link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

ফুটবল বিশ্বকাপে অন্য খেলা #FIFA World Cup: A Fight for World of JUST


২৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে গেল। আলফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাই টুইটে জানিয়েছেন, বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের দিন সর্বকালীন রেকর্ড করেছে গুগল সার্চ। 
অস্বাভাবিক কিছু নয়। ১৯৮২ সাল থেকে সরাসরি বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার সুযোগ হয়েছে। কত কত তারকার খেলা! কত স্বপ্নভঙ্গ! কত স্বপ্নপূরণ! কিন্তু এবারের মত ভয়ঙ্কর সুন্দর ফাইনাল কখনও দেখিনি। বিশ্ব ফুটবলের দুই লিজেন্ডও কখনও একসঙ্গে খেলেননি। এবার হল। ফাইনালে মুখোমুখি হলেন লিওনেল মেসি আর কিলিয়ান এমবাপে।
৮০ মিনিট পর্যন্ত একপেশে খেলার পর হঠাৎ ৯৭ সেকেন্ডে রং বদল। বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক। ১৯৬৬ সালে জিওফ হার্স্টের পর ২০২২ সালে কিলিয়ান এমবাপে। ফাইনালে তিনটি পেনাল্টি। মেসি না এমবাপে, কে হবেন সর্বোচ্চ গোলদাতা, তা নিয়ে টক্কর। পরপর দুবার ফাইনালে ৪ গোল করে এমবাপের রেকর্ড। টাইব্রেকার। এবং বিদায়ী বিশ্বকাপে মেসির বিশ্বজয়ের স্বাদ পাওয়া। 
মহাকাব্যিক। সেই ফাইনাল নিয়ে রেকর্ডভাঙা গুগল সার্চ হওয়াই তো স্বাভাবিক। 
সুন্দর পিচাই লিখেছেন, ‘দেখে মনে হচ্ছিল, গোটা দুনিয়া যেন শুধু একটা জিনিসই সার্চ করছে।’

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির

শ্রীলঙ্কার নেভির কয়েকজন অবশ্য তখন সমুদ্রে ভাসতে থাকা একটি বোট সার্চ করছিলেন। খবরটা দিয়েছিলেন মৎস্যজীবীরা। বিশ্বকাপ ফাইনাল চলার সময় বা তার খানিকটা আগে-পরে শ্রীলঙ্কার নেভি বোটটি টেনে পারে নিয়ে আসে। তাতে ৩৯ মহিলা, ২৩ শিশু-সহ ১০৫ জন ছিলেন। 
বোটটিতে ছিলেন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা।
ডিসেম্বরে একটি বোট উদ্ধার করেছে ভিয়েতনাম। ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায় আরেকটি বোট মাসখানেক আন্দামানের কাছে ভেসে ছিল। জল-খাবার সব শেষ হয়ে যায়। জনা তিরিশ যাত্রীর মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন অন্যরা। শেষ পর্যন্ত সেটি ইন্দোনেশিয়া পৌঁছয়। সম্ভবত শ’দুয়েক যাত্রী সহ আরও একটি বোট ডুবে গেছে।    
রাষ্ট্রসংঘ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতেই বারবার নৃশংস অভিযান চালাচ্ছে মায়ানমারের সেনা। ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মায়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে অন্তত ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী শুধু বাংলাদেশেই আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা ছড়িয়ে আছেন আরও অনেক দেশে।
সুস্থ জীবনের খোঁজে বাংলাদেশের শরনার্থী শিবির থেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা। তাঁরা দেশহীন বিপন্ন উদ্বাস্তু। 


আমার পূর্বপুরুষ স্বাধীনতার ধাক্কায় উদ্বাস্তু হয়েছিল। তাই উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণা আমাকে কাঁদায়, আমাকে ভাবায়। নিরুপায় না হলে কি কেউ নিজের ঘর-সংসার ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ায়?  ছোট্ট বোটে ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি করে বাচ্চা-বুড়ো-মহিলারা অশান্ত সমুদ্রে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন? 
শুধু রোহিঙ্গা নয়, আজকের দুনিয়ার অন্যতম জ্বলন্ত সমস্যা হল এই উদ্বাস্তু সমস্যা, সন্ত্রাসবাদের সমস্যার চেয়ে যা অনেক গুণ বেশি। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তুদের নিয়ে একটা দেশ তৈরি হলে জনসংখ্যার বিচারে সেটি হত চতুর্থ, চিন-ভারত-আমেরিকার পরেই।
 
ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে গোলের পর এমবোলা

শরনার্থীরা বিভিন্ন দেশের ফুটবলের সামনে নতুন নতুন সুযোগও তৈরি করে দিচ্ছেন। লারবি বেনবারেক, ইউসেবিও, মিলোস্লাভ ক্লোসে, পেপে, নানি, ইব্রামোভিচ, লুকা মডরিচ...কত কত উদাহরণ...অল্প কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলাম শুধু। 
এবারের বিশ্বকাপে সুইত্‍জারল্যান্ড বনাম ক্যামেরুনের খেলা মনে আছে? ব্রিল এমবোলো গোল করার পর কোনও উচ্ছ্বাস করেননি। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত দুটো তোলা। যেন অপরাধ করে ফেলেছেন। অ্যামবেলোর জন্ম ক্যামেরুনেই। তাঁর বাবা এখনও সে দেশেই থাকেন। গোলের পাস বাড়িয়েছিলেন  জেরদেন সাকিরি, তিনিও শরনার্থী, জন্ম যুগোস্লাভিয়ায় (আজকের কসোভো)। 
বিশ্বকাপে কানাডার প্রথম গোলটি আলফোনসো ডেভিসের, যাঁর জন্ম ঘানার উদ্বাস্তু শিবিরে।অ্যাঙ্গোলার উদ্বাস্তু শিবিরে জন্মানো এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা পরিবর্ত হিসেবে নেমে এবারের ফাইনালের শেষ বেলায় রং বদলের অন্যতম নায়ক 
বিশ্বকাপ, ইউরোপ ও আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলার ও ব্যালন ডি’অর জেতা আফ্রিকার একমাত্র খেলোয়াড়, কিংবদন্তী জর্জ উইয়া এখন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। তাঁর ছেলে টিমোথি উইয়া খেলছেন আমেরিকার বিশ্বকাপ দলে। ওয়েলসের বিরুদ্ধে প্রথম গোলটা তাঁরই।

উইয়া। বাবা ও ছেলে।

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালে ফ্রান্সের গোল তিনটে করেন জিনেদিন জিদান আর ইমানুয়েল পেটিট। ২০১৮ ফাইনালে গোল কিলিয়েন এমবাপে, আন্টন গ্রিজম্যান আর পল পোগবার। পাঁচ জনই শরনার্থী পরিবারের। ১৯৩৮ বিশ্বকাপ থেকে ফ্রান্স দলে থাকছেন কোনও না কোনও শরনার্থী বা শরনার্থী পরিবারের কেউ। মিশেল প্লাতিনি, করিম বেঞ্জেমা, হুগো লরিস, লিলিয়েন থুরাম, থিয়েরি অঁরি, ওসুমানে ডেমবেলে, এনগোলো কন্তে...লম্বা তালিকা।  কামাভিঙ্গা ছাড়াও এবারের ফাইনালে পরিবর্ত হিসেবে নেমে ম্যাচের রং বদলে দেওয়া আরেক নায়ক মার্কাস থুরামও (লিলিয়েনের ছেলে) শরনার্থী পরিবারের। 
২০১৮ বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্স দলের ৮৭% ফুটবলারই ছিলেন শরনার্থী বা শরনার্থী পরিবারের। কাতার বিশ্বকাপে ৮৩২ জনের মধ্যে ১৩৭ জনের জন্ম অন্য দেশে (১৬.৩%)। সংখ্যাটা ২০১৪ বিশ্বকাপে ছিল ৮৫ আর ২০১৮ সালে ৮৪। হারটা ১৯৩০ সালে ছিল মাত্র ৫%। 


এবার বিশ্বকাপে খেলা ৫৯ জনের জন্ম ফ্রান্সে। তাঁদের মাত্র ৩৭% খেলেছেন জন্মভূমির হয়ে। অন্যরা খেলেছেন তিউনিশিয়া, সেনেগাল, ঘানা, ক্যামেরুন, মরক্কো, স্পেন, পর্তুগাল ও কাতার দলে। মরক্কোর ২৬ জনের স্কোয়াডে আচরাফ হাকিমি-সহ ১৬ জনেরই জন্ম অন্য দেশে। আর্জেন্তিনা, ব্রাজিল, সৌদি আরব এবং দক্ষিণ কোরিয়া-মাত্র এই চারটে দেশের সব ফুটবলারের জন্ম সেই দেশে। হ্যারি কেন, রহিম স্টার্লিং, বুকায়ো সাকা, ডেকলান রাইস, হ্যারি ম্যাগুইরে, কাইল ওয়াকার, কালভিন ফিলিপস, মারকাস রাসফোর্ড, জুড বেলিংহাম, এরিক ডায়ার...শরনার্থী বা শরনার্থী পরিবারের ফুটবলারে ভরা ইংল্যান্ড দলও। 


ফুটবলের মতো অন্য কোনও খেলায় এভাবে সমাজ, সভ্যতার আনন্দ-যন্ত্রণা মিশে থাকে না। ফুটবল বিশ্বকাপ তাই ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। পুরনো বছরগুলোর কথা থাক। এবারের বিশ্বকাপের শরীরে ছাপ ফেলে গেছে ইরানে হিজাব বিরোধী আন্দোলন। দেশে ফিরে কঠোর সাজার মুখে পড়তে হতে পারে জেনেও ইরানের ফুটবলাররা প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলাননি। হিজাব বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় ইতিমধ্যে ইরানে দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। একজনের ফাঁসি হয়েছে সবার চোখের সামনে ক্রেনে ঝুলিয়ে। ইরানের ২৬ বছর বয়সী ফুটবলার আমির নাসের আজাদানির ফাঁসির সাজাও ঘোষণা হয়ে গেছে। 

কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চে ইরানের প্রতিবাদের ছায়া

কাতারের ধর্মান্ধ শাসক পেট্রো ডলারের গরমে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেতে তারা লক্ষ লক্ষ ডলার ঘুষ দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রেফতার হয়েছেন ফ্রান্সের কিংবদন্তী ফুটবলার, উয়েফা প্রেসিডেন্ট মিশেল প্লাতিনি। সরতে হয়েছে ফিফা প্রেসিডেন্ট শেপ ব্লাটারকে। বিশ্বকাপ শেষের পরও সেই ঘুষকাণ্ডের ধাক্কা চলছেই। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে গ্রিসের ইভা কাইলিকে।
বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতার খরচ করেছে ২২০ বিলিয়ন ডলার। হিসাব বলছে, ১৯৯৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭ ফুটবল বিশ্বকাপের মোট খরচের চার গুণেরও বেশিখরচ করেছে কাতার। তারপরও কাতার বিশ্বকাপের গায়ে মানবাধিকার ভাঙার দগদগে ক্ষত। 


ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা এই বিরাট নির্মাণ কাজ করেছেন। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  ২০১০-২০২০ অন্তত সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক মারা গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০২১-২২ সালের হিসেব নেই। অন্যান্য দেশ থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের হিসেবও নেই। 
পেট্রো ডলারের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে ফিফা। সে দেশের শাসক যা বলেছে তাই মেনে নিয়েছে।
বিশ্বকাপ নেওয়ার সময় মেসির গায়ে ছিল আরবের ঐতিহ্যপূর্ণ আলখাল্লা ‘বিশ্‌ত’। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী, শুধু ট্রফি নেওয়ার সময় গায়ে শুধু জার্সি থাকতে হবে। সেই নিয়ম ভেঙে কাতারের রাজা শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ট্রফি নেওয়ার আগেই মেসির গায়ে আলখাল্লা পরিয়ে দেন। তখন পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো। 
পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে ফিফা চুপ। ইউরোপের কিছু দেশ সরব হলেও মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের দেশগুলোর সরকারও চুপ। 
(কাতার বিশ্বকাপে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে পড়তে ক্লিক করুন এখানেএখানে কিংবা এখানে।)


