেলোয়াড়দেরও আকর্ষণ। তাই ক্রিকেটকে ঘিরে ক্ষমতাধরদের এতো আকর্ষণ।
এক সময় দুনিয়াদারি করা ভারতীয় হকির কী হাল? খেলরত্ন পুরস্কার থেকে রাজীব গান্ধীর নাম মুছতে ধ্যানচাঁদকে টেনে এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওই পর্যন্তই। আর ফুটবল?
আইএসএল |
ফেডারেশন কাপ বদলে সুপার কাপ (Super Cup)। সেটা বদলে আই লিগ (I League)। তারপর আইএসএল (ISL)। দেশের এক নম্বর টুর্নামেন্ট কোনটা? হঠাৎ হঠাৎ পাল্টে যায়। এখন আইএসএল সর্বস্ব। তৃণমূল স্তর থেকে নতুন প্রতিভা তুলে আনার পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো কোথায়?
এক সময় নেহরু কাপ নামে খুব দামী একটি টুর্নামেন্ট হত। বিভিন্ন দেশ খেলতে আসত। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ী মারাদোনার আর্জেন্টিনা দলের কোচ ছিলেন কার্লোস বিলার্দো (Carlos Bilardo)। বিলার্দোই ছিলেন ১৯৮৪ সালে নেহরু কাপ খেলতে আসা আর্জেন্টিনা দলের কোচ। সেবার ট্রফি জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা। যাওয়ার আগে এআইএফএফ সচিব অশোক ঘোষকে বলে যান, ‘পরের বার আমাদের ডাকবেন। এই ট্রফিটা আমাদের জিততেই হবে।’ টাটকা বিশ্বকাপাররাও খেলতেন নেহরু কাপে।
নেহরু কাপের সুফল পাচ্ছিল ভারতীয় ফুটবল। কিন্তু সেই টুর্নামেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হল। জিয়াউদ্দিন-অশোক ঘোষ জুটির সময় তুঙ্গে ওঠা এআইএফএফ-কে এখন ফিফা-র সাসপেনশনের মুখে পড়তে হয়। সরকার কতটা সিরিয়াস, ফেডারেশন কতটা সিরিয়াস, তাতেই বোঝা যায়।
কলকাতাকে বলা হত ‘ভারতীয় ফুটবলের মক্কা।’ সেখানে কী অবস্থা এখন? কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ড? এক সময় সারা দেশ থেকে তারকারা আসতেন কলকাতায়। ভারতীয় দল থাকাত বাংলার ফুটবলারে ভর্তি। আর এখন? এখন বাংলায় বাঙালির প্রিয় ফুটবলের অস্তিত্ব মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ডার্বির বাইরে কতটা আছে? এসব চিন্তা আছে ক্লাবগুলো আলো করে বসে থাকা রাজনীতির পান্ডাদের?
ফুটবলে বিনিয়োগ কিন্তু খারাপ আসছে না। দরকার ফেডারেশনের পেশাদারি মনোভাব। দরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা (জে লিগকে হাতিয়ার করে জাপান ফুটবলের ৩০ বছরের উদাহরণ ভেবে দেখা যেতে পারে)। আর চাই চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অনেক অশোক ঘোষ-জীবন-পল্টু-টুটু বোসদের মত নিখাদ খেলাপাগল ক্রীড়া প্রশাসককে সামনের সারিতে তুলে আনা।
আবেগ ছাড়া খেলা হয়? ফুটবল তো হয়ই না।