In my life I have earned each & everything. In a span of time I loose each of those. Life has taken back everything from me one by one. I don't find any meaning of this life any more. হেরে গেছি
পোস্টটার অর্থ বুঝতে খুব কষ্ট করতে হয় না। খানিকটা ভয়ে ভয়েই ফোন করলাম। স্বস্তি দিয়ে সাম্য ফোনটা ধরল। জানলাম, সাম্য বেঁচে আছে। ব্যবসার কাজে কলকাতার বাইরে আছে।
২৭ মে রাত ২.০৯ মিনিটে সাম্য পোস্ট করেছে।
আমি ভালো আছি। একটা কল আমাকে আজ বাঁচিয়ে দিলো। হ্যাঁ, Dhrubajyoti Pramanik দাদা জীবনের লাস্ট বল অবধি খেলবো!!
![]() |
| সাংবাদিক ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক |
![]() |
| (উপর থেকে) পল্লবী দে, বিদিশা দে মজুমদার, মঞ্জুষা নিয়োগী |
![]() |
| (উপরে থেকে) নুসরত জাহান, রচনা ব্যানার্জি |
নুসরত, রচনাদের কথায় বিরক্ত লাগে, রাগ হয়। প্রায় সাড়ে ৫ বছর ডিপ্রেশন বা অবসাদে গুরুতর কাহিল ছিলাম। আত্মহত্যার ভাবনাও তাড়া করেছে।মাসখানেক হাসপাতালেও ভর্তি ছিলাম। তাই এই রোগটা সম্পর্কে কিছু ধারণা আছে। ধারণা আছে আত্মহত্যার ভাবনা সম্পর্কেও।
রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমি। তুমুল গতিতে আসা ট্রেন ধাক্কা মারছে। ছিটকে পড়ছে আমার রক্তাক্ত, থেঁতলানো শরীরটা। চিন্তাটা সরাতে চেয়েছি। পারিনি। কত রাত, কত দিন, কত সময় কেটেছে এই চিন্তায়। সে অস্থিরতা, সে যন্ত্রণা ভাষায় বোঝানো আমার পক্ষে অসম্ভব। বাঁচার তীব্র আকাঙ্খায় শেষে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আর মনোবিদদের সাহায্যে এখন ভাল।
নুসরত-রচনার মতো আরও কয়েক জন সেলেব্রিটির কথা শুনলাম বা পড়লাম। দেখুন, আপনি যে-ই হোন, জীবনে যতই প্রতিষ্ঠিত হোন, যতই জনপ্রিয় হোন, সব তো আপনি জানতে পারেনা না, বুঝতে পারেন না। প্রত্যেকেরই একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেটা মনে রাখা দরকার, বিশেষত সেলেব্রিটিদের। কারণ অনেক মানুষ তাঁদের কথা শোনেন, বিশ্বাস করেন, ভরসা করেন। মুশকিল হল, মিডিয়াও ওই সব আকাট মতামত প্রকাশ করছে। মৃত্যুও তো এখন পণ্য। মৃত গ্ল্যামার দুনিয়ার হলে তো কথাই নেই।
সেলেব্রিটিদের সবিনয়ে বলছি, এটা বোঝার কাজটা বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিন, প্লিজ। এমনিতেই মনোরোগ নিয়ে আমাদের অশিক্ষার অন্ত নেই। দয়া করে, আলতু-ফালতু বকে পরিস্থিতিটাকে আরও ঘেঁটে দেবেন না। আমি নিতান্ত সামান্য এক মিডিয়া কর্মী। নুসরত-রচনা, আপনাদের যদি অভিনয় শিক্ষা দিতে চাই, কেমন হবে? হেসে গড়িয়ে পড়বেন নিশ্চয়ই। সেটাই উচিত। যে বিষয়ে কিছুই জানেন না, সে বিষয়ে মতামত দিলে আপনাদের নিয়েও হাসাহাসি হতে পারে বা আমার মতো অনেকে ক্রুদ্ধ হতে পারে। আপনারা বিখ্যাত। মিডিয়া নানা বিষয়ে আপনাদের মন্তব্য চায়। না জেনে-না বুঝে সব ব্যাপারে মতামত দিতেই হবে? তাতে নিজেদের মর্যাদা তো বাড়েই না, উল্টে অনেককে ভুলভাল শিখতে সাহায্য করেন।
