অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও সৈফুদ্দিন চৌধুরী |
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন আগেই। গ্রেফতার হয়েছেন এক কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষও। এবার গ্রেফতার হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। গ্রেফতার শিক্ষক নিয়োগে চুরির অভিযোগে গ্রেফতার। সারা রাজ্যের কোটি কোটি মানুষের লজ্জা।
স্রেফ এই একটি কারণেই নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। কিন্তু সেসবের ধার দিয়ে না গিয়ে তিনি আরেকটা চাকরি মেলায় পুজোর সময় ঝালমুড়ি বিক্রি করে উপার্জনের আইডিয়া দিয়ে এলেন। কোনও রাজনৈতিক দলও এই ইস্যুতে তেমন সরব হল না। অনেকে বলতে পারেন, সব নিয়োগপত্রের ক্ষেত্রে তো হয়নি। একটি নিয়োগপত্রের ক্ষেত্রে হলেও সেটা অপরাধ। বেকার ছেলেদের প্রতারণা করেছে স্বয়ং সরকার।
আমি বাঁচতে চাই। তাহলে আমার আয় দরকার। আমার কাছে কাজের সুযোগ থাকলে আমি কেন আয়ের ধান্দায় পার্টির চারপাশে ঘুরব? কেনই বা পার্টির লোকেদের কাটমানি দিয়ে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা নেব? কেনই বা শাসক দলের নেতাদের টাকা দিয়ে চাকরি কিনতে চাইব? আমি এটা করছি মানে আমার সামনে কাজের সুযোগ নেই। তাই শাসক পার্টির সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে যেটুকু হয়। তাই তোলাবাজি-গুন্ডামি ইত্যাদির সঙ্গে বেকার ছেলেরা জড়িয়ে যাচ্ছে। আয় তো করতে হবে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেতারা টাকার পাহাড় বানাচ্ছে।
নেতাজি ইন্ডোরে চাকরি মেলায় মমতা |
তার চেয়েও বড় লজ্জার কাণ্ড ঘটেছে। লজ্জা না বলে, অপরাধ বলাই উচিত। ঘটা করে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা খরচে নেতাজি ইন্ডোরে চাকরি বিলি করলেন মুখ্যমন্ত্রী। দেখা গেল, সে সব আসলে নামমাত্র বেতনে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরি। প্রতি বছরই রাজ্যের পলিটেকনিক আইটিআই ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা এরকম কাজ পান। দেখা গেল, সরকার যে চাকরির কথা বলল তার অনেকগুলো আবার চাকরিই নয়, স্টাইপেন্ড দিয়ে প্রশিক্ষণ। এতো গেল মিথ্যে কথা। সেটা হরহামেশাই মুখ্যমন্ত্রী বলেন।
দেখা গেল হুগলির বেশ কিছু ছেলেকে ভুয়ো চিঠি দেওয়া হয়েছে। যে সংস্থার সঙ্গে রাজ্য সরকারের কোনও চুক্তিই হয়নি, তাদের লেটারহেডে 'নিয়োগপত্র' দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থার প্রধানের ফোন নম্বর দিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তাঁকে ফোন করার পরই জানা যায় লোক ঠকানো কারবারের কথা। বেকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সোজাসাপটা প্রতারণা।
এই দেখুন নিয়োগপত্র। চাকরি মেলায় বরাভয় মুখ্যমন্ত্রীর |
এই লজ্জা। এই চুরি। এই প্রতারণা। এই কিছু না হওয়ার রাজ্যে অবসাদই নিত্যসঙ্গী। আমরা কিছু করতে পারি, এই বিশ্বাসটাই ক্রমশ উবে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে রাজ্য গোল্লায় যাবে, এটাই যেন অনিবার্য ধরে নিচ্ছি আমরা। গড়ার রাস্তা আছে? কোথাও সেই আলোচনা নেই।আছে শুধু সরকারে যাওয়ার অঙ্ক কষা। ভাবটা এমন, একবার আমাকে সরকারে বসাও। দেখিয়ে দেব। সে সব শূন্যগর্ভ কথা শুনে অবসাদ আরও বাড়ে।
গোড়ার প্রশ্নটা হল, আজকের অবস্থায় আমরা পৌঁছলাম কী করে? ভাবনাচিন্তার রেওয়াজ আজকের রাজনীতিতে নেই। সব টি-২০ রাজনীতি। তাই প্রশ্নটা শুনেই অনেকে চেঁচিয়ে উঠবেন, মমতা ব্যানার্জির নীতিহীন রাজনীতির জন্য। বেশ। কিন্তু সেই মমতাই তাহলে বারবার ভোটে জিতছেন কেন? বেশির ভাগ মানুষই কি তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত বা দুর্নীতির সমর্থক? এবার অনেকে চেঁচিয়ে বলবেন, ওই ভিক্ষা দিয়ে কিনে রেখেছে (মানে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দিয়ে)।
যাঁরা চিৎকার করছেন তাঁরা করুন। কিন্তু অঙ্কটা অতটা সহজ নয়।
ধর্মতলায় এসএফআই-ডিওয়াইএফআই-এর 'ইনসাফ সমাবেশ' |
প্রশ্নটা হল, এই অভ্যাস কি তৃণমূল জমানাতেই দেখা যাচ্ছে প্রথম? রাজ্যের পূর্বতন শাসক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ানোর কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব শ্রমিক ইউনিয়নের রং কেন বদলে গেল? গ্রামে গ্রামে মুরুব্বিরাও কেন দল বদলে ফেলল? এক দঙ্গল লোক যে আগের শাসক দল ছেড়ে বর্তমান শাসক দলে ভিড়ল, সেটা কোন আদর্শের ভিত্তিতে?
সমস্যাটা অর্থনীতির। সমস্যাটার শুরু গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সংকট থেকে। ছোট জোতে চাষে আর লাভ নেই। বেশিরভাগ কৃষক জমি বিক্রি করে দিনমজুর খেতমজুর হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্য রাজ্যে কাজে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। 'কৃষকের ছেলে আর চাষ করতে চাইছে না' তাই 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত' বলে কর্পোরেট পুঁজির দোরে দোরে ঘোরাটাই রাস্তা, এরকম শেখানোর একটা প্রবণতা ছিল। এবং এখনও আছে। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি, পুঁজিপতিরা দয়া করে বিনিয়োগ না করলে আমাদের কপাল ফিরবে না। তাই তাঁদের ভজনা করাটাই রাস্তা। কিন্তু অর্থনীতির নিয়ম বলছে, মুনাফা না থাকলে পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ করেন না। আর বর্তমান সময়ের নিয়ম হল কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন (jobless growth)। আগে ১০০০ টাকা বিনিয়োগে ১০০ লোকের কাজ হলে এখন হচ্ছে ২ জনের। বাকিটা করবে প্রযুক্তি। অর্থনীতির সেইসব নিয়ম না বলে শিল্পায়নের ঢাক বাজিয়ে বাজার গরম করে ভোটবাক্স ভরানোর মতলবও অপরাধ। (আমাদের রাজ্যের আর্থিক সংকট সম্পর্কে আমার মতামত বিস্তারিতে অন্য লেখায় লিখেছি। উৎসাহীরা পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন )।
বিজেপির 'নবান্ন অভিযান' |
সেই সমস্যা সমাধানে দরকার ভিন্ন ভাবনা। গোলমালের গোড়ায় ধাক্কা মারতে হবে। 'চোর ধরো জেল ভরো' করে সে কাজ হবে না। আর সেই সমস্যা না মিটলে একদল চোর জেলে গেলেও আরেক দল জন্ম নেবে। এক দলের চোর জেলে গেলে আরেক দলের চোর জন্ম নেবে। কারণ অর্থনৈতিক সংকট থেকেই এই দুর্নীতির জন্ম। রাজনৈতিক দুর্নীতিরও জন্ম। তা থেকেই জন্ম নেয় হিংসার রাজনীতি।
ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন, দুর্নীতি নিয়ে তৃণমূল এত লেজেগোবরে হলেও তাদের পাশ থেকে গরিব মানুষের সমর্থন এখনও সরে যায়নি। বিকল্প রাস্তা দেখাতে না পারলে স্রেফ এই দুর্নীতির কারণে সরবেও না। (তৃণমূল ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বলছি, তার মেয়াদ শেষ। ২০২৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় নাও থাকতে পারে। সেটা বলছি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।)
