link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

'সোনার ঝাঁটা', 'জিহাদ', 'দুধেল গাই', 'হিন্দু' শুভেন্দু এবং 'সোনার বাংলা' Suvendu_Mamata_Jihad_Panchayet_Election

ঝাঁটা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির ভোট প্রতীক। ঝাঁটা সম্ভবত এখন মমতা ব্যানার্জিরও ভোটযুদ্ধের অস্ত্র। 

ভবানীপুরের শীতলা মন্দিরে মমতা
মমতা ব্যানার্জি মহাসাগরের মতো’ (Mamata Banerjee)। মাঝেমধ্যেই তাঁর সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানা যায়। মানে তিনিই জানান।
তাঁর জন্মদিন কবে? তিনি নিজেই বিভিন্ন সময়ে দুটো তারিখ বলেছেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মজীবনের তথ্যও পরিবর্তনশীল। যেমন কদিন আগে তিনি জানালেন, ভবানীপুরের একটা স্কুলে মাসিক ৬০ টাকা বেতনে পড়াতেন। তেমনই জানা গেল
আপনারা হয়তো জানেন না, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় দীর্ঘ ২৬ দিন অনশন করেছিলাম। শুরুর দিন থেকেই সন্তোষী মা-র ব্রত স্টার্ট করলাম। ঠাকুরের কাছে আমার বলা ছিল, যদি কৃষকরা ওদের জমি ফিরে পায়, তাহলে মা তোমাকে আমি একটা ছোট্ট মন্দির করে দেব। তারপরে আমি সন্তোষী মাতার ব্রত চালিয়ে যাব। তাই কখনও কখনও বছরে আমাকে এটা করতে হয়।
এবার ষোলো সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। আগামিকাল যাব, সিঙ্গুরে আমার ওই ছোট্ট মন্দিরটায়। আমি সন্তোষী মা-র মুখটা দেখতে যাব। মা সন্তোষী স্বপ্নে দেখা দিয়ে সিঙ্গুর আন্দোলনে জয়ী হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করেছিলেন।
কেউ জানত মমতার সেই মানতের কথা? জানত ২০১৯ সালে সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়ায় মমতা সেই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন? জানা গেল ২ জুন। আর মমতা সেই মন্দিরে গেলেন ৩ জুন।

সিঙ্গুরের সন্তোষী মন্দিরে মমতা
সেদিনই নিজের বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরে কাঁসারি পাড়া শীতলা মন্দিরের ১৯৫ তম বর্ষ উপলক্ষে পুজো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আরতিও করলেন। দেবী শীতলার জন্য ৫ লক্ষ টাকা খরচ করে সোনার ঝাঁটা তৈরি করিয়েছেন। বেনারসী, ধুতি, মিষ্টি দিয়ে পুজোর সঙ্গে সেই ঝাঁটাও দেন। জানান, তিনি প্রায়ই এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। বললেন, 'দক্ষিণ কলকাতার লেক কালিবাড়ির বগলামুখী ও সন্তোষীমাতার মূর্তি গড়িয়ে দিয়েছি আমি। মাঝে মাঝে তাদেরও দেখতে যাই।'
মমতা ব্যানার্জির বাড়িতে কালীপুজো হয়, সবাই জানেন। তাহলে হঠাৎ এই অজানা তথ্য সামনে আনলেন কেন? কেনই বা দেবী শীতলাকে সোনার ঝাঁটা দিলেন।
কোনও কারণ ছাড়া মমতা ব্যানার্জি কিছু করেন বা বলেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। মনে করি, এই মুহূর্তে রাজ্যের বাস্তবতা তাঁর চেয়ে ভাল কেউ বোঝেন না, সামনের সময়কে তাঁর মতো কেউ দেখতে পান না। 

বাড়ির পুজোয় প্রণব মুখর্জি 
ধর্মাচরণ যে কোনও মানুষের অধিকার। কিন্তু তাকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্গে মেশানো যাবে না। খুব সহজ কথায় এটাই সেকুলার (বাংলায় কাছাকাছি শব্দ, ধর্মনিরপেক্ষ) ভাবনা। এর সঙ্গে ধর্মের কোনও বিরোধ নেই। প্রণব মুখার্জি (Pranab Mukherjee) দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন, রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। দুর্গা পুজোয় গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসতেন, চণ্ডী পাঠ করতেন। কিন্তু তার প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রীয় পদে থাকা কেউ ধর্মাচরণ করতেই পারেন, কিন্তু তা নিজের নিজের পরিধিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রণববাবুর মত আরও অনেক নেতারই এটা অভ্যাস ছিল। 

রাম মন্দিরের ভূমি পুজোর পর মোদী
বিজেপি হল আরএসএসের রাজনৈতিক দল। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানো। মুসলিম তোষণ, ভণ্ড ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বলে তারা ভিন্ন একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। যেখানে ঢাক ঢোল পিটিয়ে, সরকারি মিডিয়াকে ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী রাম মন্দিরের ভূমি পুজো করছেন। ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) প্রচারের আড়ালে নিজস্ব পরিসরে একটা কেন, একশোটা মন্দিরের শিলান্যাস করতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পারেন না। সেটা সংবিধান বিরোধী কাজ। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা (Rahul Priyanka Gandhi) দুশো মন্দির, পাঁচশো মসজিদে যেতে পারেন, কিন্তু মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে কেন? মমতা ধর্মীয় রীতিনীতি শিকেয় তুলে মহালয়া থেকে পরের পর দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেন, রেড রোডে গিয়ে নমাজ পড়েন, গির্জায় প্রার্থনায় থাকেন এবং অবশ্যই মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। একে ধর্ম পালন বলে? এতো ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি।

মন্দিরে পুজো রাহুল-প্রিয়াঙ্কার
সারা দেশে এই রাজনীতির লালন পালন চলছে সাড়ম্বরে। তার প্রভাব পশ্চিমবাংলায় পড়বেই তাতে আশ্চর্য কী? ২০১৯ লোকসভা ভোটে আমাদের রাজ্যে বিজেপির চমকে দেওয়া ফলের কারণ সেটাই। বিধানসভা ভোটে বিদেশী নেতাদের ভরসায় খেলতে নেমে পিসি ভাইপো ইত্যাদিতে ঢুকে তাল হারিয়ে ফেলে। সুযোগ বুঝে বাঙালি আবেগকে কাজে লাগান মমতা। অনেকে বলেন স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি প্রকল্পে মানুষ গলে গেছেন। আমার মনে হয়, ভোটে নিয়ন্ত্রক বিষয় হল রাজনৈতিক বোঝাপড়া। ওই সব সরকারি প্রকল্প সেই গতিকে বাড়াতে সাহায্য করে।
ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, ভারতীয় রাজনীতির সেকুলার (বাংলায় কাছাকাছি শব্দ ধর্মনিরপেক্ষ) (Secular) চরিত্র কখনও তেমন ভাবে ছিল না। তবে বেশ কয়েকজন সেকুলার রাজনীতিক ছিলেন এবং আছেন। তবে যেটুকু সেকুলার চরিত্র ছিল সেটাও রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের ঘোর অপছন্দ। তাঁদের কড়া ডোজের হিন্দুত্বের পাশাপশি সঙ্গত করার জন্য আছে কড়া ডোজে ইসলামি মৌলবাদ। এবং আছে নরম হিন্দুত্ব, বিশেষত ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে যা রাষ্ট্রীয় জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। আদর্শগত লড়াইটা যাঁদের করার কথা ছিল তাঁরা শুরু থেকেই ধর্মকে অস্বীকার, এমনকী বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটায় জাতীয় জীবনের এই পরিসরে তাঁরা অর্থহীন হয়ে পড়েছেন বারেবারে। হ্যাঁ, আমি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বামপন্থী বলে দাবি করা দলগুলোর কথাই বলছি।  
বিজেপি বিধানসভা ভুল থেকে শিখেছে। এই শেখাটা অন্য যে কোনও দলের চেয়ে আন্তরিক। বিজেপির সদ্যসমাপ্ত জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, বিরোধীরা এখন দুর্বল, এলোমেলো। বিরোধীদের কেন এই অবস্থা সেটা বুঝতে হবে, যাতে ওই ভুল বিজেপি না করে। সাফল্যের শীর্ষে বসেও কী সাবধানী মনোভাব। আদর্শগত লক্ষ্যের প্রতি তীব্র আনুগত্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়। 

২১ জুলাই বিজেপির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার দিন, আসানসোলে সভায় বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। (Mamata calls for Jihad against BJP)
পরের দিন দলবল নিয়ে রাজভবনে হাজির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)।
মারাত্মক শব্দ বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জেহাদ আরবী শব্দ। অর্থ ধর্মযুদ্ধ। এই একটা শব্দ বলায় সরকার ফেলে দিতে হবে।
এক লাটসাহেব আছেন। এই অস্থিরতার সময়েও বেশ হাসির খোরাক জোগান। মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বললেনমারাত্মক কাণ্ড করেছেন। সংবিধানের কফিনে পেরেক পুঁতে দিয়েছেন। এক্ষুনি প্রত্যাহার করুন জিহাদ শব্দটা। নয়তো কঠোর হতে বাধ্য হব।
রাজভবনে বিজেপি বিধায়কদল
রাজ্যে অনেক রাজ্যপাল এসেছেন। বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতও হয়েছে অনেকের, বিশেষত বামফ্রন্ট সরকারের সময়। কিন্তু এরকম ফালতু জিনিস আগে আসেননি।
জেহাদ বা জিহাদ শব্দটার কী অর্থজিহাদ একটি আরবী শব্দ। বাংলায় এরকম অসংখ্য আরবী, ফারসি, হিন্দি, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষার সম্মিলন ঘটেছে। জিহাদের আভিধানিক অর্থ, পরিশ্রম, সাধনা, কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। কোরআনে জিহাদের কথা ৪১ বার উল্লেখ আছে। 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই অর্থে।
প্রতিদিনের কথায় জিহাদ বা জেহাদ বলতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধকেই বোঝানো হয়।
নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বিরোধী দলনেতা চুলকে দিলেন এবং লাটসাহেব লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একাকার। রাজ্যপাল বিজেপির অনুগত সৈনিক না হয়ে সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ ও ভদ্রলোক হলে জিহাদ শর্বেদর অর্থ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারতেন, জেনে নিতে পারতেন বিভিন্ন ভাষা থেকে বিভিন্ন শব্দ কী ভাবে বাংলা সহ বিভিন্ন ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে। বিজেপিতেও এরকম অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন।  

নরেন্দ্র মোদীর কাছে শুভেন্দু অধিকারী
রাজ্যপালের কথা ছাড়ুন। বিধানসভা ভোটের আগে শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রামে কী বলেছিলেন?
মুসলিম বোঝাতে বারবার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী শব্দটা ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, নন্দীগ্রামে ৬২ হাজার ভোট তাঁর লাগবে না (মুসলিম ভোট)। যদ্দিন না বিজেপি এখানে ক্ষমতায় এসে যোগী আদিত্যনাথ বা হিমন্ত বিশ্বশর্মার মত টাইট না দেবে তদ্দিন মুসলিমরা বিজেপিকে ভোট দেবে না।
ভোটের আগে-পরে বারবার নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিচ্ছেন। বলছেন, কে এক জন এসেছেন না বাইরে থেকে। কী কুমার নাকি কিশোর কুমার (প্রশান্ত কিশোরের কথা বলছেন) ন্যাশনাল চ্যানেলে বলছেন, ‘৩০ হামারা রিজার্ভ হ্যায়’। তো মাননীয় কুমারকে বলতে হবেসেই ৩০ % কারা। আর ৩০ যদি ওঁদের থাকেতা হলে বাকি ৭০ % তো সব পদ্মফুলে!’
শুভেন্দু
গতবার পুজোর সময় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর শুভেন্দু বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যাগুরুদের সংখ্যালঘু ভোট পেয়েছেন বলেই ওনার দায়বদ্ধতা নেই। উনি ২০১৯ সালে সবার সামনে বলেছিলেনযেই গরু দুধ দেয় তাঁর লাথি খাওয়া ভালো। বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বললে দুধেল গাইরা চটে যাবেন তাই উনি চুপ রয়েছেন।
শুভেন্দু বলছেন, বিজেপি যে ৩৮% ভোট পেয়েছে তার পুরোটাই হিন্দু ভোট। আর মমতার পাওয়া ৪৮% ভোটের মধ্যে ৩০% মুসলিম ভোট।বলছেন, হিন্দুদের জাগতে হবে। এককাট্টা হতে হবে। তাহলে ৭০% হারিয়ে দেবে ৩০%-কে।
কলকাতার পুরভোটের আগে শুভেন্দু বলেনবিজেপি এমন লোককে মেয়র করবে যার কপালে তিলক, হাতে তাগা থাকবে। মানুষকে দেখলেই যে হরেকৃষ্ণ, জয় শ্রী রাম বলবে। যে প্রতি বছর কালীপুজো, দুর্গাপুজো করবে।
হাওড়ায় অশান্তির সময় শুভেন্দু দুই মুসলিম পুলিশ অফিসারের নাম করে বললেন, সব দখল হয়ে গেছে। এবার জাগতে হবে।
শুভেন্দুর কথা উদাহরণ হিসেবে দিলাম, কারণ তিনি বিরোধী দলনেতা। বিজেপির নানা নেতার এরকম অনেক মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। 
নূপুর শর্মা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট কড়া কথা বলার পর বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বললেন, নূপুর কারও সম্পর্কে বলতেই পারেন। সেটা তাঁর বাক স্বাধীনতা।
এরকম কথা খোলাখুলি ভাবে বাংলার রাজনীতিতে আমরা আগে শুনিনি, এমনকি ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে নয়। বিজেপি সম্পূর্ণ মেরুকরণ চাইছে, সেটা স্পষ্ট। একে সামনে রেখেই তারা এগোবে। বাকি বিষয়গুলো থাকবে সহায়ক। 
মমতা ও অভিষেক
লোকসভা ভোটের আগে পঞ্চায়েত ভোট। আচমকা ভোটের দিন ঘোষণা করে দিয়ে হয়তো বিরোধীদের তৈরি হওয়ার সময়ও দেবেন না মমতা।
মমতা জানেন ওপর দিকে যাই থাক, মাটিতে তিন বিরোধী এক হয়ে লড়বে। তাতে তৃণমূলের গতবারের ভোটেও তাই হয়েছিল। তোলাবাজি, কাটমানির মত বিষয়গুলো পঞ্চায়েত ভোটে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। তার উপর এবার নানা কারণে আগের বারের মতো দখলদারির ভোট করা সম্ভব নাও হতে পারে।
মমতা জানেন, তৃণমূল স্তরে হিন্দুত্বের রাজনীতিকে ছড়াতে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠনগুলো। এর মোকাবিলা কী ভাবে করা যাবে?
খেয়াল করলে দেখা যাবে,এক সময় বিজেপির রামনবমীর মিছিলের পাল্টা তৃণমূলও রাম নবমীর মিছিল করেছে।এখন আর করে না। মমতা বুঝতে পেরেছেন, তাতে বিজেপিরই লাভ হচ্ছে।
মায়াপুরে জিন্দালদের মন্দির করতে ৭০০ একর জমি দিয়েছে সরকার। দক্ষিণেশ্বর, তারাপীঠ, কালীঘাট, গঙ্গাসাগর, জলপাইগুড়ির দূর্গেশ মন্দির, কোচবিহারের শিবযজ্ঞ মন্দির, দিঘায় জগন্নাথ মন্দির, অনুকূল ঠাকুরের মন্দির... মাঝেমাঝেই তালিকা দেন মমতা। কিন্তু...
এবার দেবী শীতলা এবং সন্তোষী। এই দুই দেবী গ্রামের সাধারণ মহিলা, দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবারে পূজিতা। সেই লক্ষ্যেই সিঙ্গুরে দেবী সন্তোষীর মন্দিরের কথা জানানো, ব্রত রাখা ইত্যাদি এবং দেবী শীতলাকে সোনার ঝাঁটা উপহার। এবং অনুকুল ঠাকুরের শিষ্যদের পাশেও দাঁড়ানোর কথা।
এক সময় মতুয়া-ভোটব্যাঙ্কের খোঁজটা বের করেছিলেন মমতাই। তবে বিজেপির দাপটে এখন তা অনেকটাই হাতছাড়া।
রেড রোডের নমাজের অনুষ্ঠানে
মমতা একটি আঞ্চলিক দলের নেত্রী। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাঁর লক্ষ্য। সেজন্য কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল তৈরি করার পরেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছেন। এক সময় বিজেপির হাত ধরেছেন। রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপিকে প্রাসঙ্গিক করতে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন বিজেপি ক্রমাগত মমতার অস্তিত্বের পক্ষে বিপদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন কৌশল নিতে হচ্ছে মমতাকে। 
দেবী শীতলা বা সন্তোষী সেই কৌশলেরই অংশ।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি মেরুকরণের রাজনীতিতেই জোর দিয়েছিল। ২০২১-এর ভোটে সে রাস্তা থেকে সরে গিয়ে অন্য রাজ্য থেকে আসা নেতৃত্বকে সামনে রেখে তৃণমূল থেকে যাওয়া নেতাদের উপর নির্ভর করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে। তবু বিজেপি ৩৮ % ভোট পেয়েছে (২০১৯ সালে ছিল ৪০.২৫%)। 
রাজনীতি স্রেফ ভোটের অংক নয়। রাজনীতি কোনও পাটিগণিত নয়। রাজনীতি সমাজবিজ্ঞান। রাজনীতি রসায়ন। বিধানসভা ভোটের পর থেকে বিভিন্ন ভোটে বিজেপির হাল দেখে অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন, বিজেপি রসাতলে যাচ্ছে। বামেদের পুনরুত্থান হচ্ছে। আমার মতে অবাস্তব, হাস্যকর ভাবনা। উদাহরণ হিসেবে, সাম্প্রতিক পুরো উপনির্বাচনের কথা ধরা যাক। চন্দননগরে জয় সম্পূর্ণই তৃণমূলের ঘরের লড়াইয়ের ফল। বাকি যে ৪ ওয়ার্ডে সিপিএম দু নম্বরে, সেখানকার ভোটের হিসেব দেখলেই বোঝা যাবে তৃণমূল পুরোটাই দখল করে ভোট করেছে। সেটাকে জনমত বলে দেখাটা ভুল হবে। বরং বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূল বামেদেরই বিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, এরকম ধারণা তৈরির সুযোগ থেকে যায়। 

ইফতারে মমতার সঙ্গে সৌরভ
এখন রাজ্যে ৩০ শতাংশ মতো মুসলিম ভোট। তার প্রায় পুরোটাই যায় তৃণমূলের ঘরে। তার অর্থ বিজেপি লোকসভা ভোটে হিন্দু ভোটের ৫৭% আর বিধানসভা ভোটে ৫৪% ভোট পেয়েছে। ভোটবিজ্ঞানের নিয়মে মনে করা হয় চূড়ান্ত মেরুকরণের সময়ও সংখ্যাগুরু ভোটের সর্বোচ্চ ৫৫-৫৭% ভোট একদিকে কেন্দ্রীভূত হতে পারে। সেই হিসেব মানলে বিজেপি সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিজেপি সেই আখের সবটুকু রস বের করে নিতে চাইছে। ২০১৯ লোকসভা ভোট বা তারচেয়ে যতটা সম্ভব ভাল অবস্থায় পৌঁছতে চাইছে। শুভেন্দু সেই কথাটা আবার মনে করাচ্ছি, '৩০ যদি ওঁদের থাকেতা হলে বাকি ৭০ % তো সব পদ্মফুলে!' মমতা সেই জায়গাতেই আঘাত করতে চাইছেন। অস্ত্র নরম হিন্দুত্ব। অস্ত্র দেবী শীতলা, সন্তোষী।
শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এখনও শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর জেরে দিল্লিতে বর্বর শিখ নিধন যজ্ঞের পর দেশের অন্যত্রও আক্রান্ত হন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। কলকাতায় তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাপদ। মমতা তখন কংগ্রেস নেত্রী। সেবারই প্রথম বার সংসদ নির্বাচিত হন সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়ে। (Jyoti Basu & Sikhs in Calcutta) 
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কলকাতায় দাঙ্গা ছড়ায়। কিন্তু তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মমতা প্রায়ই দাবি করেন,, তিনি দাঙ্গা থামাতে রাতভর রাস্তায় ছিলেন। বাস্তবে তিনি দাঙ্গায় ইন্ধন দেওয়া কংগ্রেস কর্মীদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দরবার করছিলেন।
জ্যোতি বসুকে মুসলিম প্রীতি দেখতে নমাজে যেতে হয়নি, ইফতারে থাকার ছবি করতে হয়নি, মাথায় কাপড় পেচিয়ে নমাজের ভঙ্গিতে ছবি তুলতে মিডিয়ায় প্রকাশ করতে হয়নি। জ্যোতি বসুকে বলতে হয়নি গুরুদ্বারা থেকে হালুয়া চেয়ে খাওয়ার কথা। ভবানীপুর উপনির্বাচনের আগে গুরুদ্বারে গিয়ে দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন কথা বলেছিলেন মমতা। জ্যোতি বসুদের তেমন কিছু করতে হয়নি।

জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
সেই আদর্শগত অবস্থান বা প্রশাসনিক দক্ষতা কোনওটাই মমতার কাছে আশা করা মূর্খামি। তাঁর কোনও আদর্শগত লক্ষ্য নেই (বাস্তবে এখন বিজেপি ছাড়া আর কোন দলের আছে, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে)। পুরোটাই গদি সর্বস্ব রাজনীতি। গদিতে বসা এবং গদিতে টিকে থাকাটাই একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপূরণ করতেই মমতার টার্গেট মুসলিম ভোট। একলপ্তে অনেক ভোট পাওয়া যায়। ব্যাপারটা পুরোটাই যে ভোটসর্বস্ব সেটা স্পষ্ট মমতার মন্তব্যেই। 
‘আমি ইফতারে যাচ্ছি। হ্যাঁ, আমি মুসলিম তোষণ করি।  যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খাওয়া উচিত। 
কোনও মানুষ বা গোষ্ঠী সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সম্মানবোধ থাকলে কেউ এ কথা বলতে পারেন? ঠিক যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, পোশাক দেখলেই বুঝতে পারবেন কারা এই হিংসা ছড়াচ্ছে।
মুসলিম ভোট ধরে রাখতে মরিয়া মমতা। সঙ্গে হিন্দু ভোটেও থাবা বসানোর ছক। পঞ্চায়েত ভোটের আগে তাই দেবী শীতলা আর সন্তোষীকে অস্ত্র করা। 

রাষ্ট্রপতি ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন দ্রৌপদী মুর্মু
মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভোটে এনডিএ দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করে বিরোধীদের বেআব্রু করে দিল। 
১৯৭৪ সালে প্রথম বার। ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় বার রাজস্থানের পোখরানে পরমাণু বোমা পরীক্ষা করে ভারত। দ্বিতীয় বার বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সফল পরীক্ষার কিছু দিন পরে বলেছিলেন, তিনি অল্প অল্প জানতেন। সেই 'সবজান্তা' মমতা বললেন, এনডিএ আদিবাসী মহিলাকে প্রার্থী করবে সেটা তিনি আগে জানতেন না। জানলে? সর্বসম্মতভাবে প্রার্থী করা যেতে পারত।
কোনও বিরোধী দল কোনও মন্তব্য করল না। কংগ্রেস বা সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও না। কিন্তু রাজ্যের কংগ্রেস-সিপিএম নেতারা রে রে করে উঠলেন, মমতা এরকমই করেন। উনি বরাবর মোদীর দালালি করে বিরোধী জোট ভাঙেন।
আমার একটাই প্রশ্ন, জানতেনই যদি মমতা এরকম তবে মমতার নেতৃত্বে প্রার্থী ঠিক করতে বসলেন কেন? মমতারই ঠিক করে দেওয়া প্রার্থীকেই বা মানলেন কেন? তাতে নিজেদের দেউলিয়া, হিজিবিজি চেহারাটাই তো প্রকাশ পেয়ে গেল।
বিরোধী শিবির কতটা দায়সারা, উদ্যোগহীন সেটাই বেআব্রু করে দিল এবারের রাষ্ট্রপতি ভোট। নেতারা বলেছিলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে আদর্শগত ভোট। সঙ্গে থাকা জেএমএম সঙ্গ ছাড়ল। বিজেডি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, অকালি দলও বিজেপির পাশে। টালবাহান করা নীতীশও ট্র্যাকে। উল্টে মহারাষ্ট্রে উলটপুরাণ।
শিবসেনা ভেঙে সরকারের দখল নিল বিজেপি। (Govt change in Maha) বিদ্রোহী শিবসেনা নেতারা বললেন, হিন্দুত্বের চেনা রাস্তায় ফিরতেই তাঁরা উদ্ধব ঠাকরের পাশ থেকে সরে এলেন। মানে হিন্দুত্বের রাজনীতি আরও নতুন জায়গা দখল করল। সে কাজটা হল রাষ্ট্রপতি ভোটের আগে যখন বিরোধীরা একজোট হয়ে লড়ার কথা বলছে। মানে আদর্শগত রাজনীতির মাঠেও অ্যাডভান্টেজ বিজেপি।
আরও এক ধাপ এগিয়ে মমতা বললেন, তিনি যশবন্ত সিনহার নাম প্রস্তাবই করেননি। দেখুন কাণ্ড! যশবন্ত নিরপেক্ষ প্রার্থী বোঝাতে সীতারাম ইয়েচুরি আর ডি রাজা ছক বানিয়ে শরদ পওয়ারকে গিয়ে বললেন। শরদের কথায় মমতা যশবন্তকে দল থেকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এবং তারপরই টুইটে যশবন্ত ফুটিয়ে তুললেন সেই ইচ্ছের কথা। সীতারাম-রাজারা বোঝালেন, তাঁরা তৃণমূলের লোককে সমর্থন করেননি, করেছেন নিরপেক্ষ যশবন্তকে। মমতা কিনা এখন বলছেন, তিনি যশবন্তের নাম প্রস্তাবই করেননি!
বলছেন তো বটেই। কিন্তু কেন? সত্যিই কি মোদী-দিদি সেটিং?

রাষ্ট্রপতি ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন যশবন্ত সিনহা
আমার তা মনে হয় না। যে কোনও আঞ্চলিক দল স্থানীয় ইস্যুকে সামনে রেখেই তৈরি হয়। এক সময় বিজেপি কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের হাত ধরেছে (এখনও কয়েক জায়গায় আছে)। বরাবরই আঞ্চলিক দলগুলোকে দুর্বল করা, ভাঙা, এমনকি গিলে খেয়েছে বিজেপি। একার জোরেই কেন্দ্রে সরকার গড়ার পর থেকে বিজেপি আরও আগ্রাসী। তাদের লক্ষ্য প্রকাশ্যে ঘোষিত-হিন্দুরাষ্ট্র। সে জন্য তাঁদের কৌশল মেরুকরণ। (আরএসএস-এর দুই পার্টি বিজেপি আর তৃণমূল, নাগপুরের নির্দেশেই তৃণমূলও চলছে, এরকম বোকা বোকা ব্যাখ্যা কিছু নেতার ব্যক্তিগত লাভের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা বিজেপি বিরোধী লড়াইকে দুর্বল করে।)

শরদ পওয়ার ও মমতা
কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নতুন দল বানিয়ে যে কজন টিকে থেকেছেন তাঁদের একজন মমতা, অন্যজন শরদ পওয়ার। মহারাষ্ট্রের ভোটে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েই শিবসেনা জিতেছিল। দুই শরিকের গোলমাল বাঁধতেই শরদের ভাইপো অজিত পওয়ারকে ভাঙিয়ে নিয়ে সরকার বানিয়েছিলেন দেবেন্দ্র ফড়নবীশ। পাল্টা চাল দেন শরদ। ১৯৭৮ সালে মাঝপথে মুখ্যমন্ত্রী বদলেছিল মহারাষ্ট্রে। রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম বার। বিদ্রোহ পাকিয়ে বসন্তদাদা পাতিলের কংগ্রেস সরকার ফেলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ৩৮ বছরের শরদ পওয়ার। ৭৮ বছর বয়সে তাঁরা চালেই মাত হয় বিজেপি। 
এনসিপি-কংগ্রেসের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব

সবাইকে চমকে দিয়ে এনসিপি আর কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার বানান শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে। শরদ পওয়ার সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আড়াই বছর সেই সরকার ধরে রেখেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভোটের মুখে সেই সরকার পড়ে গেল।
রাষ্ট্রপতি ভোটে বিরোধী জোটের অন্যতম নেতা শরদ পওয়ার। তাঁর ডাকে বৈঠকেই প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করে বিরোধীরা। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের বদলে মুখ্যমন্ত্রী এখন একনাথ শিন্ডে। মুখ্যমন্ত্রিত্ব নেয়নি বিজেপি। সরকারের পরে শিবসেনার দখলও সম্ভবত যাবে শিন্ডের হাতে। 
শিবসেনা বরাবরই বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মূল দুই বাহিনী ছিল বজরং দল এবং বালাসাহেবের শিবসৈনিকরা। সেই শিবসেনাকে, সেই বালাসাহেবের ছেলেকে ভাঙিয়ে এনে জাতশত্রু কংগ্রেস আর এনসিপির সঙ্গে সরকার বানিয়েছিলেন শরদ পওয়ার। 
শিন্ডে ও ফড়নবীশ
একনাথ শিন্ডে 
উদ্ধব ঠাকরের সরকার পড়ে যাওয়ায় কয়েকটা জিনিস পরিস্কার,
মহারাষ্ট্রেও রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পতাকাটা আরও কারও হাতে রাখতে রাজি নয় বিজেপি। সে জন্য সব রকম রাস্তা ব্যবহার করে তারা উদ্ধব ঠাকরেকে উপড়ে দিল। গদিতে বসাল অনেক দুর্বল শিন্ডেকে। বালাসাহেবকে সামনে রেখেই তাঁর পরিবারকে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হচ্ছে। 

শরদ পওয়ার
মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে শরদ পওয়ারের গুরুত্বও প্রশ্নের মুখে। প্রশ্নের মুখে তাঁর দল এনসিপির ভবিষ্যতও। একবার তাঁর ভাইপো ঘর ভেঙে ফড়নবীশের হাত ধরে হাত ধরেছিলেন। সরকার বদলের পরেই শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিতের ঘনিষ্ঠ ধনঞ্জয় মুণ্ডে বৈঠক করেছেন ফড়নবীশের সঙ্গে। অঙ্কটা খুব ভাল বুঝেছেন শরদ পওয়ার। কয়েক মাসের মধ্যেই শিন্ডেকে সরিয়ে নিজেদের সরকার তৈরি করবে বিজেপি। ভাঙাবে কংগ্রেস এবং এনসিপির ঘরও।
আগ্রাসী বিজেপির সামনে  খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে মারাঠা রাজনীতির স্ট্রংম্যান শরদ পওয়ারের সব কৌশলও।
মমতা দেখলেন। যা বোঝার বুঝলেন। শুধু ভোটের অঙ্কে যাঁরা রাজনীতিকে বোঝার চেষ্টা করেন আমি তাঁদের সঙ্গে সহমত নই। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, বাংলার রাজনীতির রাশ মমতার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। মমতার দিন ঘনিয়ে আসছে।
খেয়াল করলে দেখবেন, এই পরিস্থিতিতেও তিস্তা শেতলবাদ বা মহম্মদ জুবেরের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে বারবার সরব হচ্ছেন মমতা। সরব হচ্ছেন নুপূর শর্মার গ্রেফতারির দাবিতেও। আবার কালী-পোস্টার বিতর্কে শশী পাঁজা ও মহুয়া মৈত্র দুই সুরে কথা বলছেন। আগেও দেখা গেছে, নোট বাতিলের ঘোষণার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে প্রতিবাদ জানিয়ে মমতা বলেছিলেন, জিডিপি কমবে ২%। তাই হয়েছে। 'অগ্নিপথ' বিতর্কে শুধু তিনিই বলেছেন আরএসএস-এর প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতেই এই সিদ্ধান্ত।  
রাষ্ট্রপতি ভোটের আগে বিরোধীদের প্রথম বৈঠকের পর
মমতা বুঝতে পারছেন, ক্রমশ তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন। 
শরদ পওয়ার বিপাকে। ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন বিজেপির চালে মাত। রাষ্ট্রপতি ভোটে এনডিএ প্রার্থীকেই ভোট দেবে জেএমএম। ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক নেই। নীতীশ কুমার নেই। আছেন বলতে তেজস্বী, অখিলেশ, স্ট্যালিন। পিনারাই বিজয়ন থাকতে চাইলেও পারবেন না। কেজরিওয়ালও হিসেবি। কখনও কাছে, কখনও দূরে। মমতার রাজ্যেও সংগঠন বাড়াতে নেমেছে আপ। বিরোধী জোট সত্যি সত্যি মমতার দরকার। জোটের নেতা হওয়ার জন্য নয়, রাজ্যের ক্ষমতায় টিকে থাকতে বাঁধ হিসেবে দরকার।
মমতা বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন। মমতা বিজেপিকে চেনেন। মমতা বুঝছেন, ২০১৪ বা ২০১৯ লোকসভা ভোটের চেয়েও ২০২৪-এর ভোটে আরও আগ্রাসী বিজেপি।
ঘরের মাঠে মমতা শুধু বিজেপির টার্গেট নন, কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক তাত্ত্বিক কথাবার্তার পরও মহম্মদ সেলিমের সিপিএম এখনও মমতাকেই এক নম্বর টার্গেট মনে করে। ভোটের হিসেব একটু দেখা যাক।

  • ২০১৪ লোকসভা: তৃণমূল ৩৯.০৫%, বাম ২৯.৭১%, কংগ্রেস ৯.৫৮%, বিজেপি ১৭.০২%
  • ২০১৬ বিধানসভা: তৃণমূল ৪৪.৯১%, বাম ১৯.৭৫%+কংগ্রেস ১২.২৫%, বিজেপি ১০.১৬% 
  • ২০১৯ লোকসভা: তৃণমূল ৪৩.৩%, বাম ৫.৬৭%, কংগ্রেস ৬.৩৩%, বিজেপি ৪০.৭% 
  • ২০২১ বিধানসভা: তৃণমূল ৪৮.০২%, বাম ৪.৭১%, কংগ্রেস ৩.০৩%, বিজেপি ৩৭.৯৭%
অনেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তৃণমূলের মার থেকে বাঁচতে বাম ভোট রামের ঘরে গেছে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বামেদের উপর তুমুল হামলা শুরু করে তৃণমূল। চরম জায়গা নেয় ২০১৩ সালে দিল্লিতে অমিত মিশ্র আক্রান্ত হওয়ার পরে। সিপিএম নেতৃত্ব দিশাহারা। কিন্তু ২০১৪ লোকসভা ভোটে তুমুল মোদী হাওয়ার মধ্যেও বাম আর কংগ্রেসের মিলিত ভোট প্রায় ৪০%। বিজেপি অনেক দূরে। ২০১৬ বিধানসভা ভোটেও তৃণমূলের মূল লড়াই বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে। ২০১৯ সালে আচমকাই বিজেপির ভোট ৪ গুণ বেড়ে গেল। জাদু নাকি? এর পিছনে বড় কারণ সিপিএমের বিজেপি সম্পর্কে নীরবতা এবং ক্রমাগত তৃণমূল বিরোধিতা। এবং কিছুই করতে না পারা। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের টানেও বামের ঘরে ধস নেমেছে। ২০২১ বিধানসভা ভোট বুঝিয়ে দিয়েছে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের দড়িতে বাম ও কংগ্রেস শিবির থেকে যাওয়া ভোট বেঁধে ফেলেছে বিজেপি। সেলিমদের আব্বাস সিদ্দিকি সঙ্গ তাকে আরও সাহায্য করেছে। 
মমতার ভোট বেড়েছে। কিন্তু ক্রমশ সমস্ত ঢাল সরে গেছে। আরও আগ্রসী বিজেপির ধাক্কা সামলাতে ঘর গোছানোর সময় নিতে চাইছেন মমতা। আমার মতে, কিছুতেই সে শক্তি অর্জন করতে পারবেন না মমতা। সেটা পঞ্চায়েত ভোটে বোঝা না গেলেও স্পষ্ট হবে লোকসভা ভোটে। তাতে সিপিএম বা কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব উদ্বাহু নৃত্য করবেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
অনেকেই হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন না। তাঁদের কাছে রাজনীতি মানে পাটিগণিত। আমার মতে, রাজনীতি আসলে রসায়ন। বিজেপিকে আদর্শগত ভাবে ঠেকানোর শক্তি এই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক দলের নেই। 
বিজেপিকে হারাতে হলে তাদের টেনে নিয়ে যেতে হবে অন্য মাঠে। নাহলে...
নরেন্দ্র মোদী
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধাক্কায় দেশ টুকরো হয়েছে। টুকরো হয়েছে আমাদের বাংলা। টুকরো হওয়ার আগে ভয়ঙ্কর দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছে কলকাতা, নোয়াখালী।  মন্বন্তরের ধাকাক সামলে উঠতে না উঠতেই উদ্বাস্তু স্রোত। পাশে দাঁড়ায়নি কেন্দ্র। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আঁতুড়ঘর হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু তা তো হয়ইনি, উল্টে সম্প্রীতির নজির সারা দেশের মানুষের সামনে নজির হয়েছে। মন্দিরে মসজিদে ঘুরে, গলা কাঁপানো কাব্য করে, হাতে হাত ধরি ধরি এসো সম্প্রীতির নজির গড়ি...এসবের কিছুই ছিল না। ছিল মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার লড়াই। কৃষকের, উদ্বাস্তুর, শিক্ষকের, ছাত্রের লড়াই। 
প্রয়োজন সে শক্তির পুনর্জন্ম। যে উদাহরণ তৈরি করেছে দিল্লির কৃষক আন্দোলন। রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে। হারানো তো যায়ই না, বেশি দিন আটকে রাখাও যায় না। একমাত্র রাস্তা, রোটি-কাপড়া অউর মাকানের দাবিতে ধারাবাহিক আন্তরিক লড়াই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad