link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

ঋদ্ধিমান বাংলা-ছাড়া, উদাসীন সৌরভ এবং নির্বিকল্প সমাধিতে যাওয়া বাঙালি #Wriddhiman-Sourav-Bengali

২০০৮। অষ্টমীর দিনই বিসর্জনের বাজনা। আর না। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৪ টেস্টের সিরিজের পরই আলবিদা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
১৯৯৬ থেকে ধরলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২ বছরের দাদাগিরি। 
১১ বছর। সৌরভ গাঙ্গুলির (Sourav Ganguly) পর সবচেয়ে বেশি দিন বাংলা থেকে জাতীয় দলে খেলেছেন ঋদ্ধিমান সাহা (Wriddhiman Saha)। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। শ্রীলঙ্কা সফরের দল থেকে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হল।
অবসরের সময় সৌরভ ছিলেন ৩৬। বাদ পরার সময় ঋদ্ধি ৩৭।  
১১ বছর টিমে থাকা ঋদ্ধি মাত্র ৪০ টেস্ট আর ৯ ওয়ান ডে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ঋদ্ধি যখন টিমে আসেন ধোনি (MS Dhoni) তখন মধ্য গগনে। তার মধ্যেই মাঝেমাঝে সুযোগ। ধোনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার পর ঋদ্ধি টিমে নিয়মিত হলেন এবং জাত চেনালেন। শো অফ নেই, চুপচাপ থাকেন, প্রচারের আলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবু দুনিয়ার ক্রিকেট বলল, 'সুপারম্যান' ঋদ্ধিই দুনিয়ার সেরা উইকেটকিপার। 
২০১৮ থেকে টিমে ঋষভ পন্থ। আবার ঋদ্ধি টিমে অনিয়মিত। 
অবশেষে শেষের ঘণ্টা বেজে গেল ২০২১ সালে। 
তারপরেই আচমকা বিস্ফোরণ। 
ঋদ্ধি জানালেন, ১৪ জানুয়ারি কেপ টাউনে তৃতীয় টেস্ট শেষের পর হোটেলে কোচ রাহুল দ্রাবিড় নিজের ঘরে ডেকে বলেন, তাঁরা নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন। দ্রাবিড় অবসর নেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।
'মনে হয় না এটা ওঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। নির্বাচক কমিটি, বোর্ড প্রেসিডেন্ট সবাই নিশ্চয়ই জানতেন।' রঞ্জি ট্রফির দল বাছাইয়ের দু'দিন আগে নির্বাচক কমিটির প্রধান চেতন শর্মা ফোন করে জানতে চান, তিনি রঞ্জি খেলছেন কিনা। তিনিও বলেন ঋদ্ধির বদলে অন্য কাউকে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। 'বললেন, তুই শ্রীলঙ্কা সিরিজে থাকবি না। জানতে চাই, তারপর? উনি বলেন, তোকে আর জাতীয় দলে ভাবা হবে না।'
দ্রাবিড়, চেতন দুজনই বলেছিলেন, পারফরম্যান্স বয়স বা ফিটনেসের জন্য নয় - নতুনদের সুযোগ দিতেই ঋদ্ধিকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
'কাঁধে অস্ত্রোপচারের পর আমি টিমে নিয়মিত ছিলাম না। পন্থকে নিউজিল্যান্ড সিরিজে ছুটি দেওয়ায় আমি খেলেছিলাম। কানপুরে চোট নিয়েও ৬১ রানের ইনিংস খেলার পর দাদি (সৌরভ) হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল- আমি যতদিন আছি তোকে টিমে থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তার পরের সিরিজেই চিরদিনের জন্য ছেঁটে ফেলা হল। একটা সিরিজে কী এমন হল? আমার বয়স কি হঠাৎই বেড়ে গেল নাকি?’