সভ্যতার আয়না বিশ্বকাপ ফুটবল কিন্তু মাথা নোয়ায়নি। LGBTQ অধিকারের পক্ষে ‘ওয়ান লাভ’ নামে আর্মব্যান্ড পরে খেলতে চেয়েছিলেন নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানির অধিনায়করা। কিন্তু কাতারে সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই ফিফাও বাধ্য ছাত্রের মতো আর্মব্যান্ড পড়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। প্রতিবাদে হাতে মুখ ঢেকে ফটো সেশন করে জার্মান দল। ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড পরে ফিফা প্রেসিডেন্টের পাশে বসেই খেলা দেখলেন জার্মানির অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী ন্যান্সি ফাসের, বেলজিয়ামের বিদেশমন্ত্রী হাদজা লাহবিব। জার্মানি মন্ত্রী সোজাসাপটা বলেছেন, ‘অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফিফা আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না, এটা ভাবাই যায় না। আধুনিক সময়ে এই কাজ একেবারেই ঠিক নয়।’

বিশ্বকাপের মাঠে প্রতিবাদ। ইউক্রেন, ইরান, LGBTQ একাকার
সমকামিতার অধিকারের পক্ষে। (উপরে) জার্মান ফুটবল দলের প্রতিবাদ। ফিফা প্রেসিডেন্টের পাশে আর্মব্যান্ড পরে বেলজিয়ামের বিদেশমন্ত্রী (নিচে বাঁ দিকে) ও জার্মানির অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী (নিচে ডান দিকে)

এবারের বিশ্বকাপে বারবার উঠেছে প্যালেস্তাইনের মানুষের স্বাধীনতার দাবি। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তৈরির পর থেকে বছরের পর বছর বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছেন অন্তত ৭০ লক্ষ প্যালেস্তিনিয়। বিশ্বকাপ শেষের ১০ দিনের মধ্যে প্যালেস্তাইনের অলিম্পিক দলে নির্বাচিত এক ফুটবলারকে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে মরতে হয়েছে।
সারা দুনিয়ায় উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্যালেস্তিনিয়দের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। সারা দুনিয়ায় উদ্বাস্তুর সংখ্যা এখন ২৮ কোটির বেশি, দুনিয়ার জনসংখ্যার ৩.৬%। উদ্বাস্তু সমস্যা দুনিয়ার রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। 

কাতার বিশ্বকাপে স্বাধীন প্যালেস্তাইনের দাবি

বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষ। মাঠে মুখ ঢেকে বসে আছেন বিধ্বস্ত এমবাপে। মাঠে নেমে গেলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ। সস্নেহে হাত রাখলেন এমবাপের পিঠে। এটা স্রেফ মানবিক ছবি নয়, গভীর রাজনৈতিক বিবৃতিও। 
ফ্রান্সে ক্রমশ কট্টর ডানপন্থীদের শক্তি বাড়ছে। গত এপ্রিলে টানা দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড করেছেন মাকরঁ। পেয়েছেন ৫৮.৮% ভোট। কিন্তু ফ্রান্সে মসজিদ বন্ধ, উদ্বাস্তুদের জন্য দরজা বন্ধের কথা বলা কট্টর ডানপন্থী মারিন লু পেন পেয়েছেন  ৪১.২% ভোট। তাঁর বাবা জঁ মারি লু পেন ১৯৯৬ সালে বলেছিলেন, প্রচুর অশ্বেতাঙ্গে ভরা ফরাসী ফুটবল দল একটা কৃত্রিম ব্যাপার। তার দু বছর পর আলজেরিয়ার উদ্বাস্তু জিদানের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জিতেছিল ফান্স। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ফাইনালে গোল তিনটি করেছিলেন দুই উদ্বাস্তু জিদান আর পেটিট। গতবারের ফাইনালে দু গোল আর এবারের ফাইনালে তিন গোল করা এমবাপেও উদ্বাস্তু পরিবারের। 
মাকরঁদের চিন্তার কারণ আছে। গত কয়েক বছরে লু পেনদের শক্তি বাড়ছে উল্কার গতিতে। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়ামেও অতি-দক্ষিণপন্থী শক্তি বাড়ছে। সুইডেনে প্রবল হচ্ছে উদ্বাস্তু-বিরোধী ডেমোক্র্যাট পার্টি। ইটালিতে মুসোলিনির পরে প্রথম ক্ষমতা দখল করেছে কোনও অতি-দক্ষিণপন্থী দল। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জর্জিয়া মেলোনি। বাড়ছে ‘ইসলামোফোবিয়া’।
 
মাকরঁর এমবাপে। ডান দিকে উপরে, খেলার পর ফ্রান্স ড্রেসিং রুমে ফরাসি প্রেসিডেন্ট

আমাদের দেশের কথা ধরুন।
বিপন্ন রোহিঙ্গাদের ঘৃণা করতে শেখাচ্ছেন বর্তমান শাসকরা। নির্বোধ শুভেন্দু অধিকারী মুসলিম বোঝাতে বলেন রোহিঙ্গা। অথচ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক হিন্দুও আছেন। মায়ানমারের সেনাকর্তারা রোহিঙ্গাদের বলেন বাঙালি,  যেমনটা বোঝান নির্বোধ পরেশ রাওয়াল (১৯৬২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর ৩ লক্ষের বেশি বাঙালি মায়ানমার ছাড়তে বাধ্য হন। এখন যে হাজার ৫০ বাঙালি ওই দেশে আছেন তাঁরাও পূর্ণ নাগরিকের স্বীকৃতি পান না)। 
আদতে পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। তাঁদের পূর্বসূরীরা থাকতেন আরাকানে। এক সময় মায়ানমার সংসদেও ছিল রোহিঙ্গা প্রতিনিধি। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পর্বে শুরু হয় রোহিঙ্গা বিদ্বেষ।১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে তীব্র সামরিক নির্যাতন এবং দমনপীড়নের মুখোমুখি হয়েছে রোহিঙ্গারা। ২০০২ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে মুসলিম বিদ্বেষের হাওয়া যতই সারা দুনিয়ায় বেশি বেশি ছড়িয়েছে ততই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষও ছড়িয়েছে ঝড়ের গতিতে। 

ওজিল। বেঞ্জেমা। লুকাকু

২০১৪ বিশ্বকাপ জেতা জার্মানির অন্যতম তারকা মেসুট ওজিল। পরের বিশ্বকাপে জার্মানি প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে যাওয়ার পর তুরস্কের উদ্বাস্তু ওজিলের দেশপ্রেমের দিকে আঙুল উঠল। যন্ত্রণায় খেলা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করতে গিয়ে ওজিল লিখলেন, ‘জিতলে আমি জার্মান, হারলে উদ্বাস্তু।’
দুনিয়ার ফুটবলের অন্যতম তারকা ফ্রান্সের করিম বেঞ্জেমা অনেক বছর আগে বলেছিলেন, ‘গোল করলে আমি ফ্রান্সের। গোল করতে না পারলে বা কোনও সমস্যা হলেই আমি আরবের।’ 
একবার জাতীয় দলের কোচের উপস্থিতিতে ফরাসি ফুটবল ফেডারেশনের পাণ্ডারা জাতীয় দলে উদ্বাস্তু ফুটবলারদের সংখ্যা কমানোর ছক কষছিলেন। সে অডিও বাইরে আসতেই হইচই পড়ে যায়। 
বারবার বাঁকা কথা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বেলজিয়ামের রোমেলু লুকাকু বলেন, ‘যখন সব ঠিক থাকে তখন আমি বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার। যখন সব ঠিক থাকে না তখন আমি কঙ্গো বংশোদ্ভূত বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার।’ 
ঘটনাগুলো আলোর নিচে অন্ধকারের ছবিটা দেখিয়ে দেয়। বাস্তবে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত, সবচেয়ে বেশি অমানবিক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় মুসলিম উদ্বাস্তুদেরই।


২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। দোগান নিউজ এজেন্সির উনত্রিশ বছরের চিত্র সাংবাদিক নিলুফার ডেমির,তোলা ছবিটা সারা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তুরস্কের বন্দর শহর বোদরামের নির্জন সৈকতে ভূমধ্য সাগরের তিরে মখ থুবড়ে পড়েছিল একটি শিশু। ২ বছরের আলান কুর্দি। ISIS আর সেনার লড়াইয়ে প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়ার কুর্দ যুবক আবদুল্লা তাঁর স্ত্রী রেহানা আর দুই ছেলে গালিব ও আলানকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন তুরস্কে। কানাডায় যাওয়ার আবেদন নাকচ হয়েছিল। পাচারকারীদের রবারের ভেলায় চেপে গোপনে তারা রওনা দিয়েছিলেন গ্রিসের পথে। মিনিট দশের মধ্যে উল্টে যায় ভেলা। রেহানা আর দুই সন্তান ডুবে যায় সমুদ্রে। (কাহিনী পড়তে ক্লিক করুন এখানেএখানে বা এখানে)।
সেই ছবি নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। তারপর? তিন পাচারকারীর ১২৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। বিশ্ব হাঁফ ছেড়ে বেঁচে বলেছে, যাক, ইনসাফ পেল ছেলেটা। আসল অপরাধীরা দিব্যি করেকম্মে খেয়ে যাচ্ছেন এ দেশ-ও দেশ-সে দেশের মাথা হয়ে। 
আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মায়ানমার, ইউক্রেনের। যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, জাতিনিধন যজ্ঞ ছাড়াও উদ্বাস্তু সমস্যার একটি কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। বেশির ভাগ উদ্বাস্তুই আশ্রয় পান লেবানন, জর্ডন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সুদান, ইথিওপিয়া, ডক্টর কঙ্গো, তুরস্ক, উগান্ডা, কলম্বিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশে। ইউরোপের দেশগুলোতে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার অনীহা বাড়ছে। (দুনিয়ার উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে আরও বিশদে পড়তে ক্লিক করুন এখানেএখানেএখানে বা এখানে


উদ্বাস্তুদের উপর ভর করেই তৈরি হয়েছে আমেরিকা। সে দেশেরই প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন প্রবল উদ্বাস্তু-বিরোধী, ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসেনারোর মতই। 
গত ২১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৭৪ বছরে প্রথম বার রোহিঙ্গা সমস্যা মেটাতে ব্রিটেনের আনা প্রস্তাব পাশ হয়েছে ১২-০ ভোটে। তাদের ভূমিকার জন্য প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশ। ভোটদানে বিরত ছিল জিনপিং-এর চিন, পুতিনের রাশিয়া আর মোদীর ভারত।
বছরের পর বছর প্যালেস্তিনিয়দের উদ্বাস্তু করে রাখা ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত না ভারত। মোদী হাত ধরেছেন ইসরায়েলের। সে দেশের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়ার নাকি মোদীর নজরদারি রাষ্ট্রের অন্যতম হাতিয়ার।
মোদী সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত CAA মুসলিম-বিদ্বেষের সঙ্গে উদ্বাস্তু-বিদ্বেষেও ঠাসা। আন্দামানের কাছে সমুদ্রে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গাদের বোট দেখেও নাকি ভারতীয় নৌসেনা কিছু খাবার ও জল দিয়েছে কিন্তু উদ্ধার করেনি। 

প্রতিবাদের ফুটবল

তালিবান আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পরেই দেশ ছাড়েন মহিলা ফুটবলাররা। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের বের করতে বিশেষ অভিযান চালায় মার্কিন সেনা। একদল আশ্রয় নেন পাকিস্তানে। সেখানে থেকে তাঁরা এখন অস্ট্রেলিয়ার আশ্রয়ে। একদল পর্তুগাল, অন্য দল ব্রিটেনে আশ্রয় পেয়েছেন।
ফুটবল স্রেফ খেলা নয়। সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি তার তার সারা গায়ে জড়িয়ে। উদ্বাস্তুদের লড়াই তো আসলে লুটে খাওয়ার সঙ্গে খেটে খাওয়ার লড়াই। সেই অসম যুদ্ধ চলে ফুটবল মাঠে। সমতার দুনিয়ার জন্য লড়াই দুনিয়ার ফুটবলের মাঠে, ফুটবল বিশ্বকাপের মাঠে। তার প্রতীক কখনও মারাদোনা, কখনও সক্রেটিস, কখনও গ্যারি লিনেকার, কখনও কিলিয়ান এমবাপে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
নামহীন বলেছেন…
বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চে এখন রোহিঙ্গা সমস্যাটা শোনা যায়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাই
SANJOY BANERJEE বলেছেন…
খুব ভাল লাগল। উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে এত বিশদে কিছুই জানতাম না। বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা তো থাকবেই। চিরকালই ছিল। একটা কথা, উদ্বাস্তু সমস্যা বা বিশেষ করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে প্রতিবেশী দেশের বা অনুপ্রবিষ্ট দেশের অর্থনীতিতে কি সমস্যা সৃষ্টি হয় তা নিয়ে একটু আলোচনা করুন।।

Top Post Ad