এই আকালেও বিশ্বাস করি, বিকল্প রাস্তা আছে। হিংসামুক্ত রাজনীতি আর বাধাহীন উন্নয়ন, সেই বিকল্পের দুই মন্ত্র। সে সম্পর্কে কিছু বলার আগে উন্নয়নের যে চালু মডেলের ঢাক দিনরাত বাজানো হচ্টাছে, সে সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলতে চাইছি।
নিজের ৭২ তম জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী চিতা ছাড়লেন। এবং মিথ্যে কথা বললেন। গলা কাঁপিয়ে বললেন, ১৯৫২ সালে দেশে চিতা অবলুপ্তির কথা বললেও তারপর থেকে কেউ কিচ্ছু করেনি। মানে তিনি এলেন বলেই চিতা এলো। বাস্তবে ২০০৯ সালে 'মিনমিনে প্রধানমন্ত্রী' মনমোহন সিং সরকারই চিতা আনার পরিকল্পনা করে। ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। চিতা বাছাইও হয়ে যায়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বাধায় চিতা আসেনি। ২০২০ সালে অনুমতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সে সব চেপে গেলেন অকারণে মিথ্যে বলতে ওস্তাদ মোদী।
চিতা ছাড়ার পর |
প্রধানমন্ত্রী বললেন, 'আজ আমরা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশ বদলে যাচ্ছে, আগে আমরা পায়রা ওড়াতাম আজ চিতা ছাড়ি।' বোঝাতে চাইলেন, আগে আমরা রোগাসোগা দুর্বল দেশ ছিলাম। তাই শান্তির পায়রা ওড়াতাম। এখন আমাদের শক্তি আর ক্ষিপ্রতা বেড়েছে। তাই চিতা ছাড়ি। মানে শান্তি দুর্বলের ব্যাপার, শক্তিশালী মানে যুদ্ধ। এ প্রচার তো সর্বদাই চলে, শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শক্তিশালী দেশ তৈরি হচ্ছে। আগের ৬৭ বছরে কিস্যু হয়নি। যা হয়েছে, যা হচ্ছে এই ৮ বছরে।
মজার কথা হল, পায়রা অনেক পথ টানা উড়ে যেতে পারে। আর চিতা মাত্র ৩ সেকেন্ডে ০ থেকে ৯০ কিমি গতিবেগে পৌঁছে যেতে পারলেও একটানা সামান্য কয়েক সেকেন্ড ছুটতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টার্গেটকে কব্জাও করতে পারে না চিতা। স্বভাবগত ভাবেও চিতা ভীতু প্রাণী।
প্রধানমন্ত্রীর কথাটা শুনে, অনেক পুরনো একটা জোকসও মনে পড়ল। বাসের পেছনে লেখা, Nation is going ahead. তার নিচে লেখা, Horn please. এক বাঙাল দুটো লাইনের অনুবাদ করছেন, দ্যাশ আউগাইতাছে। প্যাঁক দাও।
অনেকে 'দেশপ্রেমী' রেগে যাবেন, জানি। কিন্তু একটা জিনিস ভাবুন তো, দেশ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হল কী হল না, তাতে পাবলিকের কী যায় আসে যদি না তাদের হাল ফেরে?
ফোর্বসের তালিকা অনুসারে, গৌতম আদানি ২০১৪ সালে ২.৮০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ নিয়ে দুনিয়ার ধনীদের তালিকায় ৬০৯ নম্বরে ছিলেন। ৮ বছর পর তাঁর সম্পত্তি বেড়ে এখন ১৫৫.৫ বিলিয়ন ডলার। সারা দুনিয়ার দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি আদানি। তাঁর সঙ্গে মোদীর গভীর সম্পর্কের কথা তো সবাই জানেন।
উপরের তালিকাটা দেখুন। স্বাধীনতার পর থেকে অসাম্য কমছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে বাজার অর্থনীতির রাস্তা ধরার পর থেকেই অসাম্য চড়চড়িয়ে বাড়তে শুরু করে। আর নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তা বাড়ছে চিতার গতিতে। (আরও অনেক তথ্য দিয়ে লেখা লম্বা করতে চাই না। উৎসাহীরা এসম্পর্কে অনেক লেখা ইন্টারনেটেও পাবেন।) ক্রমাগত অসাম্য বাড়তে থাকলে তা সভ্যতার সংকট তৈরি করে। জিডিপি-র অঙ্কে ভারত দুনিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু সেটাই তো আর অর্থনীতি ভাল না মন্দ সেটা মাপার একমাত্র মানদণ্ড নয়। আসল কথা হল, দেশের আমজনতা কেমন আছে?