বোর্ড সভাপতির সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলে ফেললেন। যাঁকে বিতর্কে দেখা যায় না, জটিলতায় নেই, কথাও বলেন কম, ঠাণ্ডা মাথার বলে পরিচিত, নিজেকে প্রচারের বাইরে রাখতে অভ্যস্ত, অনেক বঞ্চনার পরও মুখ বুজে থাকা ঋদ্ধির ধৈর্যের বাঁধ বোধহয় ভেঙে গেল অনেক অভিমানের ধাক্কায়, ৩৭ বছরে এসে। 
অবসরের অনেক পরে সৌরভও তাঁর যন্ত্রণা, অপমান, উপেক্ষার কথা লিখেছেন। ২০০৫ থেকেই নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গেছে সৌরভের ক্যারিয়ার। অধিনায়ক থেকে বাদ। টিম থেকে বাদ। আবার ফিরে আসা। আবার ক্যাপ্টেন। আবার বাদ। তারপর তিতিবিরক্ত হয়ে, অবসর।
সৌরভের সঙ্গে ঋদ্ধির তুলনা হয় না। 
ঠিকঠাক মত ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস লেখা হলে তাতে সৌরভকে নিয়ে একটা বড় অধ্যায় (সবচেয়ে বড়ও হতে পারে) থাকতেই হবে। 
ব্যাটসম্যান সৌরভ, বোলার সৌরভ, এমনকি ক্যাপ্টেন সৌরভের চেয়েও ঢের ঢের ভাল রেকর্ড অন্যদের আছে। বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট, প্রথম সিরিজ জেতা এসব ব্যাপারে 'বাচ্চা ক্যাপ্টেন' মনসুর আলি খান পতৌদির কাছে সবাই বাচ্চা। ক্যাপ্টেন সৌরভ কোনও বিশ্বকাপ জেতেননি। কপিল জিতেছেন। ধোনি জিতেছেন দুটো বিশ্বকাপ আর মিনি বিশ্বকাপ। টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানে সচিন, দ্রাবিড়, গাভাসকার, লক্ষণ, এমনকী শিষ্য সেহবাগেরও পরে সৌরভ। ওয়ান ডে ক্রিকেটে সচিন, কোহলির পরে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি সংখ্যায় সচিন-কোহলি- দ্রাবিড়-রোহিতের পরে সেহবাগের সঙ্গে যৌথভাবে ৫ নম্বরে সৌরভ। নাহ্, কোনও রেকর্ডে সৌরভ এক নম্বর নন। 
টিম থেকে বাদ গিয়ে কামব্যাক, তাতে সৌরভের চেয়েও এগিয়ে মহিন্দার জিমি অমরনাথ। তাহলে  সৌরভ টিম থেকে বাদ গেলে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয় কেন? এমনকি বাঙালিও এক বাঙালির জন্য রাস্তায় নামে! লোকসভাতেও ঢুকে পড়ে সেই প্রসঙ্গ। 
আসলে সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেটকে নতুন জীবন দিয়েছেন। 
ম্যাচ ফিক্সিং ঝড়ে টালমাটাল ভারতের ধর্ম বনে যাওয়া ক্রিকেট তরণী। হাল ছেড়ে সরে গেলেন ভারতীয় ক্রিকেটের 'ঈশ্বর' সচিন তেন্ডুলকারও। ঠিক তখনই হাল ধরলেন এক বাঙালি, মাছ ভাত খাওয়া নরম-সরম জাতি হিসেবে যার পরিচিতি।
ক্রিকেটকে তখন কেউ বিশ্বাস করে না। সব রেজাল্টই আগে থেকে ঠিক করা, মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা। খুঁজে খুঁজে বের করলেন হরভজন-যুবরাজ-সেওয়াগ-জাহির-কাইফ-গম্ভীর- ধোনিদের। তাঁদের ভরসা দিলেন। খেল। আমি আছি। টিম থেকে বাদ পড়বে না। একে একে নতুন নতুন তারকার জন্ম হতে শুরু করল। আবার মানুষ ক্রিকেটে আশ্রয় খুঁজে পেল। পৃথিবীতে দেশের দাদাগিরি মানে তো ক্রিকেট। ভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াল ক্রিকেট, ভারতের নতুন ধর্ম। ক্যাপ্টেন সৌরভের হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটের পুনর্জন্ম ঘটল। 
লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি ওড়ানো, স্টিভ ওয়াকে টসের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা...কখনও কখনও এরকম বেয়াদপি দরকার হয় হিম্মতের পতাকা ওড়াতে। 
সৌরভ চাইলে পারতেন আরও অনেকের মত শুধু নিজের ব্যাটিংয়ে মন দিতে। তাতে অনেকের অনেক কীর্তিই মুছে যেত।
সৌরভ করেননি। তাই সৌরভ টিম থেকে বাদ গেলে বিক্ষোভ হয়। তাই ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সৌরভের ভূমিকার কথা লিখতে বিরাট চ্যাপ্টার লাগবে।
জ্যোতি বসু ও সৌরভ গাঙ্গুলি। জন্ম ৮ জুলাই
বাঙালি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। এবং হয়েই যাচ্ছে। জাতীয় ক্ষেত্রে তার প্রভাব ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসতেই বাঙালি লাফিয়ে উঠেছিল। তারপর সৌরভ। 
দেশের মঞ্চে একই তারিখে জন্ম নেওয়া দুই প্রজন্মের দুই বাঙালির 'দাদাগিরি'। কোণঠাসা হতে থাকা বাঙালি তাঁদের ভরসাতেই সারা দেশকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল। 
জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। বাংলার মনের কথা শোনেনি সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি।
সৌরভের ক্ষেত্রেও তাই? ঘটনা বলছে, তা নয়। ছিয়ানব্বইয়ে সৌরভ টিমে ঢুকেছিলেন স্রেফ পারফরম্যান্সের জোরে? বোর্ড সচিব জগমোহন ডালমিয়া ও পূর্বাঞ্চল থেকে নির্বাচক কমিটিতে থাকা সম্বরণ ব্যানার্জির হাত ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল? 
সৌরভকে সব সময় আগলে রাখতেন জগমোহন ডালমিয়া। সৌরভ বাদ পড়লে সিএবি চাপ দিয়েছে। বোর্ডকে চিঠিও দিয়েছে। কখনও রাজনীতিকরা চাপ দিয়েছেন। সরব হয়েছেন লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রবীণ সাংসদ গুরুদাশ দাশগুপ্ত, মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, ক্ষিতি গোস্বামীরা। বরাবর বাংলা ও বাঙালি সবটুকু শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সৌরভের পাশে।
আর ঋদ্ধির বেলা?   
সৌরভ গাঙ্গুলি ও জয় শাহ
‘এটা ভারতীয় বোর্ডের বিষয়। ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে সিএবি-র কোনও বক্তব্য নেই। কোচ ও নির্বাচক কমিটির বক্তব্যের পরে রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা কিছু বলতে পারে নাকি? চেতন শর্মাকে আমরা জিজ্ঞেস করতে যাব না, ঋদ্ধির সঙ্গে ওরা এ রকম করল কেন!’
বললেন সিএবি সচিব স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। 
আশ্চর্য! ক্রিকেটারের সঙ্গে যাতে অন্যায় না হয়, সেটা দেখা তো রাজ্য সংস্থারই কাজ। বোর্ডকে প্রশ্ন করা সিএবি-র এক্তিয়ারের বাইরে হতে যাবে কেন?
স্নেহাশিস বললেন, ‘সৌরভ ওকে কী টেক্সট পাঠিয়েছে, সেটা সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করা ঠিক হয়নি ঋদ্ধির।’ মানে সিএবি সচিব হিসেবে রাজ্যের ক্রিকেটারের পাশে থাকার চেয়েও ভাই-এর পাশে থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে। 
সৌরভ, অভিষেক ডালমিয়া ও স্নেহাশিস
জবাব দেন ঋদ্ধিও।  
‘ওঁকে প্রশ্ন করতে চাই, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ চলার সময় আমার সঙ্গে কোচ রাহুল দ্রাবিড় ও নির্বাচকপ্রধান চেতন শর্মার কী কথা হয়েছিল, সেগুলি কী করে ফাঁস হল? সেটাও তো ব্যক্তিগত ছিল। তখন তো কারও মনে হয়নি যে এটা ঠিক নয়। আমি যতক্ষণ টিমের পার্ট ছিলাম, ততক্ষণ একটা কথাও বলিনি। শ্রীলঙ্কা সিরিজের দল থেকে বাদ পড়ার পর কথা বলেছি।’
‘ছোট থেকে কখনও দল নির্বাচন নিয়ে কথা বলিনি। যখন খেলেছি, নিজের পারফরম্যান্স ছেড়ে দিয়ে দলের কথা ভেবে খেলেছি। তাই আমার পরিসংখ্যান হয়তো অন্যদের মতো নয়। আমাকে বলার থাকলে নিউজিল্যান্ড সিরিজের পরই বলতে পারত। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতাম না। আগেই যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল তো আগেই জানাতে পারত।’
একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, ক্যাপ্টেন সৌরভের জমানায় ভারতীয় দলে তেমন ভাবে বাংলার কোনও ক্রিকেটারের জায়গা হল না কেন? এমনকি জগমোহন ডালমিয়া বোর্ড সভাপতি থাকার সময়ও না। দেবাং গান্ধী, দীপ দাশগুপ্ত, অশোক দিন্দা, লক্ষ্মীরতন শুক্লা, রোহন গাভাসকার, মনোজ তিওয়ারি...ওই সময়ে বাংলা থেকে বেশ কয়েকজন সুযোগ পেলেও বেশি দিন টেকেননি। সৌরভ সিএবি বা বোর্ড সভাপতি থাকার সময়েও বাংলার ক্রিকেটারদের সামনে জাতীয় দলের দরজা তেমন খোলেনি। সৌরভ একান্ত আলোচনায় বলেন, কলজেটা ছোট। 
হয়তো তাই, হয়তো শুধুই সেটা নয়। বীরেন্দ্র সেহবাগ, হরভজন সিং-দের পারফরম্যান্স প্রথম দিকে খুব ভাল ছিল? ক্যাপ্টেন সৌরভ ভরসা রেখেছেন। দিনের পর দিন খেলিয়ে গেছেন। কিংবা প্রথম সিরিজে ব্যর্থ হার্দিক পান্ডিয়ার ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন ধোনি। ফলাফল তো সবার জানা। 
শুধু পারফরম্যান্সের জোরেই অজিত আগরকার বছরের পর বছর ভারতীয় দলে থেকেছেন? সৌরভ নিজেও কি শুধু পারফরম্যান্সের জোরেই ১৯৯৬ সালে টিমে ফিরেছিলেন? সে সময় নির্বাচক কমিটিতে পূর্বাঞ্চলের সম্বরণ ব্যানার্জি খেল না দেখালে হত? 
দিলীপ দোশী দেরিতে সুযোগ পেয়েছেন। উৎপল চ্যাটার্জি তেমন সুযোগ পাননি। সম্বরণের তো জাতীয় দলের হয়ে খেলাই হয়নি। পারফরম্যান্স ভাল ছিল না বলে?
রঞ্জি, মুস্তাক আলি বা বিজয় হাজারে ট্রফিতে বাংলার পারফরম্যান্স মোটেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবু জাতীয় দলে বাংলার ক্রিকেটার কোথায়?
পারফরম্যান্স ও কলজের পরেও তৃতীয় কিছু লাগে। এবং সেই সুযোগটা বাংলার ক্রিকেটাররা পাননি। ক্যাপ্টেন সৌরভ, সিএবি সভাপতি সৌরভ, বিসিসিআই সভাপতি সৌরভের আমলেও না।  
বরং...     
সৌরভের পর বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি সময় ভারতীয় দলে খেলেছেন ঋদ্ধিমান সাহা। ১৯৯৬ থেকে ধরলে সৌরভের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ১২ বছরের, ঋদ্ধির ১১ বছর। কিন্তু দাপটে, প্রভাবে 'দাদি'র ধারেকাছেও নেই বিশ্বক্রিকেটের 'সুপারম্যান'। যদিও তিনি তাঁর সময়ে দুনিয়ার সেরা উইকেটকিপার। 
২০১৫ থেকে সৌরভ সিএবি সভাপতি। ২০১৯ থেকে বোর্ড সভাপতি। প্লেয়ার সৌরভের মতোই প্রশাসক সৌরভও খুব দাপুটে। সবাই তো একরকম হন না।
ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরে পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য রঞ্জি টিমে খেলতে চাননি ঋদ্ধি। তখনই সিএবি-র যুগ্ম-সচিব দেবব্রত দাস ঋদ্ধির দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি নাকি গায়ে ব‌্যথা, পায়ে ব‌্যথার অজুহাতে বাংলার হয়ে অনেক ম‌্যাচ খেলতে চাননি। 
ঋদ্ধির স্ত্রী রোমি
ঋদ্ধির স্ত্রী রোমি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, ‘রনজিতে গড় ৫০। সেটা কি গায়ে ব্যথা, পায়ে ব্যথার অজুহাত নিয়ে খেলে? ও ভাঙা আঙুল নিয়ে খেলেছে, সেটা শুনেছি আর দেখেওছি। আগে যদি জানতাম ওর গায়ে ব্যথা, পায়ে ব্যথা হয়, তাহলে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিতে বলতাম। আমার কঠিন সময়ে স্বামীকে আমি পাশে পাইনি। তা নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। কেন রনজি খেলছে না, সেটা ও জানিয়ে এসেছে। আমার প্রশ্ন, ব্রেক কি কিছু নির্দিষ্ট লোকেরাই নিতে পারেন? বয়সটাও কি ফ্যাক্টর হয় শুধু কারও কারও ক্ষেত্রে?’
বাংলার হয়ে খেলবেন বলে রেলের চাকরি ছেড়েছেন ঋদ্ধি।
আইপিএল ফাইনালে সেঞ্চুরি করে পরের দিন ভোরে ফিরেই মোহনবাগানের হয়ে ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন। 
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলে আসার পরের দিনই ক্লাবের ম্যাচে চলে যান। ম‌্যাচটা না খেললেও সারা দিন টিমের সঙ্গে ছিলেন। সতীর্থদের জন‌্য মাঠে জলও নিয়ে যান। 
মোহনবাগানের হয়েই খেলেছেন ঋদ্ধি। ক্লাবের ক্রিকেট সচিব সম্রাট ভৌমিকের কথায়, ‘দায়বদ্ধতা শব্দটা ঋদ্ধির পাশে না বসলে সেটা আর কারও পাশেই বসে না। চোট নিয়েও ম্যাচ খেলেছে। কখনও ওকে ফোন করতে হয়নি। নিজেই ফোন করে জানত কবে ক্লাবের ম্যাচ আছে।’ অশোক দিন্দা বলেছেন, ‘ঋদ্ধি কীভাবে বাংলার অবনমন বাঁচিয়েছিল, সেটা সবাই ভুলে গেল?’ সিএবির প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে বলেছেন, ‘ঋদ্ধিকে তেরো বছর বয়স থেকে চিনি। খুব কম কথা বলে। অত্যন্ত ভদ্র ক্রিকেটার। কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। নিজের খেলার প্রতি ফোকাসড। দেশ, বাংলা, ক্লাব, সব ক্ষেত্রেই ঋদ্ধি একই রকম যত্নবান। মনে হয়, দেবব্রত দাসকে দিয়ে উচ্চমহল থেকে এসব বলানো হয়েছে।’
নকআউট পর্বের জন্য ঋদ্ধিকে রাখা হল বাংলা দলে। মহম্মদ শামির সঙ্গে কথা হলেও ঋদ্ধির সঙ্গে কোনও কথা না বলেই তাঁকে টিমে রেখে দেওয়া হয়। অপমানিত ঋদ্ধি সিএবি সভাপতি অভিষেক ডালমিয়া ও কোচ অরুণলালের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু সৌরভের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত টাউন ক্লাবের দেবব্রত দাস ভুল স্বীকার করেননি। তাঁকে কেউ বলেছিল বলেও শোনা যায়নি।
তবে সৌরভের সঙ্গে কথা বলেননি ঋদ্ধি।  
'মহারাজদার সঙ্গে আমার কথা হয় না। না আমি মহারাজদার ঘনিষ্ঠ, না মহারাজদা আমার। অনেকেই আছে ফোন করে জানতে চায় কেমন আছ। আমি বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন ছাড়া কারও সঙ্গেই সেটা করি না।'     
সৌরভও কখনও ঋদ্ধির সঙ্গে কথা বলেননি। ঋদ্ধি বাংলা ছাড়ার কথা বলার পরেও না। সবাই জানেন, তিনি হস্তক্ষেপ করলেই মিটে যেত। 
সেখানেই শেষ না। ওই দেবব্রত দাসকেই ভারতীয় দলের প্রশাসনিক ম্যানেজার করে ইংল্যান্ডে পাঠানো হল। বোর্ড সভাপতির নাম সৌরভ গাঙ্গুলি। বিরাট কোহলি পর্বেই বোঝা গেছে দল বাছাইয়েও প্রেসিডেন্ট সৌরভের দাপট কতটা। শোনা যায়, দল নির্বাচন কমিটির মিটিংয়েও নাকি সৌরভ থাকেন।
দোসরা জুলাই বাংলা ছাড়লেন ঋদ্ধি, যেমন আগে ছেড়েছিলেন অশোক দিন্দা। সিএবি সভাপতি অভিষেক ডালমিয়া ও সচিব স্নেহাশিস গাঙ্গুলির সঙ্গে দেখা করে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে বললেন, ‘একটা সময় রেলের চাকরি ছেড়েছি। অনেকেই বলেছিল, এমন কেউ করে না কি? এত ভাল চাকরি কেউ ছাড়ে? তবে আমি শুনিনি। তাই বাংলার সঙ্গে কোনও ইগোর ব্যাপার নেই। বাংলায় খেলার জন্য সিএবি বারবার অনুরোধ করেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। আপাতত অন্য রাজ্যের হয়ে খেলব। পরে সিএবি ডাকলে ফিরতে পারি।’ 
নো অবজেকশন নিতে সিএবি-তে ঋদ্ধি
আগে স্নেহাশিস বলেছিলেন, ‘সৌরভের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনা ঋদ্ধি প্রকাশ্যে এটা না বললেই ভালো করত। মাঠই ওর জবাব দেওয়ার একমাত্র জায়গা।’
ঋদ্ধি সেটাই করেছেন। এ বারের আইপিএলে ১১টি ম্যাচ খেলে করেছেন ৩১৭ রান। উচ্ছ্বসিত সচিন বলেন, ‘ঋদ্ধিমান সাহা ভীষণই আন্ডার-রেটেড ক্রিকেটার। আমি ওকে ভীষণ উচুঁতে রেট করি কারণ ও একজন ভয়ঙ্কর খেলোয়ড়। স্পিনার হোক বা ফাস্ট বোলার, সকলের বিরুদ্ধে সবদিক শট খেলতে দক্ষ ও।’ 
আইপিএল, ২০২২
ঋদ্ধির ভবিষ্যৎ নিয়ে সিএবি সচিব স্নেহাশিস শুনিয়েছিলেন তাঁদের ‘পারিবারিক ক্লাব’ বড়িশা স্পোর্টিংয়ের ক্রিকেটার, সদ্য ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অতিরিক্ত হিসেবে সুযোগ পাওয়া উইকেটকিপার অভিষেক পোড়েলের নাম। 
‘অভিষেক পোড়েলের দিকে আমাদের নজর থাকবে।’
এই উপেক্ষা, অসম্মান প্রাপ্য ছিল ঋদ্ধির? সৌরভ তো অন্তত জানেন, নিজেকে উজার করে দেওয়ার পরও অসম্মানিত হতে হলে কেমন লাগে? 
অপমানিত হয়ে জাতীয় দল থেকে সরে যেতে হল ঋদ্ধিকে। কাউকে পাশে পেলেন না। উল্টে সিএবি-র অপমানের মুখেও পড়লেন 'সুপারম্যান'।
কিস্যু করার ছিল না, সৌরভের? তাঁর অসম্মানের বিরুদ্ধে বাংলাকে পাশে পেয়েছেন বারবার। 
আর ঋদ্ধির বেলা? 
শুধু অশোক ভট্টাচার্য চিঠি লিখেছিলেন সৌরভকে। 
'তোমার মতো ঋদ্ধিমানকে (আমাদের পাপালি) নিয়েও আমাদের গর্ব। তোমাদের নিয়েই বাংলার আবেগ। ঋদ্ধিমানের টিম থেকে বাদ পড়াটা আমাদের কাছে খুবই দুঃখের। যেমন দুঃখ পেয়েছিলাম তুমিও যখন বঞ্চনা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলে। তোমার কাছে সমগ্র শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গবাসীর একটাই অনুরোধ, ঋদ্ধিমান সাহার ভারতীয় ক্রিকেট টিম থেকে বাদ পড়ার বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করা যায় কিনা তা দেখার।-তোমার অশোকদা।'
সৌরভ সিএবি সভাপতি, নবান্নে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। খেলার মাঠের নানা বিষয়ে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। ইস্টবেঙ্গলের স্পনসর পাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। 
ঋদ্ধির ব্যাপারে? হিরন্ময় নীরবতা।
আগে রাজনীতির বহু নেতা খেলাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। বাংলাকেও। সেখানে ভোটের রাজনীতির অঙ্ক থাকত না। থাকত খেলার প্রতি নিখাদ ভালবাসা। 
এখন সব দেনা পাওনার গল্প। সৌরভ বা ইস্টবেঙ্গল ক্রাউড পুলার, ভোট বাজারে কাজে লাগে। খেলার মাঠে কাজে লাগলেও ঋদ্ধি ডানপিটে নন। খেলায় দায়বদ্ধ। আর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। ভোটের বাজারে অচল। অতএব...না সরকার না বিরোধী, ঋদ্ধির পাশে কেউ নেই।
ঋদ্ধি পর্ব বাঙালির বিবর্ণ চেহারাটাও দেখিয়ে দিয়ে গেল।
ক্ষমা করবেন ঋদ্ধিমান 'সুপারম্যান' সাহা। 
জননায়ক বা জননেত্রী অনেকেই হতে পারেন, কিন্তু কিংবদন্তী হতে গেলে আরও বেশি কিছু লাগে। সেটা সবার মাথায় ঢোকে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
নামহীন বলেছেন…
ভীষণভাবে সহমত। শুধু একটা কথা বলতে চাই, আমি নিয়মিত রঞ্জি ট্রফির খোঁজখবর রাখি। ঋদ্ধি-দিন্দা-তিওয়ারির পর বাংলা টিমে একজন ক্রিকেটার‌ও পরপর দুটো সিজ়নে পারফর্ম করতে পারছে না। ধারাবাহিকতায় কিন্তু অন্য রাজ্যের অনেকেই এগিয়ে।
Keya Ghosh বলেছেন…
সবসময় কি #দাদাগিরি দেখানো চলে? সেটাও বেশ হিসাবে হয়... সৌরভ বাঙালির আইকন ঋদ্ধিমান নন ... সৌরভের পর একমাত্র ঋদ্ধি ই বাংলা থেকে ভারতীয় দলে দীর্ঘদিন খেলেছে।

Top Post Ad