link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

স্বাধীনতার লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা ছিলেন? #Role-of-Communists-in-Indian-independence-struggle

সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ
‘চুপকে চুপকে রাত দিন’। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া বি আর চোপড়ার ‘নিকাহ’ সিনেমায় গেয়েছিলেন পাকিস্তানের গজল সম্রাট ওস্তাদ গোলাম আলি। কে লিখেছিলেন সেই গান?
মওলানা হসরত মোহানি।
সৈয়দ ফজল উল হাসান কবিতা লিখতেন মওলানা হসরত মোহানি ছদ্মনামে। ইসলামী দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রে সুপন্ডিত মোহানি ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। প্রায় প্রতি বছরই জন্মাষ্টমীর দিন তিনি মথুরায় যেতেন। কৃষ্ণ-প্রেম নিয়ে উর্দু ও হিন্দিতে লেখা তাঁর অনেক কবিতা ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে।
মোহানিরই সৃষ্টি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। দুটো ফারসি শব্দ জুড়ে, বাংলা অর্থ ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। স্লোগানটা তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল আইনসভায় ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত বোমা ছুড়ে উচ্চারণ করেছিলেন সেই স্লোগান, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তার আগে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের চৌহদ্দিতে ছিল সেই স্লোগান।
মওলানা হসরত মোহানি ও বিআর আম্বেদকর
বালগঙ্গাধর তিলকের অনুগামী মোহানি জেলে যান ছাত্রজীবনেই। বিয়ে করেন। নিজের মেয়ের অসুস্থতার সময় ব্রিটিশের কথামতো প্যারোলের আবেদন করেননি। শিশুকন্যাকে জীবিতও দেখতে পাননি। আসফাকুল্লাহ খান, প্রেম কৃষ্ণ খান্না, রামপ্রসাদ বিসমিলের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন তাঁর শিষ্য। 
স্বামী কুমারানন্দ
১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে প্রথমবার পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ওঠে। দাবি তোলেন মওলানা হসরত মোহানি এবং স্বামী কুমারানন্দ। দু'জনেই ছিলেন কমিউনিস্ট। ওই অধিবেশনেই প্রচারিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত 'প্রকৃত স্বাধীনতার ইশতেহার।' প্রস্তাবের বিরোধিতা করে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি আমাকে বেদনা দিয়েছে, কারণ প্রস্তাবটি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।’ (সূত্র: সত্যেন সেনের লেখা 'পনেরোই অগাস্ট' এবং ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোর্তজার লেখা 'বজ্রকলম')। গান্ধীবাদী কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবধারার তফাৎ তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়।
সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার
১৯২২ সালে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে ফের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব তোলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। সেই প্রস্তাবও গৃহীত হয়নি।
১৯২৮ সালে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে কলকাতার পার্ক সার্কাসে। মুজফ্ফর আহমেদ, বঙ্কিম মুখার্জি, রাধারমণ মিত্র, আবদুল হালিমের মতো কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে হাজার পঁচিশেক শ্রমিক শহিদ মিনার থেকে মিছিল করে অধিবেশন স্থলে যান। প্রথমে বাধা দিলেও পরে শ্রমিকদের ঢুকতে দিতে বাধ্য হন কংগ্রেস নেতৃত্ব। 
মতিলাল ও সুভাষ। কলকাতা, ১৯২৮

সুভাষ চন্দ্রও তাঁদের সাহায্য করেছিলেন। সেসময় শ্রমিকরা পূর্ণ স্বরাজকে লক্ষ্য ঘোষণার দাবি জানিয়ে স্লোগান তোলেন, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা চাই’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘লাল ঝান্ডার জয়’ ইত্যাদি।
