link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

আম আদমি পার্টির মডেল কাজে লাগতে পারে দেশে ও রাজ্যে #Politics-of-Religion-Caste-and-AAP

বিতর্কিত ‘পাঠান’

ভোটকাটুয়া। বিজেপি-র বি টিম।
ভারতের প্রচলিত রাজনীতিতে এই দুটো উপাধি জোগাড় করে ফেলেছে আম আদমি পার্টি (আপ)।
কেন জানি না আমার এই উপাধিগুলোকে অক্ষমের আর্তনাদ বলে মনে হয় বরাবর।
এক সময় মমতা কংগ্রেসকে বলতেন সিপিএমের বি-টিম। তাঁর কাছে, সুব্রত মুখার্জি ছিলেন তরমুজ (বাইরে সবুজ মানে কংগ্রেস, ভিতরে লাল মানে সিপিএম)। পরে অবশ্য সুব্রত যান মমতার তৃণমূলে। 
আমাদের রাজ্যের এবং দেশের রাজনীতিতেও দোস্তি, কিন্তু কেরলে কংগ্রেস সিপিএম-কে বলে বিজেপি-র বি টিম।
এখন তো আমাদের রাজ্যে কে যে কার বি-টিম বোঝাই মুশিকল। সিপিএম মমতাকে বলে বিজেপি-র বি টিম। যদিও গত বছরের পঞ্চায়েত ভোটের মত এবার কয়েকটি সমবায়ের নির্বাচনে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়েছে সিপিএম। কোথাও আবার সমবায়ে লড়াই তৃণমূল+কংগ্রেস বনাম বিজেপি+সিপিএম। সিপিএম রাজ্য কমিটির সভায় বিভিন্ন জেলার নেতারা জানিয়েছেন, এবারের পঞ্চায়েত ভোটে নীচু তলার কর্মীরা তৃণমূল বিরোধী মহাজোট বানিয়ে লড়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। 
উল্টোদিকে দিল্লি বিধানসভা ও পুরভোটে লড়াই হল বিজেপি বনাম আপ। দুই ক্ষেত্রেই আপ জয়ী। সেই আপ-ই নাকি গুজরাতে বিজেপি-র বি টিম, মানে কংগ্রেসের ভোট কেটে বিজেপি-কে সাহায্য করেছে! ২০১৭ বিধানসভা ভোটে গুজরাতে রাহুল গান্ধী প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিলেন। কংগ্রেস হাতে গরম ফলও পেয়েছিল। এবার? রাহুল ব্যস্ত থাকলেন ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রায়। অনেক টানাটানির পর গুজরাতে মাত্র দুটো সভা করেছেন। প্রশ্নটা তো স্বাভাবিক, কংগ্রেস কি সত্যি গুজরাতের ভোটে লড়াই চেয়েছিল? মোহনসিন রাথওয়া, হার্দিক প্যাটেল, অল্পেশ ঠাকোরদের মত নেতারা ভোটের আগেই কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি-তে চলে যান। তারপর ভোটে ম্যারমেরে লড়াই। দায়িত্বে ছিলেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ৭১ বছরের অশোক গেহলট। এখন আপ-এর ঘাড়ে বন্দুক রাখা হচ্ছে!
হিমাচলে ৫০ বছরের প্রিয়ঙ্কা গান্ধী, ৬১ বছরের ভূপেশ বাঘেল আর ৪৫ বছরের সচিন পাইলট মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন এবং কংগ্রেস সরকার গড়ল। বিজেপি-র সুবিধা করাই আপ-এর উদ্দেশ্য হলে গুজরাতের বদলে তারা তো হিমাচলে লড়ত। কিন্তু আপ মাঝ রাস্তায় হিমাচলের ভোটের লড়াই থেকে সরে আসে।

আন্না হাজারের আন্দোলন থেকেই উত্থান কেজরিওয়ালের

আপ। জন্ম ২৬ নভেম্বর, ২০১২। জাতীয় পার্টির মর্যাদা পেল ৮ ডিসেম্বর, ২০২২। মাত্র ১০ বছরে। 
এখন ৯টি জাতীয় পার্টি। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই, বিএসপি, এনসিপি, (মেঘালয়ের) এনপিপি এবং আপ। তবে তৃণমূল কংগ্রস, এনসিপি এবং সিপিআই সেই মর্যাদা হারাতে পারে। 
বিভিন্ন রাজ্য ভিত্তিক পার্টি জাতীয় পার্টির মর্যাদা পেতে ছোট ছোট রাজ্যের ভোটে লড়ে। তৃণমূল যে গোয়া এবং উত্তর পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যের ভোটে লড়ে, তার অন্যতম কারণ এটা। আপ দিল্লি ও পঞ্জাবে সরকার চালায়। গোয়ার পর গুজরাতেও ৬%-এর বেশি ভোট পাওয়ায় তারা জাতীয় পার্টির মর্যাদা পেয়েছে। এতে ভোটের লড়াইয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। 
অনেককেই বলতে শুনি, বিজেপি-র মতোই তৃণমূল এবং আপ-ও কংগ্রেসমুক্ত ভারতের কথা বলে। ওই দুটো দলও আসলে বিজেপির বন্ধু। কংগ্রেস ছাড়া দেশের রাজনীতি চলবে কী করে? 

জওহরলালের মরদেহের সামনে মেয়ে ইন্দিরা

জওহরলাল নেহরুর নিখাদ আস্থা ছিল ভারতের বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন, বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিশুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতায় (ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের বিরোধিতা কিংবা একটি বা সব ধর্মকে তোল্লা দেওয়ার ভাবনা নয়)। ইন্দিরা জমানায় কংগ্রেস নেহরুর কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। হয়ে উঠল আজকের বিজেপির ‘মিরর ইমেজ’। 
ইন্দিরা জমানাতেই শুরু হয় হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজের রাজনীতি। অযোধ্যার বিতর্কিত কাঠামোয় নেহরুর লাগানো তালা খুলে দেন ইন্দিরার ছেলে রাজীব। সঙ্গে মুসলিম মৌলবাদীদের খুশি করতে চালু করেন মুসলিম মহিলা আইন। মাচান বাবার পা মাথায় ছুইয়ে ভোটপ্রচার শুরু করেন দেশে টেলিকম বিপ্লবের জনক রাজীব। চোখের সামনে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে যেতে দেখেও হাত গুটিয়ে বসেছিলেন নরসীমা রাও। ইন্দিরা-খুনের পর ১৯৮৪-র দিল্লি শিখ নিধনযজ্ঞ ছাড়া আর কোনও ঘটনা ২০০২ গুজরাত গণহত্যার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে? 
প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ১৭ বছরের জমানায় ৩৫৬ ধারা জারি করে রাজ্য সরকার ভাঙা হয়েছে ৭ বার। আর ইন্দিরার ১৫ বছরে ৪৫ বার। জরুরি অবস্থার চেয়ে জোরাল কোনও ধাক্কা খেয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র?পরিকল্পিত অর্থনীতির কবরের উপরই তো তৈরি হয়েছে ভারতের বাজার অর্থনীতি। মনমোহন সিং নিজে সত্‍ হলেও তাঁর জমানায় দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছে।
এভাবে তো কংগ্রেসই বিজেপির জমি তৈরি করে দিয়েছে। সেই কংগ্রেস কি করে বিজেপির বিকল্প হতে পারে? 

বদলে দেওয়া ঘটনা

গত কয়েক দশকে বেশ কিছু ঘটনা ক্যানভাসটাকেই পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। 
১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত জমানার অবসানে দুনিয়ার এক দিকে ঝুঁকে পড়া।
১৯৯১। ভারতের পরিকল্পিত অর্থনীতির রাস্তা ছেড়ে বাজার অর্থনীতির রাস্তায় হাঁটা শুরু করা।
১৯৯২। বাবরি মসজিদ ধ্বংস। রাষ্ট্র স্রেফ দর্শক।
২০০১। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর একটা নতুন ধারণার দাপট শুরু হল-সন্ত্রাসবাদ। ক্রমশ একটা ধারণা তৈরি হতে শুরু করল, ইসলামই সভ্যতার শত্রু। হিন্দুত্ববাদীর রাজনীতির লোকেরা বোঝান, রোহিঙ্গা মানে সন্ত্রাসবাদী। কারণ তাঁরা মুসলিম। কিন্তু রোহিঙ্গারা হল মায়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া উদ্বাস্তু। দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতিগত গণহত্যার নির্মম শিকার। 
২০০২। গুজরাত গণহত্যা। 
বদলটা সরকার বদলের ছবি দেখে বোঝা যাবে না। এই ক্যানভাস বদলের ফলেই জন্ম নিয়েছে ট্রাম্প-বলসোনারো-মোদীদের জমানা। কিন্তু আমাদের দেশে নতুন ক্যানভাসে পুরোনো পেনসিলেই ছবি আঁকার চেষ্টা চলছে। তাই স্রেফ ভোটের অঙ্কে জোটের ছকে বাজিমাতের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। যেন এ+বি+সি+ডি করে বিজেপি-বিরোধী জোটে বেশি বেশি দলকে টেনে আনা গেলেই বিজেপিকে হারিয়ে দেওয়া যাবে। যদি ধরেও নিই, সেটাই রাস্তা, তাহলেও প্রশ্ন, সেরকম জোট ভারতের রাজনীতিতে সম্ভব? কেরলে কার সঙ্গে কার লড়াই কিংবা পশ্চিমবঙ্গে?
ভারতের জনমানসেও একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, জোট সরকার স্থায়ী হতে পারে না আর স্থায়ী সরকার ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

বিরোধী ঐক্য। তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশ।

সোজা কথা সোজা করেই বলা ভাল, কংগ্রেস এখন ভারতের রাজনীতিতে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। ক্ষমতা দখলে কংগ্রেসের ঘরেই তুলকালাম দ্বন্দ্ব। তাতে পঞ্জাব গেছে। রাজস্থান যাওয়ার জোগাড়। সদ্য জেতা হিমাচলের সংসারও সুখের হচ্ছে না। সেই কংগ্রেস বিজেপি-কে ঠেকানোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে? 
সেই কংগ্রেসকে আঁকড়ে ধরেই চলতে চাওয়ার চেষ্টা আসলে একটা শূন্যতার প্রকাশ। রাজনীতি তো আসলে ভোটের অঙ্ক নয়, ধারণার (Narrative) লড়াই। 
একটা বাড়ি বানালেই তো হয় না, তার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার, প্রয়োজনীয় অদলবদল দরকার। নাহলে তাতে ফাটল ধরবে, গাছ গজাবে। বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না। সেই জমিতে থাবা বসাবে প্রোমোটার। ধারণার (Narrative) ক্ষেত্রেও একই কথা। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতপাত সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে স্বাধীন ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার ফল কী হচ্ছে, সেটা খোলা মনে কাঁটাছেড়া করে দেখা হয়েছে? খামতিগুলো অতিক্রমের ব্যবস্থা হয়েছে?  
কেন ধর্মনিরপেক্ষ দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হবে না? তিন তালাক প্রথা কেন থাকবে? এগুলো তো মুসলিম মহিলাদের অধিকারের বিরুদ্ধে। শাহবানু মামলার হাত ধরে এই সংস্কারের সুযোগ পেয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। করেননি। মুসলিম মৌলবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এখন তাকে হাতিয়ার করতে চাইছে বিজেপি, যাদের গডফাদার আরএসএস হিন্দু বিবাহ আইন সংস্কারে জওহরলাল নেহরু ও বিআর আম্বেদকারের উদ্যোগ পণ্ড করতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। 
গুজরাত ও হিমাচলে ভোটের আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর জন্য কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করে বিজেপি। অন্য সব দল চুপ। শুধু আপ বলেছিল, তারা চায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হোক। কিন্তু ভোটের আগে হুড়োহুড়ি কেন?  

ইরান 

আজকের ইরানে দেখা যাচ্ছে হিজাব বিরোধী আন্দোলন। যাঁরা লড়ছেন তাঁদের ধর্মও তো ইসলাম। ইসলামী দেশে ওই অধিকারের লড়াই হচ্ছে অথচ ভারতে হিজাব পরাটাই মুসলিম মহিলাদের অধিকার বলে চেঁচামেচি করছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনৈতিক দলগুলো। 
কেন ধর্মনিরপেক্ষ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হবে? প্রশ্ন উঠবেই, মাদ্রাসায় কোরান পড়ানো যদি ঠিক হয় তাহলে স্কুলে গীতা, মনুসংহিতা পড়ানোয় ভুল কোথায়? উত্তরপ্রদেশ বা তেলঙ্গনার কিছু স্কুলে নতুন বর্ণমালা পড়ানো শুরু হয়েছে। A-অর্জুন বড় যোদ্ধা, B-বলরাম কৃষ্ণের ভাই, C-চানক্য এক আদর্শ শিক্ষক, D-ধ্রুব একটি তারা এবং বড় ভক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। স্কুল বা মাদ্রাসায় কোনও ধর্মীয় শিক্ষা নয়। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের ধর্ম-জাত নির্বিশেষে আধুনিক সময়ের উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজটাই শুধু হোক। 
তফশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণে কী লাভ হল ৭৫ বছরে? এসটি-দের ৫০%, এসসি ও মুসলিমদের ৩৩% এখনও দরিদ্র (দেশে দারিদ্রের হার ২১%)। অর্থাত্‍ পুরোনো ফর্মুলায় কাজ হয়নি। কিন্তু ওই ফর্মুলা চালিয়ে যাওয়ায় এসসি-এসটি-দের সঙ্গে উঁচু জাতের আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষদের শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। কেন জাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণ তুলে দিয়ে শুধুমাত্র আর্থিক ভিত্তিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হবে না? অতি সম্প্রতি বিজেপি যে সংরক্ষণের কথা বলেছেন সেরকম নয়। কেউ বছরে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করলেও আর্থিক ভাবে দুর্বলদের সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন! আসলে ওটা ভোটের স্বার্থে উঁচু জাতকে খুশি করার চেষ্টা।

সৈফুদ্দিন চৌধুরী

ক্যানভাসের সংকটেই ইন্দিরা জমানা থেকেই একের পর এক কংগ্রেস বিরোধী শক্তি বেড়ে উঠেছে।কংগ্রেস ভেঙেও অনেক দল তৈরি হয়েছে (উল্লেখযোগ্য শরদ পওয়ার, মমতা ব্যানার্জি, জগনমোহন রেড্ডি)। কংগ্রেসের শাসন বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের ইচ্ছেপূরণ করতে পারেনি বলেই আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থান ঘটেছে। কিন্তু তাদের কেউই কংগ্রেসের হারাতে থাকা জায়গাটার দখল নিতে পারেনি। কারণ কেউ নতুন ক্যানভাস, তৈরির চেষ্টাটা করেনি। তাই বিভিন্ন সময় রামমনোহর লোহিয়া-জয়প্রকাশ নারায়ণ-কাঁশীরাম-মায়াবতী-বিজু পট্টনায়েক-ভিপি সিং-জ্যোতি বসু-লালুপ্রসাদ-মুলায়ম সিং যাদব-মুফতি মহম্মদ-নীতিশ কুমার-প্রকাশ সিং বাদল-মমতা ব্যানার্জির মতো নেতানেত্রীদের কাঁধে ভর করে ক্রমাগত শক্তি বাড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি। তাঁরাই তাঁদের মতো করে তৈরি করেছে নতুন ক্যানভাস। আর পুরনো ধারণা নিয়ে চলতে চাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এমনকী বাম দলগুলোও, আজকের ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে বা ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। যে সব আঞ্চলিক দল বিজেপি-র কাঁধে ভর রেখে বাঁচার চেষ্টা করছিল, তারাও বুঝতে পারছে বিজেপি তাদের গিলে না ফেলে থামবে না। 
আশির দশকের মাঝামাঝি এই বিপদের কথাটাই বলেছিলেন সৈফুদ্দিন চৌধুরী। পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, ভোটের লড়াই নয়, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে গোঁজামিল ধারণার বিপদের কথাই বলতে চেয়েছিলেন বারবার। মানে বলতে চেয়েছিলেন নতুন ক্যানভাস বানানোর কথাটাই। তাঁর চেষ্টা সফল হয়নি। পিডিএস তৈরির সময় রাজনৈতিক দলগুলোর আওতার বাইরে থাকা রাজনীতি সচেতন মানুষের উত্‍সাহকে কাজে লাগানো যায়নি। 

সৈফুদ্দিন চৌধুরীর কিছু কথা শুনতে এখানে ক্লিক করুন। 

রাম জন্মভূমির ভূমি পুজায় মোদী ও যোগী

নিজেদের দুই শক্তিশালী ঘাঁটি গুজরাত আর উত্তরপ্রদেশের ভোটে কোনও মুসলিম প্রার্থীই দেয়নি বিজেপি। অথচ সংখ্যার বিচারে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম থাকেন উত্তরপ্রদেশে (জনসংখ্যার ২০%)। গুজরাতে মুসলিম প্রায় ১০%। তাদের বাদ দিয়েই চলতে চেয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কতটা মুসলিম বিদ্বেষী। 
রামনাথ কোবিন্দ আর দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে বিজেপি তুমুল হইহল্লা করে বোঝাতে চাইছে, দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি তাদের কত প্রেম! দেখনদারির মধ্যে যে অসত্‍ ভাবনা থাকে, সেটা বুঝতে বিশেষ বুদ্ধি লাগে না।
ঘৃণা ব্যক্তিগত পরিসরেও ঢুকে পড়ছে। কে কী খাবে, কী পরবে, কার সঙ্গে প্রেম করবে, সব কিছুতেই ঢুকে পড়েছে সেই ভাবনা। দীপিকা পাড়ুকোন গেরুয়া পোশাকে নাচলেও হইচই। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় ফাদার স্ট্যান স্বামীকে ফাঁসাতে তাঁর কম্পিউটার হ্যাক করে ৪০টি ফাইল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন অনেক অনেক অনেক ঘটনা ঘটছে, ঘটেই যাচ্ছে যাতে গা রিরি করতে পারে। প্রতিবাদ করার ভাবনা মাথায় আসতে পারে। এখানেই ফাঁদ। বিজেপির তৈরি করা মাঠে নামানোর ফাঁদ। কিন্তু বিজেপির তৈরি করা মাঠে খেলতে নেমে বিজেপিকে হারানো যাবে না। ‘পাঠান’-বিতর্ক নিয়ে হইচই না করলেও চলবে। সে কাজটা অমিতাভ বচ্চনদের মতো সচেতন ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবেন। রাজনৈতিক দলগুলোই সব বোঝে আর কেউ কিছু বোঝেন না, এই ভাবনা ভয়ংকর।

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে অমিতাভ-শাহরুখ

বিজেপি-র অমুক খারাপ, বিজেপি-র তমুক খারাপ, বিজেপি একনায়ক, বিজেপি ফ্যাসিস্ট, বিজেপি গণতন্ত্রবিরোধী, বিজেপি সংবিধানবিরোধী...এরকম সব দুর্বোধ্য কথায় ঝড় বইছে। কিন্তু এসব দুর্বোধ্য কথা সাধারণ মানুষের অভিধানে নেই। 
রামধনু হঠাৎ রংধনু হয়ে যাচ্ছে পাঠ্যবইয়ে (বিজেপি জয় শ্রীরাম বলেই হয়তো রামমুক্তির চেষ্টা)। কিন্তু রাম তো ভারতের ঐতিহ্যের অংশ। রামমুক্তি হলে রামমোহন বা রামকৃষ্ণকে কী নামে ডাকা হবে? বিজেপি জায়গার নাম, রাস্তার নাম বদলে দিচ্ছে, পাঠ্যবইয়ে বদল আনছে, তার সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল, তাই না? মিডিয়ায় খবর দেখে অনেকে চোখ গোল গোল করে বলেন, দেখেছ হিন্দু প্রতিবেশীর দেহ দাহ করতে নিয়ে গেলেন মুসলিমরা! 
এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটাই তো ভারত। এই ধারণা শাশ্বত ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এই ধারণা নিয়েই স্বাধীন ভারতের যাত্রাশুরু। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলগুলোর ভোটের রাজনীতি এই ধারণাকে নষ্ট করেছে বলেই বিজেপি-র উত্থান। বিজেপি এই ধারণার বিরোধী বলেই বিজেপি ভারত-বিরোধী। বিজেপি-র ভাবনা আসলে হিন্দু-পাকিস্তান গড়ার ভাবনা।

অরবিন্দ কেজরিওয়াল

বিজেপিকে হারাতে হলে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ক্রমশ দুর্বল করতে হলে, তাকে টেনে আনতে হবে অন্য মাঠে।
আমার মতে এক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর আপ-এর কৌশল। গত দিল্লি Saবিধানসভা ভোটের কথা ভাবুন। মোদী-অমিত শাহ-যোগী আদিত্যনাথ-একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব-গৌতম গম্ভীর, হেমা মালিনী, সানি দেওলের মতো তারকা সহ প্রায় ৫০০ (হ্যাঁ, প্রায় পাঁচশো) জনকে নামিয়ে বিজেপি-র হাইভোল্টেজ প্রচারের পাশে ভাল স্কুল-ভাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-বিনা খরচে বিদ্যুত্‍ ইত্যাদি নিয়ে চুপচাপ প্রচার চালিয়ে গেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা। ফল বেরোলে দেখা গেল, ৭০ আসনের মধ্যে আপ পেয়েছে ৬২। কয়েক দিন আগে দিল্লির পুরভোটেও তাই। 
দিল্লিতে সরকার চালাতে গিয়ে আপ সরকারি স্কুল, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল বদলে দিচ্ছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। সে সম্পর্কে কিছু কথা আগে লিখেছি, পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 
দু’দিকে বিআর আম্বেদকর এবং ভগত্‍ সিং-এর ছবি। তার সামনে বসে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন, জোটের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না। তবে ভাল স্কুল বানানো, ভালো হাসপাতাল বানানো, দিল্লির দূষণ কমানোর ব্যবস্থা করার কাজটা করতে পারি। কথা শেষে স্লোগান, ‘বন্দে মাতরম’, ‘ভারত মাতা কি জয়’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। সব মিলিয়ে একটা ধারণা (Narrative)। নতুন ক্যানভাস। 
সিএএ বিরোধী আন্দোলন বা দিল্লি দাঙ্গার সময় আপ চুপ থাকায় অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাদের। কিন্তু আমার মনে হয়, সেটাই ঠিক কৌশল। সিএএ-এনআরসি কেন খারাপ বোঝাতে নামা আসলে বিজেপির তৈরি করা মাঠেই খেলতে নামা। ভাল স্কুল-ভাল হাসপাতাল-ভাল রাস্তা-ভাল পরিবেশ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে কাজ ও চর্চাই আসলে বিজেপি-র বিষ মারার ওষুধ।
আমার মতটা পরিস্কার। মতাদর্শ (Ideology) বা নীতির (Principle) চেয়েও রাজনীতিতে বেশি প্রয়োজন প্রয়োগ (Policy)। আপনার খুব ভাল মতাদর্শ বা নীতি কিন্তু তা নিয়ে ভাষণ আর তর্কেই সময় কেটে গেলে লাভটা কি? কিন্তু প্রয়োগকে প্রাধান্য দিয়ে চললে সে বিপদ নেই। আর মতাদর্শ বা নীতিগত অবস্থান ছাড়া প্রয়োগপদ্ধতি তৈরি হতে পারে না। গরিব মানুষের জন্য কাজ করার কথা সব দল বলে। তবু গরিবের হাল বদলায় না। তারচেয়ে অত কথা ছেড়ে পাঁচটা ভাল স্কুল, দশটা হাসপাতাল বানালে গরিবারের সত্যিকারের উপাকার হয়। কাজের সুযোগ তৈরি করা গেলে গরিবের লাভ হয়। দরকার সেই রাজনীতিটাই। 

অরবিন্দ কেজরিওয়াল

আম আদমি পার্টি সম্পর্কে অনেক সমালোচনা-সংশয়-সন্দেহ আছে। রাজস্থান, উত্তরাখন্ডে আপ মিশে গেছে বিজেপি-তে। গুজরাতে জেতা আপ এমএলএ-রাও বিজেপি-তে চলে যেতে পারেন। দলটা ভীষণ ভাবে এক নেতা কেন্দ্রীক। সে সব সমস্যা কেন, কী ভাবে তাঁরা সামলাবেন সেটা একান্ত ভাবে আপ নেতৃত্বের ব্যাপার। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তাদের রাজনীতি ও সরকার চালানোর মডেল। আপ আমাদের রাজ্যে কী করবে, সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার। আমার মতে, অত্যন্ত নিচু মানের যাত্রাপালা বা টিভি সিরিয়ালের থেকেও খারাপ আমাদের রাজ্যের রাজনীতিকে বদলে দিতে পারে একমাত্র ওই মডেলই। 
আপ-মডেলই বিশল্যকরণী। দেশে এবং রাজ্যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ
Unknown বলেছেন…
খুবি ভালো লিখেছেন, পড়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করলাম
Unknown বলেছেন…
গোয়া বা হরিয়ানায় কবে #আপ এর রাজ্য ইউনিট #বিজেপি তে মিশে গিয়েছে। গোয়া এবং গুজরাটের এক জন বিধায়ক কেও টানতে পারেনি বিজেপি, আর পারবেও না কারন আন্দোলন থেকে জন্মানো দলের চরিত্র আলাদা হয়।

Top Post Ad