ঠিক তার এক বছর আগে, আইফেল টাওয়ারের মাথায় যখন পতপত করে উড়ছে নাৎসী বাহিনীর স্বস্তিকা আঁকা পতাকা, অক্টোবরের শুরুতে জন্মালেন জন লেনন।
দ্রুত সময় বদলাচ্ছিল। পাল্টাচ্ছিল রাজনৈতিক সমীকরণ। তারই মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলেন কলেজ ছুট ডিলান।
 |
| পিট সিগার |
ষাটের দশকের গোড়ায় ভিয়েতনামকে কোণঠাসা করতে উঠেপড়ে লাগা আমেরিকার সংস্কৃতি জগতের একটা বড় অংশ দাঁড়িয়েছিল যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে। তার একটা কারণ হতে পারে ১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লব। ফিদেল কাস্ত্রোর তীব্র আমেরিকা বিরোধিতা, সমাজতন্ত্রের পক্ষে জোরদার সওয়াল, একটা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিল তামাম দুনিয়ার মানুষকে।
যদিও তারমধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেই সময়ই ১৯৬১ সালে পিট সিগার লিখছেন ‘Where have all the flowers gone?’
 |
| ডিলান। ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ডস’ |
’৬২-তে ডিলান লিখলেন ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ডস’। সেই শুরু। থামছেন না ডিলান। ’৬৩ সালে লিখলেন ‘মাস্টার্স অফ ওয়ার’, ‘Come you masters of War/You that build all the guns/You that build the death planes/You that build big bombs,/You that hide behind desks/I just want you to know/I can see through your masks...’। শেষ হচ্ছে এভাবে, ‘And I hope that you die/And your death’ll come soon/I will follow your casket/In the pale afternoon/And I’ll watch while you’re lowered/Down to your death bed/And I will stand o’er your grave/Till I’m sure that you are dead.’এই ’৬৩ সালেই মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র শোনালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। তার আগের বছর মৃত্যু হয়েছে নাজিম হিকমতের।
 |
| ‘It's Alright, Ma (I'm also Bleeding)’ |
কোথাও কি ভয় পেলেন ডিলান? ’৬৫ সালে প্রায় সাড়ে সাত মিনিট দীর্ঘ গান রেকর্ড করলেন বব। ‘It's Alright, Ma (I'm also Bleeding)’। যার কয়েকটা লাইন ‘And if my thought-dreams could be seen/They’d probably put me head in a guillotine/But it’s alright, Ma, its life and life only’।’৬৬-তে পিট সিগার গাইছেন ‘Bring them home’, ’৬৯-তে লেননের সৃষ্টি ‘Give peace a chance’। খুব জমল না গানটা। ’৭১ সালে সেই লেননই লিখে ফেললেন সর্বকালের বিখ্যাত, ‘Imagine’।
 |
| সেই প্রতিবেদন |
কোথায় ডিলান? এটা জানতে হলে, আমাদের ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল ব্রিটেনের ‘The Telegraph’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘How the US nearly turned to Bob Dylan to destroy Communism’ শিরোনামে নিক অ্যালেনের লেখাটি। উইকিলিকসকে উদ্ধৃত করে তিনি জানাচ্ছেন, ‘Musicians including Bob Dylan, Don McLean, Joni Mitchell and James Taylor were suggested as part of a plan by the US government to undermine Communism in the Soviet Union in the 1970s.’ দুঃখের হলেও এটাও সত্যি। ইনিই সেই ডিলান, যিনি লিখেছিলেন, ‘...Go 'way from my window/Leave at your own chosen speed/I’m not the one you want babe/I’m not the one you need./You say you’re lookin’ for someone/Never weak but always strong,/To protect you an’ defend you/Whether you are right or wrong.’ নিজের হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীকে যে ভাবে বলতে পারেন ডিলান, সেভাবে যুদ্ধবাজদের ফিরিয়ে দিতে পারলে আমরা অল্প জানা সঙ্গীতপ্রেমীরা হয়তো আনন্দ পেতাম।
 |
| পিঙ্ক ফ্লয়েড। ডগস অফ ওয়ার |
ডিলান নিজেকে কখনও কমিউনিস্ট বলে দাবি করেননি। ওঁকে বড়জোড় যুদ্ধবিরোধী প্রগতিশীল মানুষ বলা যায়। সারা পৃথিবীতে এমন মানুষ কিছু কম নেই। এমনকি এলভিস প্রিসলিও যুদ্ধবিরোধী গান গেয়েছেন। আশির দশকের শেষ দিকেও পিঙ্ক ফ্লয়েড তাঁর সাড়া জাগানো ‘The Dogs of War’ গেয়েছেন। তাই Gulf War সম্পর্কে কেন ডিলান চুপ ছিলেন সে প্রশ্ন অবান্তর। আরও বেশি করে অবান্তর, কারণ ’৯৭ সালেই ক্লিনটন সাহেব হোয়াইট হাউসে ডেকে ডিলানকে আদরযত্ন করে পুরস্কার-টুরস্কার দিয়ে ফেলেছেন।
 |
| ডিলানকে সংবর্ধনা বিল ক্লিনটনের |
’৯১ সালে Grammy পেলেন ‘World Gone Wrong’ লিখে। আর শতাব্দীর শুরুতেই ধানাই পানাই না করে লিখে ফেললেন, ‘Things have changed’। ‘...The place ain’t doing me any good/I’m in the wrong town,/I should be in Hollywood’। অস্কারও পেয়ে গেলেন ওই গানের জন্য। তারপর স্বপ্নের উড়ান।‘আমি সমাজ কে কী দিলাম?’ এই প্রশ্ন অনায়ােস পাল্টে হয়ে যায়, ‘আমি সমাজ থেকে কী পেলাম?
এবং পেলেন। ২০১০ সালে মহামান্য ওবামা সাহেবের সঙ্গে উদযাপন করলেন ‘Music from the Civil Rights Movement’, ’১২ সালে ওনার গলায় পরিয়ে দিলেন ‘Medal of Freedom’, ’১৬ সালে নোবেল। বৃত্ত সম্পূর্ণ। আর কী চাই! |
| মেডেল অফ ফ্রিডম। ডিলানকে সম্মানিত করছেন বারাক ওবামা |
বাংলার মানুষের কাছে এটা কি নতুন কোনও গল্প? গত কয়েক বছরে আমরা কি কম কিছু দেখলাম? ডিলান থেকে ডহরবাবু–আমরা সব দেখছি বগল বাজিয়ে। কী অদ্ভুত সমাপতন! ডিলানকে যখন আমেরিকার সরকার ভরিয়ে দিচ্ছে উপহার আর সংবর্ধনায়, ঠিক তখনই, দিনে পাঁচটা করে সিপিআইএম খুনের নিদান দিচ্ছেন কলকাতার এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, তাঁরও হাতে তখন ডিলানের পাঠানো গিটার।
 |
| জয়দেব বসু ১২.০৫.১৯৬২-২৩.০২.১২ |
প্রতিদিন পুড়ে যেতে যেতে শব্দ হাতড়াচ্ছি আমরা। মনে মনে ফিরতে চাইছি ফেলে আসা যৌবনে, যেখানে পাবলো নেরুদা থেকে কবি জয়দেব বসু এক হয়ে যান। যখন কানের কাছে মুখ রেখে নেরুদা বলে ওঠেন, ‘আমরা তো জানতামই রক্ত ঝড়াতে হবে’, আর জয়দেব মনে করিয়ে দেন, ‘সময় পরিতাপের না’। যখন প্লিঙ্ক ফ্লয়েড চিৎকার করে গেয়ে ওঠেন ‘Dogs of War and men of hate/With no cause, we don’t discriminate’. আর এই গভীর আচ্ছন্নের মাঝেই আবার স্বপ্ন দেখি, নতুন ভোরের...এক নতুন উদ্দীপনায়।