১৯২৯ সালে লাহোর অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেস। ইতিহাস বইয়ে লেখা হয়, মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরুর ভূমিকার কথা। আড়ালেই রেখে দেওয়া হয় তার আগের ঘটনাক্রম। আড়ালেই রেখে দেওয়া হয় ভারতের কমিউনিস্টদের ভূমিকার কথা। আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কংগ্রেস ছিল একটা মঞ্চ। বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন পার্টির মানুষ সেখানে ছিল। সেই মঞ্চে কমিউনিস্টরাও ছিলেন।
লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত
একটা অতি পরিচিত ধারণা হল, এদেশের কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেননি, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশকে সাহায্যও করেছেন। আমার এক সহকর্মী খানিকটা ব্যঙ্গের সুরে বলছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস এবং কমিউনিস্ট পার্টি কোনও ভূমিকাই পালন করেনি। একটুও আশ্চর্য হইনি। সেভাবেই আমাদের ইতিহাস শেখানো হয়। 
আমরা যে ইতিহাস পড়ি তা রাজা সম্রাট সুলতান নেতাদের ইতিহাস। মানুষের গল্প বলে না সে ইতিহাস। ইতিহাস আমাদের শোনায় না, আদিবাসী-দলিত-শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলনের কথা। প্রথমে কংগ্রেসের এলিট নেতৃত্ব, পরে মহাত্মা গান্ধীর পছন্দ ছিল না ওইসব আন্দোলন। বালগঙ্গাধর তিলক-লালা লাজপত রায়-বিপিনচন্দ্র পালের মতো সামান্য কিছু নেতা ব্যতিক্রমী ছিলেন। 
লেনিন ও গোর্কির সঙ্গে এম এন রায়
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কেমন প্রভাব ফেলেছিল? শিবরাম চক্রবর্তী 'মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি বইটা পড়লেই ছবিটা খানিকটা স্পষ্ট হবে। রুশ বিপ্লব প্রভাব ফেলে রবীন্দ্রনাথে মতো চিন্তাবিদদের চেতনাতেও। ১৯২০ সালে তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে। তাঁরা বাংলার অনুশীলন ও যুগান্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কলকাতায় মুজফফর আহমেদ, বোম্বাইয়ে এস. এ. ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, কানপুরে সওকত উসমানি এবং লাহোরে গুলাম হুসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছোট ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। 
সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সস্ত্রীক এম এন রায়

১৯২০ সালের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের শেষ করতে একের পর এক মামলা শুরু করে। পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। ব্রিটিশের অভিযোগ ছিল, 'কমিউনিস্টরা একটি সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্রাটকে ব্রিটিশ ভারতের সার্বভৌমত্ব থেকে বঞ্চিত করার' ষড়যন্ত্র করছে। কোনও রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে কখনও এত কড়া অভিযোগ তোলেনি ব্রিটিশ সরকার। 
মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দিরা
১৯২০ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ করে রেখেছিল ব্রিটিশরা। অন্য পার্টির মধ্যে থেকে (বিশেষত ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজেন্টস পার্টি-WPP, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি-CSP) কাজ করতেন কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা। গান্ধীর আপোষ আলোচনার পথে স্বাধীনতা অর্জনের পরিবর্তে কমিউনিস্টদের ঘোষিত অবস্থান ছিল, খেটে খাওয়ার রাজ প্রতিষ্ঠা। সেই লক্ষ্যে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রদের সংগঠিত করার ওপরেই তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিতেন। 
লাল-বাল-পাল

শ্রমিকদের প্রথম সর্বভারতীয় সংগঠন এআইটিইউসি গড়ে ওঠে ১৯২০ সালে। তার মূল চরিত্র ছিলেন লাল-বাল-পাল। পরবর্তীতে কমিউনিস্টরা সেই সংগঠনের হাল ধরেন। ১৯৩৬ সালে কৃষক ও ছাত্রদের সর্বভারতীয় সংগঠন তৈরি হয় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে, তবে তা আজকের সময়ের মতো কমিউনিস্ট পার্টির লেজুড় ছিল না। ছিল প্রকৃত অর্থেই গণ সংগঠন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ
কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ধর্মঘটের ঢেউ উঠতে থাকে সারা দেশজুড়ে। সেসব আন্দোলনের কথা ইতিহাস আমাদের জানায় না। সেসব আন্দোলন গান্ধীজির রাস্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল। কংগ্রেসের ভেতর বামধারার রাজনীতির দুই প্রধান মুখ ছিলেন সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল। সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে কমিউনিস্টদের বিরোধের নানা গল্প শোনানো হয়। (সে ব্যাপারে এখানে বিস্তারিত বলতে চাই না। পরবর্তীতে বিস্তারিতে আলোচনার ইচ্ছে রইল।) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্টদের তৈরি যুদ্ধ বিরোধী মঞ্চের প্রধান ছিলেন সুভাষ। সুভাষের দেশ ছাড়ার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কমিউনিস্টরা। স্বাধীন ভারতের ধারণা সম্পর্কে সুভাষ আর কমিউনিস্টদের ভাবনা ছিল মোটের ওপর একরকম। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচারের সময়ও আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন কমিউনিস্টরা।
নৌ বিদ্রোহ। ১৯৪৬
ব্রিটিশের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ক্ষমতার হাতবদল যখন অনিবার্য সেসময় শুরু হয় নৌ বিদ্রোহ। বম্বে উপকূলে আছড়ে পড়া সেই বিদ্রোহ নৌ বিদ্রোহ ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকলে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল নৌ সেনাদের আত্মসমর্পণের কথা বলেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার কড়া পদক্ষেপ করবে না। গান্ধীজি বলেছিলেন, নৌবাহিনীর চাকরি না পোষালে তাঁরা যেন চাকরি ছেড়ে দেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। 
মুম্বইতে নৌবিদ্রোহের স্মারক
একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি বিদ্রোহের সমর্থনে এগিয়ে আসে ও বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অরুণা আসফ আলি ছিলেন ব্যতিক্রম। বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণের কথা জানালে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ নৌবাহিনীর জাহাজগুলিকে ঘিরে ফেলে নৌসেনাদের গ্রেফতার করে এবং তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। বিদ্রোহের নেতা এস.এস খানের পায়ে পাথর বেঁধে তাঁকে আরব সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। তখন বিলকুল চুপ ছিলেন প্যাটেল-গান্ধী-নেহরুরা। 
তেলঙ্গনা কৃষক সংগ্রাম ১৯৪৬-১৯৫১
সেই সময় তেভাগা, তেলেঙ্গানার মতো ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনও হয় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বেই।
বিটি রনদিভে, গঙ্গাধর অধিকারী, পিসি যোশী
এস ভি ঘাটে, এস ভি দেশপান্ডে, ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী, পি সি যোশী, বি টি রণদিভে, অজয় ঘোষ, সি রাজেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, এ বি বর্ধন, পি সুন্দরাইয়া, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এইচ কে এস সুরজিৎ...কেউ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, কেউ বিভক্ত সিপিআই বা সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গুগল বা ইতিহাস জানিয়ে দেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের কী ভূমিকা ছিল।
মাস্টারদার তিন শিষ্য অনন্ত-অম্বিকা-গণেশ
ভগৎ সিংয়ের সঙ্গী শিব বর্মা, জয়দেব কাপুর, অজয় ঘোষ ও কিশোরীলাল, সূর্য সেনের সঙ্গী গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্ত, অনন্ত সিং, সুবোধ রায়, অম্বিকা চক্রবর্তী, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসির রানী ব্রিগেডের প্রধান লক্ষ্মী সায়গল, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের অন্যতম উদ্যোক্তা মেজর জয়পাল সিং, কংগ্রেসের বর্ধমান জেলা সভাপতি বিনয় চৌধুরী---স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ধারা মিলিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিতে। এরকম হাজার হাজার নাম বলা যায়। সেলুলার জেলে বন্দী থাকা নেতাদের অধিকাংশই বাইরে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তখনও তো দেশ স্বাধীন হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি দেশবিরোধী হলে পরীক্ষিত স্বাধীনতা যোদ্ধারা কেন দলে দলে তাতে যোগ দিলেন?
সম্প্রীতির পক্ষে লাহোরে
উল্টোদিকে, আজ দেশপ্রেমের ঢাক পেটানো আরএসএস ও সংঘ পরিবার? কেউ নেই। বিডি সাভারকার তাঁর বিপ্লবী চরিত্র সেলুলার জেলে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলেন। আর কোনও নাম নেই। থাকার কথাও নয়। দ্বিতীয় সংঘপ্রধান মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার বলেছিলেন, 'হিন্দুরা ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াই করে শক্তি খরচ না করে,আসল শত্রু মুসলমান-খ্রিস্টান আর কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করো।' সত্যি সত্যি সংঘের লোকেরা তাই করেছিলেন। এখন চলছে দেশপ্রেম নিয়ে তাঁদের কুমিরের কান্না। আদর্শের জগতে সৎ হলে তো নরেন্দ্র মোদীদের মিথ্যার বিরাট ফানুস ফোলাতে হত না। 
নাথুরাম ও সাভারকার

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যি ইতিহাস জানলে দেখা যাবে, সংঘ পরিবারের মতো বেইমানি কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করেনি। অন্যদিকে সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর বেশিরভাগই সংগঠিত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘিরে। কমিউনিস্ট পার্টিকে বেশির ভাগ সময়টাই নিষিদ্ধ করে রেখেছিল ব্রিটিশ। কিন্তু আরএসএস বা হিন্দু মহাসভাকে এক দিনের জন্যও নিষিদ্ধ করেনি।
কল্পনা দত্ত
আমার ব্যক্তিগত মত, দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা শুরু থেকেই মার্কসবাদকে দেশের বাস্তবতা-ইতিহাস-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বদলে বিদেশী মডেল নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মওলানা হসরত মোহানির কথা আগেই বলেছি। তাঁর মধ্যে ভারতবর্ষ নামক বৈচিত্র্য যেন ফুটে উঠেছিল। তিনি ধর্মকে অস্বীকার না করে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। শোনা হয়নি। আমার মতে, আমাদের দেশে ধর্মকে অস্বীকার করে চলা আত্মহত্যার সামিল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বলা হয়, সনাতন ভারতবর্ষ আধ্যাত্মবাদী দর্শনের কেন্দ্র। বাস্তব তো অন্য কথা বলে। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন, সমৃদ্ধ বিজ্ঞান চর্চা তো উল্টো কথাই বলে। বস্তুবাদী দর্শনের চর্চা না থাকলে  কী ভাবে চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত বিজ্ঞান বা অর্থশাস্ত্রে উজ্জ্বল ছিল প্রাচীন ভারত? কমিউনিস্ট মতাদর্শের ভিত্তিও এই বস্তুবাদ। পরবর্তীতে দেশের বস্তুবাদী দর্শনের চর্চা সম্পর্কে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। 
শিবরাম চক্রবর্তী
শিবরাম চক্রবর্তীর 'মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী' বই পড়লেও দেশের বস্তুবাদী দর্শন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগর বা শিবরাম কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না।
দুর্ভাগ্য ভারতের ঐতিহ্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এ দেশে কমিউনিস্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠার বদলে রুশ বা চিনা ভাবনায় চলার অভ্যাসটাই প্রকট। তাতে ভারতের মানুষের মননে মার্কসবাদ একটা বিদেশী মতবাদ হিসেবেই থেকে গেছে। তাই সনাতন ধর্ম মানে হিন্দুত্বর মতই আরও এক মিথ্যা প্রচার মানুষের মনে বাসা বেঁধে আছে, ভারত আধ্যাত্মবাদী দেশ। এখানে বস্তুবাদী ভাবনার কোনও জায়গা নেই।
কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিন্টার্নের নির্দেশও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতি করেছে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের। 
নেতাজি সম্পর্কে কার্টুন

এসবের পরিণতিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীনতার আগে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। স্বাধীনতার মুহূর্তে আরেক বিপজ্জনক স্লোগান তোলা হয়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।
মুক্তচিন্তাকে উৎসাহিত করার বদলে মার্কস-লেনিনদের ঈশ্বর বানিয়ে গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকার ধারাবাহিক প্রবণতাও ক্ষতির কারণ হয়েছে বলে মনে হয়।  
প্রশ্ন করতেই পারেন, হঠাৎ এসব নিয়ে ভাটাচ্ছি কেন? তা-ও ছাড়া ছাড়া।
আসলে এই মুহূর্তে আমাদের দেশ, আমাদের দুনিয়া, আমাদের সভ্যতা মারাত্মক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেশে ভিত ক্রমশ শক্তিশালী করছে ফ্যাসিবাদ।
তুমুল আর্থিক সংকট ফ্যাসিবাদের উত্থানের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। নীতি-নৈতিকতাহীন, ক্ষমতাসর্বস্ব  রাজনীতি, যা রাজনীতি সম্পর্কেই মানুষের মনে ঘৃণা তৈরি করে, এরকম পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদের জমিকে উর্বর করে। তার সঙ্গে দুর্বল, দিশাহীন বাম (আরও নির্দিষ্ট করে বললে, দুর্বল দিশেহারা কমিউনিস্ট আন্দোলন) ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত।
এই সময় তিনটি উপাদানই আমাদের দেশে প্রকট।
বিলকিস বানো ও ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর ধর্ষকদের বরণ
আরএসএস বা বিজেপি ভয় পায় শুধু কমিউনিস্ট মতাদর্শকে। সংঘ পরিবারের কাছে রাজনীতি মোটেই ক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তাদের লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাই তাঁদের সবচেয়ে বেশি ভয় মার্কসবাদী শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতিতে, যার লক্ষ্য খেটে খাওয়ার রাজ প্রতিষ্ঠা। সে কারণেই একদিকে যেমন সংঘ পরিবারকে দেশপ্রেমী প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা চলছে, তেমনই কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহী প্রমাণের চেষ্টাটাও আরও জোরদার হচ্ছে।
দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, আমাদের দেশে এই সময় কমিউনিস্ট আন্দোলন ভয়াবহ রকমের দুর্বল ও দিশাহারা। কমিউনিস্ট পার্টি বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বাহিনীকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত শিক্ষায় শিক্ষিত করার বদলে ভোট রাজনীতির টি-টোয়েন্টিতে ব্যস্ত। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি বলে পরিচিত পার্টিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সিপিএম এখন ব্যস্ত রাজ্যকে দুর্নীতিমুক্ত করার ব্রতে। কী আশ্চর্য, স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। 
যাঁরা শ্রেণি রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তাঁরা জানেন, মুনাফা সর্বস্ব আর্থিক ব্যবস্থাই দুর্নীতির উৎস। তার একমাত্র প্রতিষেধক হল অধিকারের লড়াই। বিজেপি অঙ্ক কষেই একে সামনে নিয়ে আসছে। আড়ালে চলছে তাদের আসল খেলা। তাতে নাচছে বাম বলে নিজেদের দাবি করা রাজনৈতিক পার্টি।
যাঁরা শ্রেণি রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তাঁরা জানেন, অসহিষ্ণুতা-বিদ্বেষ-সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কবজা করা-সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ-বিরুদ্ধ মতকে দুমড়ে দেওয়া-কুসংস্কারকে প্রশ্রয় - এগুলোই এই সময় দেশের মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, দেশের সংবিধানকে, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অর্জনগুলিকে রক্ষা করা। একমাত্র সেই লড়াইই দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে শক্তিশালী করার সঙ্গেই রাজ্যেও তৃণমূলকে দুর্বল করতে পারে।
সেলিম ও আব্বাস

বাম বলে দাবি করা পার্টিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে আব্বাস সিদ্দিকির মতো মৌলবাদীর সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিধা করে না। সিপিএম সলমন রুশদির উপর হামলার নিন্দা করে বিবৃতি দিলেও দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অনায়াসে বলে দেন, ‘এই খবর প্রথম পাতার নয়। সলমন রুশদি গত কয়েক বছরে খবরের শিরোনামে ছিলেন না। উনি বিতর্কেও ছিলেন না।’ সেলিমের মতে, রুশদির মতোই এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন তসলিমা নাসরিনও, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ইদ্রিস আলিদের নেতৃত্বে মৌলবাদীদের অশান্তির পর যাঁকে কলকাতা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। হামলাগুলোর সঙ্গে মুসলিম মৌলবাদীরা যুক্ত বলেই কি নিন্দায় আপত্তি সেলিমদের? মুসলিম মৌলবাদ তো হিন্দু মৌলবাদের বন্ধু।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, খেটে খাওয়ার লড়াই মানে মায়ের হাতের রাঁধা ভাত। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, লক্ষ্যপূরণে আন্তরিক পরিকল্পনা, পরিশ্রম, ভালবাসা, মমত্বের মিশেল। ভোটসর্বস্ব, তাৎক্ষণিক রাজনীতিতে সে মোক্ষ লাভ অসম্ভব। জানেন না, কমরেড?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad