![]() |
| যন্তর মন্তর ঘর |
একজন নামার জন্য খুব তাড়াহুড়ো করছিলেন। তাঁর ধাক্কায় খুব ছোট্ট একটা বাচ্চা ছিটকে পড়ল নদীতে। সবাই হইহই করে উঠলাম। লোকটির কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। গটগট করে হাঁটা দিয়েছেন।
মা সন্তানকে কোলে তুলে নিলেন। তেমন লাগেনি, তবে পুরো ভিজে গেছে। একজন ব্যাগ থেকে একটা কাপড় বের করে দিলেন। ভদ্রমহিলা ভাল করে ছেলের সারা গা মুছিয়ে সেই কাপড় গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতেই হনহন করে এগোলেন। বাকি যাত্রীরা এগিয়ে গেছেন। আমরা পাঁচ জন ভদ্রমহিলার পেছনে। সেদিন ভুটভুটিতেই আমাদের পাঁচ জনের প্রথম দেখা। এবং এপর্যন্ত ওই একবারই।
খানিকটা এগোতেই শুনলাম ভদ্রমহিলা গলা চড়িয়ে কিছু বলছেন। অন্ধকারে চোখও একটু সয়ে এসেছে। দেখি, খানিকটা দূরে সেই তাড়াহুড়োবাবু। ঠিক তার পেছনে গালি-বোমা ফাটাতে ফাটাতে এগোচ্ছেন ছেলে কোলে মা। সত্যি বলছি, আমার ওই ২৯-৩০ বছরের জীবনে একটি গালিও আগে শুনিনি। এবং একটি গালি দুবার দিচ্ছেন না। নদীর জল, বালি, কাদা এবং গদ (পরিচিতরা জানেন লাট এলাকার গদকে স্রেফ কাদা বললে তার মাহাত্ম্য খাটো হয়) পেরিয়ে স্টেশন যাওয়ার রাস্তা। পাশেই পায়ে লেগে থাকা গদ ধোয়ার ব্যবস্থা।
সেই তাড়াহুড়োবাবু পা ধুচ্ছেন। ভদ্রমহিলা ওপরে দাঁড়িয়ে গালির গুলি চালিয়েই যাচ্ছেন। নিজে পা ধুয়ে ফের সেই লোকের পেছনে পড়লেন। তার পেছনে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি।
মাঝ নদীতে ভুটভুটি থেকে নেমে ক্যানিং স্টেশন পর্যন্ত ৩৫-৪০ মিনিটের রাস্তা ভদ্রমহিলা টানা গালি দিয়ে গেলেন। কোনও গালি রিপিট নেই। তাড়াহুড়োবাবু টানটান হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে গেলেন। একবারও পেছন ফিরে দেখার চেষ্টাও করেননি।
ক্যানিং স্টেশনে পৌঁছে সেই লোক আর ছেলে কোলে ভদ্রমহিলা হারিয়ে গেলেন ভিড়ে। আমরা পাঁচ জনও ছড়িয়ে গেলাম।
অসংসদীয় শব্দের নতুন তালিকা দেখতে দেখতে হঠাৎ সেই ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ে গেল। ওঁকে সংসদে ঢুকিয়ে ছেড়ে দিলে কী হত! অচেনা গালি, রিপিট নেই। ভাবুন অবস্থা। কত্তারা সব ল্যাজেগোবরে।
কী কী শব্দ ঢোকানো হয়েছে তালিকায়?
![]() |
দুর্নীতিগ্রস্ত, বিশ্বাসঘাতকতা, নৈরাজ্যবাদী, অযোগ্য, ভণ্ডামি, স্বৈরাচারী, একনায়কতন্ত্র, তানাশাহ, অপব্যবহার, দু'মুখো, নিষ্কর্মা, অত্যাচারিত, গদ্দার, বিভ্রান্ত করা, নাটুকে, ঢাক পেটানো, কানে তুলো গোঁজা সরকার।
তাহলে সরকার সম্পর্কে বিরোধীরা কী কী বলতে পারেন? সরকার মিছরির গুঁড়োর মতো মিষ্টি! সরকার কঙ্গনা রানাউতের মতো সুন্দর! এরকম কিছু আর কী!
অসংসদীয় শব্দ হল নির্যাতন (যেমন, গোরক্ষকদের হাতে খুন), যৌন নির্যাতন (যেমন, হাথরস), কালো দিন (যেমন, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২), লজ্জাজনক (যেমন, জাতীয় পতাকার স্তম্ভে গেরুয়া পতাকা তোলা)।
সংসদে বলা যাবে না,
কালোবাজারি, অপমান, অসত্য, অহঙ্কার, মিথ্যা, দাঙ্গা, দালাল, গুন্ডামি, দাদাগিরি, চামচা, চামচাগিরি, চেলা, রক্তপাত, রক্তাক্ত, প্রতারণা, শকুনি, গাধা, চোখে ধুলো দেওয়া, অর্থহীন, খালিস্তানি, জয়চাঁদ, শিশুসুলভ, গিরগিটি, কুমীরের কান্না ইত্যাদি।
বিজেপি নরেন্দ্র মোদীকে বলে বিকাশপুরুষ। বিরোধীরা পাল্টা বলে বিনাশপুরুষ। বিকাশপুরুষ চলবে। বিনাশপুরুষ চলবে না। নরেন্দ্র মোদীর আবিষ্কার, আন্দোলনজীবি। সেটা বলা যাবে। কিন্তু বিরোধীদের পাল্টা জুমলাজীবি নিষিদ্ধ। স্নুপগেট বলা যাবে না। পেগাসাস স্পাইওয়ারে ফোনে নজরদারির কথা উঠবে তো! দিল্লির নিজামউদ্দিনে তবলিগি জামাত থেকে কোভিড ছড়িয়েছে, এক সময় তুমুল প্রচার হয়েছে। কুম্ভ মেলা থেকেও তাই হয়েছে। হয়তো সেজন্যই কোভিড স্প্রেডার শব্দটা নিষিদ্ধ।
শব্দগুলো দেখলেই বোঝা যাবে কেন সেগুলো নিষিদ্ধ করা হলো। ব্রিটিশ জমানায় বা জরুরি অবস্থার সময়ও এরকম হয়নি। বিরোধীদের মুখ নিয়ম বানিয়ে বন্ধ করে দেওয়া। এটা অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী লক্ষণ শুধু নয়, তার চেয়েও কয়েক কদম বেশি, একনায়কতন্ত্রী, ফ্যাসিবাদী মনোভাব। যা খুশি তাই করার মনোভাব।
হঠাৎ কে একটা এসে কানে কানে রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত নাটকের সংলাপ শুনিয়ে গেল, ‘জগৎটা বাণীময় রে, তার যে দিকটাতে শোনা বন্ধ করবি, সেইদিক থেকেই মৃত্যুবাণ আসবে।'
মৃত্যুবাণ! আজ কাল নয়তো পরশু।
সংসদ ভবনের আশেপাশের এলাকায় সাংসদরা কোনও বিক্ষোভ, ধরনা, ধর্মঘট, অনশন বা কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে পারবেন না।
ক'দিন আগেই নতুন সংসদ ভবনের মাথায় বিরাট অশোক চক্র বসেছে, যার সিংহের মুখ নিয়ে এখন খুব তর্কাতর্কি চলছে। সেদিন নিয়মনীতির কোনও বালাই ছিল না। সংসদ ভবনের জিম্মাদার লোকসভার স্পিকার। কিন্তু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। পাশে দর্শক লোকসভার স্পিকার। ডাকা হয়নি রাষ্ট্রপতিকে।
সংসদ চত্বরে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানই করা যায় না। অতীতে কখনও হয়েছে বলেও জানা নেই। সেখানে হল হিন্দু আচারে মূর্তি উন্মোচন। সংসদ ভবন তো সারা দেশের ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সব মানুষের। সেখানে কোনও একটি ধর্ম মেনে কাজ তো ভারতের মূল ধারণার বিরোধী। সেটাই করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দর্শক লোকসভার স্পিকার।
সংসদ ভবনের উল্টো দিকে বসে সব দেখে যাচ্ছেন জাতির জনক।

সংসদের সামনে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দাবিতে ধর্নায় বসেছেন বিভিন্ন দলের সাংসদরা। সেটা গণতন্ত্রের অংশ।

![]() |
| নতুন সংসদ ভবনে অশোক চক্র উন্মোচন অনুষ্ঠান |
বিজেপির কিছু নেতা দেখি বলছেন, ধর্না দিতে হলে যন্তর মন্তরে গিয়ে দিন।
যন্তর মন্তর! সেই 'হীরক রাজার দেশে'র 'যন্তর মন্তর' ঘরের কথা মনে আছে? কী হত সেখানে, সেটাও নিশ্চয়ই মনে আছে।
মিলটা কাকতালীয়। কিন্তু মিলটা বেশ প্রতীকি।
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ হোর্ডিং লাগানোয় যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে (এলাহাবাদ) গ্রেফতার পাঁচ।
![]() |
| প্রয়াগরাজের রাস্তায় হোর্ডিং |
কী ছিল দুটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ঝোলানো ‘আপত্তিকর’ হোর্ডিংয়ে? হোর্ডিংয়ে মোদীর কার্টুনের হাতে একটি গ্যাস সিলিন্ডার। নীচে লেখা সিলিন্ডারের দাম ১,১০৫ টাকা। তার পাশে লেখা,
‘কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আপনি অনেকের জীবন কেড়ে নিয়েছেন।’ ‘চুক্তিবদ্ধ চাকরি দিয়ে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন নষ্ট করেছেন।’
‘মোদী স্যারের গ্রাফ দিনের পর দিন নামছে।’
একদম নীচে লেখা
#ByeByeModi.
অভিযোগ পেয়েই প্রয়াগরাজের কর্নেলগঞ্জ থানা ৫ জনকে গ্রেফতার করে।
গত বছর দিল্লিতেও করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রের ব্যর্থতা এবং সরকারের জাতীয় টিকা নীতির সমালোচনা করে পোস্টার ঝোলানোয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে একটি সামাজিক সংগঠনের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
সরকারের সমালোচনা করা যাবে না? সমালোচনা করলেই জেল?
রয়্যাল এনফিল্ডে যাচ্ছিলেন 'শিব-পার্বতী'। হঠাৎ মোটরবাইকের স্টার্ট বন্ধ। তেল শেষ। ব্যস, দুজনের ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। কথা যে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে...জ্বালানির দাম, জিনিসের দাম, মোদী সরকারের নীতি...। অনেকেই দেখতে দাঁড়িয়ে গেছেন। শেষে বোঝা গেল, সবটাই সাজানো। পথনাটক। ঘটনাটা অসমের নগাঁও কলেজ চকের।
![]() |
| ধৃত 'শিব' বিরিঞ্চি বোরা ও 'পার্বতী' পরিসীমিতা দাস |
বেশ মজাই পেয়েছেন দর্শকরা। ততক্ষণে অবশ্য সদর থানায় চলে গেছে বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কয়েকজন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ 'শিব' বিরিঞ্চি বোরা ও 'পার্বতী' পরিসীমিতা দাসের বিরুদ্ধে। পুলিশ বিরিঞ্চিকে গ্রেফতার করে। পরে তিনি জামিন পান। তার আগে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে টুইট করে বলতে হয়, ‘দেবতার পোশাক’ পরা কোনও অপরাধ নয়।
নূপুর শর্মা সম্পর্কে মামলার পর্যবেক্ষণে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ বলেছিল, দেশে যে অশান্তির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার জন্য দায়ী একা নূপুর। দেশের সামনে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত।
![]() |
| সুপ্রিম কোর্ট |
তারপরই সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনায় ১১৭ জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবী, সেনা আধিকারিক, আমলা খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।
ওই চিঠিতে অন্যতম স্বাক্ষরকারী দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এসএন ধিংড়ার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অবমাননার মামলা দায়ের করতে চান আইনজীবী সিআর জয় সুকিন। আদালত অবমাননা আইনের ১৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করতে হলে অ্যাটর্নি জেনারেলের সম্মতি প্রয়োজন। অ্যাটর্নি জেনারেল কেকে বেণুগোপালের কাছে আবেদনে আইনজীবী সুকিন লেখেন, ‘নূপুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেআইনি এবং অনৈতিক বলেছেন বিচারপতি ধিংড়া।’ অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল আমন লেখি ও প্রবীণ আইনজীবী কে রামকুমারের বিরুদ্ধেও অবমাননার মামলা দায়েরের আবেদন করেন ওই আইনজীবী। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়ে দিয়েছেন, নীতিগত এবং যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা আদালত অবমাননার আওতায় পড়ে না।
অর্থাৎ সরকারও মনে করে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করে যা বলা হয়েছে সেটা 'নীতিগত এবং যুক্তিসঙ্গত'।
গুজরাত দাঙ্গা মামলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ক্লিনচিট দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কী বলেছে,
![]() |
| গুজরাট দাঙ্গার দুই মুখ। তখন-এখন |
‘রাজ্য প্রশাসনের (গুজরাটের মোদী সরকার) সময়োচিত পদক্ষেপ, তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঠিক আন্তরিকতা ও বারংবার দোষীদের শাস্তি দেওয়া, শান্তি রক্ষার প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কোনও সাধারণ জ্ঞান থাকা মানুষ ভাবতেই পারবেন না কীভাবে রাজ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তারা ষড়যন্ত্র করতে পারেন। আদালতে বিচারের প্রশ্ন তো ওঠেই না। যা হয়েছে তা স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রশাসনের সামলানোর ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। এই মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে দেখা গেছে বিশ্বের অনেক দেশই সর্বোত্তম চিকিৎসা পরিকাঠামো নিয়েও মুখ খুবড়ে পড়েছে। চাপের মুখে তারা খেই হারিয়ে ফেলেছে। তা থেকে কি বলা যায় যে এর পিছনে ষড়যন্ত্র ছিল?’‘লক্ষণীয়ভাবে ১৬ বছর ধরে এই মামলা চালানো হয়েছে। অসৎ, উদ্দেশ্য প্রণোদিত কৌশলের প্রক্রিয়াকে যে পদাধিকারীরাই উন্মোচিত করেছেন, তাঁদের সততা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যাতে উত্তাপ বজায় থাকে, নিশ্চিতভাবেই তা অসৎ উদ্দেশ্যেই। এভাবে যাঁরা প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করেছেন তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। আইন অনুসারে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
ওই রায়ের পরের দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন,
‘বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত সাংবাদিক এবং কিছু এনজিও গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে মিথ্যা প্রচার করে। তাদের একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম ছিল। তাই সবাই সেই মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সুপ্রিম কোর্টের রায় আমি তাড়াহুড়ো করে পড়েছি। সেখানে স্পষ্টভাবে তিস্তা শেতলবাদের নাম আছে। তাঁর এনজিও সমস্ত থানায় বিজেপি কর্মীদের নাম জড়িয়ে অভিযোগ জমা করেছিল।সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, জাকিয়া জাফরি অন্য কারও নির্দেশে কাজ করেছেন। হলফনামায় স্বাক্ষর থাকা অনেক ভুক্তভোগী জানতেনই না যে তাঁরা কিসে স্বাক্ষর করছেন। সবাই জানে তিস্তা শেতলবাদের এনজিও এই কাজটি করছিল। সেই সময়ে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই এনজিওকে সাহায্য করেছিল।’
তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুম্বইয়ের বাড়ি থেকে তিস্তাকে গ্রেফতার করল গুজরাট এটিএস। গুজরাট থেকেই গ্রেফতার হন রাজ্য পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিজিপি আর বি শ্রীকুমার। অন্য একটি মামলায় জেলে থাকা আইপিএস সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
পুরোটা যে পরিকল্পিত ছক, বুঝতে অসুবিধা হয়?
এখন পুলিশ চার্জশিটে জানিয়েছে, সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব প্রয়াত আহমেদ প্যাটেল নরেন্দ্র মোদী সরকারকে ফেলার জন্য তিস্তাকে ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন।
শুধু ভাবছি, একটা রাজ্য সরকার ফেলতে মাত্র ২০ লক্ষ টাকা দিলেন! এই বুদ্ধি নিয়ে তিনি সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন!
![]() |
| নূপুর-জুবের-শ্রীকুমার-তিস্তা |
নূপুরের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশ আপত্তি জানালেও কোনও কথা বলেননি প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু বিজেপি বিবৃতিতে বলেছে, নুপুরকে সাসপেন্ড করা হল। ব্যস!
আর তিস্তা ও জুবেরের বেলা?
মানবাধিকার পরিষদ টুইটারে লিখেছে, ‘তিস্তা শেতলবাদের গ্রেফতারিতে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। আন্দোলন করা এবং ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া চলে না।’ অন্য দিকে, জ়ুবের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতারেসের মুখপাত্র বলেছেন, ‘এক জন সাংবাদিক কী লিখছেন, বলছেন বা টুইট করছেন, তার জন্য তাঁকে জেলে বন্দি করা যায় না।’ বাক্স্বাধীনতার প্রসঙ্গও তুলেছেন তিনি।
তিস্তা ও জ়ুবেরের গ্রেফতারি সম্পর্কে ফিলিপিন্সের নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা বলেছেন, ‘ভয়ানক ব্যাপার। এর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের কথা বলা উচিত, লেখা উচিত। তা আরও বেশি করে খবরের শিরোনাম হওয়া উচিত।’
সঙ্গে সঙ্গে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বিবৃতি দিলেন, ‘রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের মন্তব্য আমরা শুনেছি। এরকম মন্তব্য সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত এবং ভারতের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মধ্যে নাক গলানোর শামিল। দেশের বর্তমান বিচার প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভারত সরকার আইন-খেলাফির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এই ধরনের আইনি পদক্ষেপকে আন্দোলন-দমন হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। এর ফলে আসলে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়।’
![]() |
| প্রধান বিচারপতি ও প্রধানমন্ত্রী |
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার তাত্পর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রমনা। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বলেছিলেন,
‘যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার, সংসদ এবং বিচার ব্যবস্থার মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছে সংবিধান। কর্তব্যপালনে সেই লক্ষ্মণরেখা পার করা নিয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিত। এর ফলে গণতন্ত্রই শক্তিশালী হবে। বহু ক্ষেত্রেই আদালত রায় ঘোষণা করলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ভাবে সরকার নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।’
রাজস্থানে এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বললেন,
‘আমাদের সংবিধানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ভূমিকা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে সেগুলি সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। তার ফলে যে সব শক্তি ভারতীয় গণতন্ত্রের একমাত্র নিরপেক্ষ অঙ্গ বিচার বিভাগকে দমিয়ে রাখতে চায় তাদের সুবিধে হচ্ছে। আমি স্পষ্ট বলছি, বিচার বিভাগ একমাত্র সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ।’
সান ফ্রানিসসকোয় এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন,
‘আমেরিকা বৈচিত্রকে সম্মান করে বলেই আপনারা এখানে এসে কঠিন পরিশ্রম ও দক্ষতার ফলে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। বিভিন্ন ধরনের পরিবার থেকে আসা প্রতিভাধর ব্যক্তিকে সম্মান করা প্রয়োজন। তবেই সমাজের সব অংশের বিশ্বাস অর্জন করা যায়। এই নীতি ভারত-সহ বিশ্বের সব দেশেরই মেনে চলা উচিত। একুশ শতকে সংকীর্ণ ও বিভাজনকারী কোনও বিষয়ের ভিত্তিতে মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক চলবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সকলকে সঙ্গে নিয়ে না চলার অর্থ, বিপর্যয় ডেকে আনা।’
ওই সভাতেই ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রতি প্রধান বিচারপতির বার্তা, ‘দয়া করে মনে রাখবেন, আপনারা কোটিপতি হতে পারেন। কিন্তু সেই সম্পদ ভোগ করার জন্য শান্তি প্রয়োজন। ভারতে আপনাদের বাবা-মায়েদেরও এমন সমাজে থাকতে পারা উচিত যেখানে ঘৃণা ও হিংসার স্থান নেই।’
রাজস্থানের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন,
‘আমাদের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায়, প্রক্রিয়াটি শাস্তি স্বরূপ। তড়িঘড়ি ও নির্বিচারে গ্রেফতার থেকে শুরু করে জামিন পেতে অসুবিধা, বিচারাধীন ব্যক্তিদের দীর্ঘ সময় জেলবন্দী করে রাখা - এই সমস্ত কিছুর দিকে জরুরি ভিত্তিতে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।’
‘রাজনৈতিক বিরোধিতাকে শত্রুতায় রূপান্তরিত করা উচিত নয়, দুঃখজনকভাবে যা আমরা আজকাল প্রায়ই দেখছি। এগুলো সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। আগে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে বিরোধীদের জায়গা কমে যাচ্ছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সংসদীয় কার্যকলাপের অধোগতি প্রত্যক্ষ করছেন দেশবাসী।’
অতি সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের একটি মামলার শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি এনআইএ-কে বলেছিলেন, ‘যা শুরু করেছেন আপনারা, এর পরে তো কেউ খবরের কাগজ পড়লেও তাকে দোষী বলবেন!’
আগে বহুবার মুসলিম ও খ্রিস্টানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। তিনি বললেন, ‘মানুষের কাছে বুদ্ধি না থাকলে মানুষ পৃথক সবচেয়ে বেশি দুর্বল প্রাণী হত। কিন্তু শুধুমাত্র বুদ্ধির জোরেই আজ সে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। শুধু মাত্র খাওয়া-দাওয়া করা আর জনসংখ্যা বাড়ানোই মানুষের একমাত্র কাজ নয়। শুধু এই কাজ তো পশুরাও করে। যে বেশি শক্তিশালী সে-ই শুধু টিকে থাকবে, জঙ্গলের এটাই নিয়ম। কিন্তু মানুষের ভাবনার পদ্ধতি একদম আলাদা। মানুষ মনে করে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বাঁচতে সাহায্য করবে।’
ভাগবতের কথায় তবু কিছু রাখঢাক ছিল। সেটাও সরিয়ে দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
‘জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রাশ টানতেই হবে। একটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা নির্বিচারে বাড়বে আর মূল সম্প্রদায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে যাবে, এটা হতে পারে না। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর জনসংখ্যাগত ভারসাম্য না থাকলে দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করতে পারে।’
বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি বলেছেন, ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কোনও ধরনের সমস্যা নয়, এটা দেশের সমস্যা, একে জাতপাত, ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করা ঠিক নয়।’
আরে নকভি তো বলবেনই। উনিও তো মুসলিম। তাই না?
![]() |
| রাম মন্দিরের ভূমি পুজোয় মোদী-ভাগবত-যোগী |
প্রথম প্রশ্ন, প্রতি মুসলিম পুরুষ চারটে করে বিয়ে করলে ৭৫% পুরুষ অবিবাহিত থেকে যাবেন। বিয়ে কতগুলো, তার উপর কি জনসংখ্যা নির্ভর করে? সে আলোচনা অন্য সময় করা যেতে পারে। বাস্তবে আর্থিক অবস্থা, শিক্ষার মতো বিষয়গুলোই জনসংখ্যা, অপরাধ প্রবণতার মতো বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রক।
![]() |
এক ছকে সব কিছুকে ফেলার চেষ্টা। একমাত্রিক ছক। এখন, এই মুহূর্তে সেই শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য, বেপরোয়া মনে হচ্ছে। কিন্তু এক ছাঁচে ফেলে সভ্যতাকে চালানো যায়নি, যায় না। হিটলার-মুসোলিনি পারেননি।
'রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনও দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।...কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্থার সঙ্গে এদের জনসাধারণের অবস্থার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য ছিল, এই অল্পকালের মধ্যে দ্রুত বেগে বদলে গেছে, আমরা পড়ে আছি জড়তার পাকের মধ্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন।’
সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
চলুন আবার যাই হীরক রাজার দেশে। রাজদরবার। রাজার সব কথায় মাথা নেড়ে 'ঠিক, ঠিক'। উদয়ন মাস্টারের মুখ বন্ধ। যন্তর মন্তর ঘরে ঢুকিয়ে এক ছাঁচে ঢালা মানুষ তৈরির চেষ্টা।
![]() |
| সোভিয়েত ইউনিয়নে রবীন্দ্রনাথ |
'এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই, তা বলি নে—গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে শিক্ষা-বিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বর সঙ্গে বিস্তার তত্ত্ব যদি না মেলে তাহলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয়, মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।'
গত নয়ের দশকে সেই 'ছাঁচ' 'ফেটে চুরমার'।
![]() |
| যন্তর মন্তর ঘরে উদয়ন মাস্টার |
![]() |
শেষ পর্যন্ত? '...দড়ি ধরে মারো টান...'।
সত্যজিতের ছবিতে হীরক রাজাও দড়িতে হাত লাগিয়েছিলেন। বাস্তবের রাজা হাত লাগাবেন না। তাহলে?
লক্ষ লক্ষ তামিলকে নিকেশ করে সিংহলী জনতার নয়নের মণি হয়ে উঠেছিল রাজাপক্ষে পরিবার। এখন?
![]() |
| মুক্তি |
নীচের ছবিটা দেখুন।
বিপ্লবের আগুনেই তো প্রেম বাঁচে। জীবন বাঁচে। সভ্যতা বাঁচে।
![]() |
| কলম্বো। ২০২২ |
ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে
মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে,
ততই মোদের আঁখি ফুটবে।
এখন ওরা যতই গর্জাবে ভাই, তন্দ্রা ততই ছুটবে,
মোদের তন্দ্রা ততই ছুটবে।
তোরা ভরসা না ছাড়িস কভু,
জেগে আছেন জগৎ-প্রভু...
ওরা ধর্ম যতই দলবে ততই ধুলায় ধ্বজা লুটবে
ওদের ধুলায় ধ্বজা লুটবে।






