হিসেব বলছে, কোভিড পর্বে গৌতম আদানির মোট সম্পদ বেড়েছে ১৮০৮ শতাংশেরও বেশি, দুনিয়ার যে কোনও ধনকুবেরের চেয়ে বেশি। মুকেশ আম্বানির বেড়েছে ১৮০৮%। উল্টো দিকে ৮৪% ভারতীয়ের আয় কমেছে। কোভিড পর্বে ধনকুবেরদের সম্পত্তি বেড়েছে ৩৯%। আর নতুন করে চরম দারিদ্রের মধ্যে চলে গিয়েছেন সাড়ে ৪ কোটির বেশি ভারতীয়, সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ।
তথ্য বলছে, এখন আমাদের দেশে অসাম্যের চেহারাটা ব্রিটিশ আমলের চেয়েও খারাপ। রিপোর্ট বলছে, দুনিয়ার যে সব দেশে অসাম্য বেশি মাত্রায় বাড়ছে, ভারত তার অন্যতম। একই সঙ্গে বাড়ছে দরিদ্র এবং সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা। মধ্যবিত্তের বিত্ত কমছে।
নরেন্দ্র মোদীর জমানায় গৌতম আদানিদের সম্পত্তি বাড়ছে চিতার গতিতে। অসাম্য বাড়ছে চিতার গতিতে। আর মোদী দাবি করছেন, তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের রাস্তায় হাঁটছেন। নেতাজির আর্থিক ভাবনার ভিত্তিটাই ছিল অসাম্য দূর করা। সুভাষ ছিলেন পরিকল্পিত অর্থনীতির পক্ষে।
ক্রনি ক্যাপিটালিজম নামে একটা শব্দ শোনা যায়। কাছের লোকদের কামানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া। বিমানবন্দর বেসরকারি হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ি জমানায়। মনমোহন সিং সরকারের আমলেও সেটা চলছিল। তখন শর্ত ছিল, অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলে টেন্ডার জমা দেওয়া যাবে না। তাতে তো গৌতম আদানি সুযোগ পাবেন না। তাই নিয়ম বদলে গেল। এবং ৬টি বিমানবন্দরেরই দখল পেল অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকা আদানির সংস্থা। টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই সরকারের পয়সায় বিমানবন্দরগুলোর আধুনিকীকরণের কাজও করে নেওয়া হয়েছিল। নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেসরকারিকরণের আগে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে কোনও কথা বলা হয়নি। অর্থমন্ত্রকের আপত্তিও কানে তোলা হল না।
ক্রনি ক্যাপিটালিজম অনিবার্য ভাবেই দুর্নীতির জন্ম দেয়। দিচ্ছেও। ধরা যাক ৬টা বিমানন্দরের কথা। ১৩৩০ কোটি টাকার সম্পত্তির দখল নিতে আদানিদের খরচ হয়েছে ৪৯৯.৮৪ কোটি টাকা। সরকারি সম্পত্তির মালিক জনগণ। সেই টাকা আদানিদের চুরি করতে দেওয়া হল। আর জনগণ যাতে তা দেখে তালি দেয় তার ব্যবস্থাও করা হল। টাকার অঙ্কে ওই দুর্নীতির কাছে রাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতি, গরু কয়লা দুর্নীতিও স্রেফ নস্যি। এই দুর্নীতির রাজনীতি থেকেই জন্ম নেয় বিলাসিতার রাজনীতি। সে সম্পর্কে অন্য লেখায় লিখেছি। পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন।
সব সরকারি সংস্থা বেচে দিলে সরকার কী করবে? যা করার তাই করছে। এখন কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের টাকায় চলা বিরাট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। আর নরেন্দ্র মোদী তার একমাত্র প্রোডাক্ট। তাঁকে ঘিরে অবিরত চলে নানা ইভেন্ট। সেসব পাঁচ কান করার জন্য আছে বিপুল খরচের একটা প্রচার ব্যবস্থা। অবিরাম মোদী-নামে মনে হয় কী কাণ্ডই না হচ্ছে দেশজুড়ে!
বিরোধীদের হাতে থাকা সরকার বিভিন্ন সময়ে ফেলে দিয়েছে কেন্দ্র। কংগ্রেসের অস্ত্র ছিল ৩৫৬ ধারা। অন্তত ৯৩ বার সে ভাবে রাজ্য সরকার ফেলে দিয়েছে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার। কিন্তু মোদীর বিজেপি যা করছে সেটা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেনি। গরিষ্ঠতার ধারেকাছে নেই। কিন্তু এমএলএ কিনে সরকার বানিয়ে ফেলছে বা বানানোর চেষ্টা করছে (যেমন অতি সম্প্রতি দিল্লি ও পঞ্জাবে হল)। কোথাও সরকার বানানোর জন্য দরকারি সংখ্যার এমএলএ আছে। তবু কিনছে (যেমন সম্প্রতি গোয়ায় হল)। সব মিলিয়ে বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে ২৮৫ জন এমএলএ কিনেছে। খরচ এমএলএ প্রতি গড়ে ২০-২৫ কোটি টাকা।
আগের সরকারগুলোর দেনার দায় এই সরকারের ঘাড়ে চেপেছে। তাই সুদের সঙ্গে সঙ্গে মূলধন শোধ করা শুরু হলেও মোট দেনা বাড়ছে।
বাজার অর্থনীতি সূচনার দুই চরিত্র। নরসীমা রাও এবং মনমোহন সিং |
আশির দশকে তুমুল হইচই হতো। সরকারি জায়গায় কিস্যু কাজ হয় না। সব বেসরকারি করে দিলেই সমাধান। খুব জোরাল ভাবে একটা ধারণা তৈরি করা হল। নব্বই দশকের শুরু থেকে বোঝা গেল তার কারণ। বাজার অর্থনীতি এলো। একটাই স্লোগান, বেচে দে। কারখানা, খনি, বন্দর, বিমানবন্দর...সব বেচে দে। 'আত্মনির্ভর ভারত' বানানোর ডাক দেওয়া নরেন্দ্র মোদী জমানায় সেই 'বেচে দে' চলছে চিতার গতিতে। তবে ক্ষতিতে চলা কোনও সরকারি সংস্থা বিক্রি করা হচ্ছে না। সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।আর বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে লাভে চলা সরকারি সংস্থাগুলো।
মোদী ও মনমোহন |
৮টি সার কারখানা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ২০২১ সালে ওই কারখানাগুলো মোট লাভ করেছে ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা। মানে দুধেল গরু বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। গেরস্থ কখন দুধেল গরু বিক্রি করেন? হাতে টাকা না থাকলে। দেশের অর্থনীতির কি সেই অবস্থা? নাকি মতলব অন্য?
প্রশ্ন হল, সরকারি সংস্থা সত্যি যদি খারাপ চলে, তাহলে লাভ হচ্ছে কী করে? সংস্থাগুলো সরকারের হাতে থাকলে লাভের একটা অংশ প্রতি বছর সরকারের তহবিলে আসত। তাতে জনকল্যাণের কাজ করা যেত। বেসরকারি হাতে গেলে তো তা হবে না।
মোদী ও নির্মলা সীতারমন |
তথ্য কিন্তু বলছে, ২০১৮-২১ এই তিন বছরে ৩.৯ লক্ষ ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। শুধু ২০২১ সালেই ১.৬৩ লক্ষ ভারতীয় নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। 'দ্যাশ আউগাইতাছে' কিন্তু দেশের লোক নাগরিকত্ব ছেড়ে দিচ্ছে?
মহারাষ্ট্রের সরকার দখলের পর মোদীর কাছে শিন্ডে ও দেবেন্দ্র |
তুমি যদি কেন্দ্রে দারুন সরকার চালাও তাহলে এমএলএ কিনে সরকার বানাতে হচ্ছে কেন? এমএলএ কিনতে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে বিজেপি। কেন? ক্ষমতায় কী মধু আছে? এমনি এমনি নিশ্চয়ই এতো টাকা খরচ করেনি।
তৃণমূল কংগ্রেসে মুকুল রায়ের প্রত্যাবর্তন |
আমাদের রাজ্যে এভাবে সদস্য কিনে জেলা পরিষদ, পুরসভা, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে তৃণমূল। ক্ষমতায় কী মধু সেটা তো আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি। বিজেপির ক্ষেত্রেও তাই। দরকার নেই, তবু তৃণমূল এমএলএ কিনেছে। বিজেপি-ও কিনছে। কারণ একচ্ছত্র ক্ষমতা চাই।
কে জোগাচ্ছে বিজেপির এমএলএ কেনার টাকা? যে সব 'বন্ধুদের' তাঁরা দেখেছেন ও দেখছেন, নিশ্চয়ই তাঁরাই জোগাচ্ছেন। ক্রনি ক্যাপিটালিজমের এটাই নিয়ম। তুমি আমাকে দেখো, আমি তোমাকে দেখব-রাজনীতি আর ব্যবসার অলিখিত চুক্তি। আর এ তো বিলকুল কালো টাকা। এই হল বিজেপির নীতির রাজনীতি! কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ! 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা'!
লকডাউনে বাড়ির পথে পরিযায়ী শ্রমিক |
এটা তো উন্নয়নের রাস্তা হতে পারে না। মোদীর চিতার গতির অর্থনীতি আসলে আম জনতাকে চিতায় তোলার ব্যবস্থা করছে। বছরে নাকি ২ কোটি চাকরি দেবেন! উল্টে তো মানুষ কাজ হারাচ্ছেন।
তাহলে রাস্তা কি?
সেই রাস্তা বন্ধে পরিকল্পিত প্রচার চলছে। এবং তাতে অনেক 'গরীবের পার্টি'ও সায় দিচ্ছে।
বোঝানো হচ্ছে, সরকারি সংস্থা মানে হাতি পোষা। তাই লাভজনক সরকারি সংস্থা জলের দরে বেসরকারি সংস্থার কাছে বেচে দাও। ক্ষতিতে চলা সরকারি সংস্থা বন্ধ করে দাও।
বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ বা ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া মানে খয়রাতি।
'লক্ষ্মীর ভান্ডার' মানে ভিক্ষা দিয়ে মানুষ কেনা।
পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাস, সারের ভর্তুকি তুলে দাও। ওগুলো সব বাজে খরচ। খয়রাতি!
কর্পোরেটের কর কমিয়ে দাও। বড় বড় কোম্পানির লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ মকুব করে দাও। নইলে ব্যবসা বাড়বে না। ললিত মোদী-নীরব মোদী-মেহুল চোকসিদের ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যেতে দাও। না, না, এসব মোটেই পাবলিকের পয়সা জলে দেওয়া নয়। এসব মোটেই খয়রাতি নয়। নাহলে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাড়বে কী করে? আমরাও অনেকে সেই প্রচারে বিশ্বাস করি।
দিল্লির স্কুলপড়ুয়াদের সঙ্গে অরবিন্দ কেজরিওয়াল |
হিংসামুক্ত রাজনীতি আর বাধাহীন উন্নয়ন। দুই দশক আগে যে রাজনীতির কথা বলেছিলেন প্রয়াত সৈফুদ্দিন চৌধুরী। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে সেই ভাবনাই একমাত্র রাস্তা। ক্ষমতাসর্বস্ব, দুর্নীতিপ্রধান রাজনীতির অনিবার্য অঙ্গ হিংসার রাজনীতি। এখানে হিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া বাধাহীন উন্নয়নের রাস্তা তৈরি করা সম্ভব নয়। একে অন্যের পরিপূরক।
উন্নয়নের বিকল্প কিছু মডেল নিয়ে পরীক্ষা চলছে দিল্লি, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, তেলঙ্গনায়।
দিল্লির কথা ধরা যাক।
৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ।
সরকারি স্কুলে আধুনিকতম পদ্ধতিতে লেখাপড়ার ব্যবস্থা। শিক্ষকদের বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানো।
প্রয়োজন এই রাজনীতি। ওপর ওপর ওপর থেকে ওপরের রাজনীতি নয়। নিচ থেকে নিচের মহলের জন্য রাজনীতি। যদি দেখা যায়, এলাকার সব সেরা বাড়িটা কোনও নেতার নয়, সেটা স্কুলবাড়ি, যেখানে আমার সন্তান পড়াশোনা করতে যায়, মানুষের মনোভাব পাল্টে যাবে। আমাদের কিস্যু হবে না, এই ভাবনা ছেড়ে জন্ম নেবে আমরাও পারি, এই ভাবনা।
টাকা আসবে কোথা থেকে? দিল্লির উদাহরণ দেখা যাক।
২০১৫ সালে দিল্লি সরকারের বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা। এবছর সেটা বেড়ে হয়েছে ৭৮, ৫০০ কোটি টাকা। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন, স্রেফ সরকারি স্তরে দুর্নীতি কমিয়ে বাজেট বরাদ্দ প্রায় আড়াই গুণ বাড়াতে পেরেছেন তাঁরা।
সে তো না হয় বোঝা গেল। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়া যে দিল্লি বিধানসভায় পেশ হওয়া সিএজি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বলছে, দিল্লি সরকারের মোট দেনা ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে ছিল ৩২,৪৯৭.৯১ কোটি টাকা। সেটা বেড়ে ২০১৯-২০ সালে হয়েছে ৩৪,৭৬৬.৮৪ কোটি টাকা। দেনা করে বিরিয়ানি খাওয়ার মানে কি? এজন্যই প্রধানমন্ত্রী বারবার সাবধান করে দিচ্ছেন, খয়রাতির রাজনীতি সর্বনাশ ডেকে আনবে।
আসলে ওই সব মিডিয়া সিএজি রিপোর্টের আরেকটা অংশ চেপে যাচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতি বছর দিল্লি সরকারের বাজেট উদ্বৃত্ত হচ্ছে মানে ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। তারপরও উদ্বৃত্ত বাজেট! তার মানে আয় বেড়েছে যথেষ্ট।
এই মডেল নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তবে মোদীবাবুদের 'বেচে দে' মডেলের বিকল্প রাস্তার খোঁজ দিতে পারে এই মডেল। এটাকে বলা যেতে পারে পপুলিজমের রাজনীতি। বলা যেতে পারে, একচেটিয়া বাজার অর্থনীতির যুগে এ হল জনকল্যাণকামী সরকারের একটা পরীক্ষা। একটা মডেল যেখানে সম্পদের ক্রমাগত কেন্দ্রীভবন চলছে। মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাতে সভ্যতা সংকটে পড়ছে। তার পাল্টা এই পপুলিজমের মডেল।
পাল্টা মডেল, মানুষের হাতে টাকা দাও। তার কেনার ক্ষমতা বাড়াও। 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' নিয়ে অনেকে নাক কুঁচকোতে পারেন, কিন্তু ওই রাস্তায় মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়ে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির দল আদ্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। সরকারি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক দুর্নীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর দলের লোকেদের দুর্নীতি। তাই সরকারি স্তরের দুর্নীতির রাশ টেনে কেজরিওয়াল বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে পারলেও, উদ্বৃত্ত বাজেট করতে পারলেও মমতা ব্যানার্জির পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' থেকে যাচ্ছে স্রেফ ভোট কুড়নোর অস্ত্র হিসেবে। তার টাকা জোগাতে গিয়ে রাস্তা-সেতু বানানোর টাকা নেই, হাসপাতালে ওষুধ নেই, বাস চালানোর তেল নেই, অবসর নেওয়ার পর সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য মেটানো যাচ্ছে না, সরকারি কর্মচারিদের ডিএ দেওয়া যাচ্ছে না।
সেই বিকল্প পথ দেখাতে পারছে না বলেই যা নয় তাই বলছেন তৃণমূল নেতারা। অন্ধ মোদী বিরোধিতা করতে গিয়ে লোক হাসালেন তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার।
মমতা পারবেন না। তা বলে পপুলিজমের অর্থনীতির মডেল ভুল, সেটা বলাটাও ভুল। উন্নয়নের এলিট ভাবনা ছেড়ে এরকম ভাবনার অভ্যাস গড়ে তোলা খুব কষ্টের?
policy making এর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, তথা সরকার শেষ কথা হতে পারে না। একইভাবে যেমন সরকার কৃষি bill প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলো সামাজিক সংগঠনের চাপে, তেমনি গুরুত্ব পূর্ণ বিল গুলিকে বাধ্যতা মূলক ভাবে সামাজিক সংগঠন দ্বারা পাস করাতে হবে। রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের আরো বেশি করে রাজ্য সভার সদস্য করা উচিত।
ভোটে যতদিন না এই বিপুল টাকার ব্যাবহার বন্ধ না হয়, এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান policy makin এ পরোক্ষে সরকারের নীতি নির্ধারণ করে, ততদিন সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই।
সুমন