মানসিক রোগী। কথাটা শুনলেই অনেকে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। তাই অনেকেই নিজের মানসিক রোগের কথা চেপে রাখেন। মানসিক রোগ ব্যাপারটাকে আমাদের সমাজ খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়নি। মানসিক রোগ আর মানসিক ভারসাম্য হারানো, দুটো যে এক নয়, সেই বোধটাও তৈরি হয়নি। মানসিক রোগ ব্যাপারটা অনেকের কাছেই এডসের মতো গোপন রোগ। অথচ দুনিয়াজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে ডিপ্রেশনের তাণ্ডব। ঠিক সময়ে চিকিৎসায় সুস্থ হওয়াও সম্ভব।
প্রতি ১৫ জন সাবালকের একজন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। প্রতি ৬ জনের মধ্যে একজন কখনও না কখনও ডিপ্রেশনের শিকার হয়েছেন। পৃথিবীর জনসংখ্যার ৩.৫% ডিপ্রেশনে ভুগছেন। দেশগুলোর মধ্যে ভারত সামনের সারিতে।২
০১৫-১৬ সালে নিমহ্যানসের হিসেব, ভারতে সাবালকদের ১০.৬% এবং বয়ঃসন্ধির ৭.৩% ডিপ্রেশনের শিকার।
তথ্যগুলো দিলাম, তাতে বিপদের গভীরতা খানিকটা যদি বোঝা যায়। আরও অনেক তথ্য দেওয়া যায়। কিন্তু সে ভার চাপাতে চাইছি না।
আমার অসুস্থতার কথা জেনে অনেকে বলেছিলেন, তুমি কতজনের অনুপ্রেরণা। আর তোমার মতো মানুষের অবসাদ? কেউ বলেছেন, ওটা বড়লোকের রোগ।তোমার জন্য নয়। বেরিয়ে এসো।
অনেকেই ডিপ্রেশনকে বড়লোকি বায়নাক্কা বা দুঃখবিলাস মনে করেন। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় আউটডোরে বা ইনডোরে দেখেছি গ্রামের গরীব মানুষের মধ্যে মনোরোগ কতটা ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে।
আন্তরিক ভাবে যাঁরা আমাকে সুস্থ করতে চেয়েছেন, তাঁরাও বলতেন, তোমার রোগ তো শরীরে নয়, মনে। মনটা শক্ত করো। মনের জোরে সব হয়। দু' পা বাদ গেলেও লোকে তা নিয়ে পাহাড় পেরোয়, সমুদ্র পেরোয়।
কেউ বলতেন, গান শোনো, বই পড়ো, ঘুরতে যাও, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাও, নিজেকে ভাল রাখো, মনটাকে আনন্দে রাখ।
সেই সব আন্তরিক কথাগুলিও তখন বিরক্তিকর, এমনকি সময়ে সময়ে নির্দয় শোনাত। মনে হত, তাঁরা আমার সমস্যাটা বুঝতেই চাইছেন না।
সমস্যার গোড়াটা যে কী, সেটা বুঝতে চাইতাম। কিন্তু বুঝতে পারতাম না। কখনও মনে হত বাড়ি, কখনও মনে হতো অফিস, কখনও মনে হতো আর্থিক সমস্যা, কখনও মনে হতো স্ত্রী বা ছেলে হল সমস্যার কারণ। সমাধানের রাস্তাও বুঝতে পারতাম না। এখন বুঝতে পারি এর কোনওটাই রোগের কারণ নয়। সেরকম পরিস্থিতিতেও (কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও) তো এখন ভাল আছি। চারপাশটা অন্ধকার মনে হচ্ছে না। উল্টে রং চোখে পড়ছে।
অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, সহানুভূতি নয়, সহমর্মিতা চাই। অনেকে কারণ খুঁজতে বসেন। ডিপ্রেশনের কারণ যে সব সময় খুব স্পষ্ট হবে, তা নয়। তাই সে সব না ভেবে চিকিৎসা করাতে হবে।
অহেতুক জ্ঞান দিয়ে সময় নষ্ট করার চেয়ে রুগীকে ডাক্তার বা থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাঁদের কাছ থেকেই রোগটা সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তবেই প্রিয়জনকে সুস্থ করা যাবে।
ও পারলে তুমি পারবে না কেন, অমুক তোমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে কিন্তু ও তো তোমার মতো হয়ে যায়নি কিংবা পঙ্গুর পাহাড় পেরনোর মতো উদাহরণগুলো দেবেন না। কারণ না পারাটাই তো রোগ। তাতে রুগী আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন।
ঋতু বদলের সময় ঠান্ডা পরে। তাতে কি সবাই অসুস্থ হন? না। অনেকেই হন না, কেউ অল্প হন, কারও অসুস্থতা বাড়াবাড়ি রকমের হয়। ডিপ্রেশন বা অন্য কোনও মনের রোগও তাই। কোনও পরিস্থিতিতে কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারেন, কেউ অল্প কাতর হন, কেউ কাতর হন বাড়াবাড়ি রকমের। আবার কেউ কোনও সময় স্বাভাবিক থাকলেও পরবর্তীতে তুলনামূলক ভাল অবস্থাতেও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
অসুস্থতার সময় আর্থিক সমস্যা নিয়ে খুব কাতর থাকতাম দেখে আমার এক বন্ধু বলত, রাজনীতি করার সময় আমার কাছ পঞ্চাশ টাকা চেয়ে নিয়ে দিব্যি ডায়মন্ড হারবার চলে যেতে। সেই তুমি টাকার জন্য কাতর হচ্ছো! কথাটা ঠিক। কিন্তু কথাটায় কোনও উপকার হত না। কারণ রোগটাই তো ওভাবে ভাবা। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে ওই বন্ধুই আমাকে সুস্থ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়।
সেই বোঝাটাই বেশ গোলমেলে ব্যাপার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ২০১৮ সালে তাদের টুইটারে একটি পোস্টার পোস্ট করেছিল। তাতে মানসিক অবসাদ কাটাতে বাতলানো হয়েছিল দশটি দাওয়াই। রুটিন মেনে চলা, বেড়াতে যাওয়া, সৃষ্টিশীল হওয়া, ভিটামিন বড়ি খাওয়া, সদর্থক চিন্তা করা, যোগব্যায়াম করা, পরিচ্ছন্ন থাকা, আট ঘণ্টা ঘুমোনো, ফল খাওয়া এবং হাঁটা। বাস্তবে অবসাদে ভোগা রোগীকে সদর্থক চিন্তা করতে বলা বা পর্যাপ্ত ঘুমোতে বলা আর গরিব মানুষকে বড়লোক হয়ে যেতে বলা, একই ব্যাপার।
ওই পোস্টারের সঙ্গে অবসাদের সংজ্ঞাও দেওয়া হয়েছিল। বলা ছিল, অবসাদের অর্থ মনমরা ভাব, যার প্রভাব পড়ে এক জন মানুষের ভাবনাচিন্তা, আচরণ এবং ভাল থাকার বোধের উপরে। অবসাদগ্রস্ত মানুষটির উচিত এমন কিছু কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, যা তাঁকে অবসাদ কাটিয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করবে। অথচ,
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা বলছে, অবসাদ হল একটি সাধারণ মানসিক অস্বাভাবিকতা। এর লক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা, পছন্দের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং অন্তত দু’সপ্তাহ ধরে প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে অসমর্থ বোধ করা। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মনঃসংযোগ কমে যাওয়া, খিদে নষ্ট হওয়া, বেশি বা কম ঘুমোনো, নিজেকে অপরাধী বা অপদার্থ ভাবা, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও। তাদের মতে, ঠিকমতো চিকিৎসা হলে রোগটি সেরে যায়।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ২০১৮ সালের সেই পোস্টারে কোথাও চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেইনি। সরকার বাহাদুর নিজেই বোঝে না তো বোঝাবে কী করে? সরকার বাহাদুর নিজেই অসংবেদনশীল, দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে উপায় কী?
ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ লাগে। অনেক ক্ষেত্রে থেরাপিতেই কাজ হয়।
কে কোন পর্যায়ে আছে তা নিজেরা মাপার চেয়ে, 'আয় বেঁধে বেঁধে থাকি' বলে কাব্য করার চেয়ে, বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যাওয়া, তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ করাটা বেশি জরুরি। মানসিক রোগের প্রতিক্রিয়া বহু ক্ষেত্রেই শরীরে ছাপ ফেলে। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, পেটের সমস্যা, এমনকী চোখ খারাপ হয়ে যাওয়া, এরকম অনেক কিছুই ঘটতে পারে মানসিক রোগের জেরে। কারণ ডিপ্রেশন বা অন্য মানসিক রোগে শরীরে বেশ কিছু রাসায়নিকের ভারসাম্যের বদল ঘটে যায়। ওষুধ সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তার সঙ্গে কাউন্সেলিং। কাউন্সিলর মানে মনোবিদ কোনও জাদু জানেন না যে তাঁর কথায় সব পাল্টে যাবে। ভাবনা কোন পথে এগিয়ে নিয়ে গেলে সুস্থ থাকা যাবে, কী ভাবে চারপাশটা দেখা গেলে সুস্থ থাকা যাবে, মনোবিদ সেই পরামর্শ দেন, অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত পথে লেখাপড়া করে।
হাসপাতালে থাকতে থাকতে দেখেছি আত্মহত্যার ভাবনাটা আস্তে আস্তে সরে গেছে। কিন্তু হাসপাতালে তো বটেই, বাড়ি আসার পরেও নানা শারীরিক কষ্ট হত। ঘুম হত না। খুব গরম লাগত। ডাক্তারবাবুর গুষ্টির ষষ্টিপুজো করে ছাড়তাম। কিন্তু ওঁদের দেওয়া ওষুধ নিয়মিত খেয়ে গেছি। থেরাপিস্টদের পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করেছে আমার মতো বেয়াদপ লোকও। একদিন হঠাৎ দেখলাম পাল্টে গেছে সব। শরীরের কষ্টগুলো অনেকটাই চলে গেল, মন অনেক তাজা হয়ে গেল, ঘুম ফিরে এল। তাই বলছি কারণ খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে সে সব ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। পাশের মানুষেরও উচিত অবান্তর কথা না বলে নিজের ভূমিকাটা পালন করা। রুগীকে সুস্থ করতে পাশের লোকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকে শারীরিক রোগের চেয়ে মনের রোগকে কম গুরুত্ব দেন। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা উল্টো।
মনের জোর অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যাকে জয় করতে সাহায্য করে। কিন্তু মনের সমস্যা মানে তো মনই দুর্বল হয়ে গেছে। মনের জোর রাখো বলে শারীরিক ভাবে অসুস্থকে সাহায্য করা যায় কিন্তু মানসিক রুগীকে যায় না। মনের জোর না থাকাটাই তো তাঁর রোগ। দয়া করে রুগীকে বলবেন না, মনে আনন্দ আনো। মনে রাখুন, ওটাই রোগ। অনেকে ভাবেন, সবাই মিলে হইচই করা, সিনেমা দেখা, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া-এসব করেই অবসাদ আক্রান্তের মন ভাল করে দেওয়া যাবে। ভুল হয়ে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, মন খারাপ আর অবসাদ, এক জিনিস নয়। যাঁর আনন্দ নেওয়ার ক্ষমতাই কমে গেছে, তাঁকে এ ভাবে আনন্দ দেওয়া যায় না। সেটা না বুঝলে মুশকিল। মনে হবে, আমি তো ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করছি। ও চায় না আনন্দে থাকতে। ওর জন্য আর চেষ্টা করে লাভ নেই। ব্যাপারটা যেন জল খেয়ে জলাতঙ্ক সারানোর মতো না হয়ে যায়।
যাঁরা মেজর ডিপ্রেশনের শিকার তাঁদের কাছে দৈনন্দিন অত্যন্ত সাধারণ প্রতিটি কাজ, যেমন বিছানা থেকে ওঠা, খাওয়া, দাঁত মাজা, বেল বাজলে দরজা খোলা, সন্তানকে পড়ানো ইত্যাদি কাজই পঙ্গুর পাহাড় জয়ের মতো কঠিন লাগে।রোগাক্রান্ত কাউকে সুস্থ করতে তিনি সকাল থেকে রাত যে কাজগুলো করে যাচ্ছেন, তার জন্য বাহবা দিন, কারণ কাজগুলো যত সহজই হোক না কেন সেগুলো তাঁর কিন্তু খুব কষ্টকর মনে হচ্ছে। অনেক ভুল করবেন রুগী। সেগুলো না-ই বা ধরালেন। আমাদের জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কতই না ভুল জড়িয়ে থাকে। ওই ভুল না ধরানোটাও কিন্তু ওষুধ।
সবচেয়ে জরুরি, ডিপ্রেশনের রুগীদের কথা শোনা। বলা নয়, শোনা। রোজ। সময় ধরে, নিয়ম করে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতে পারে, ঘ্যানঘ্যানানি মনে হতে পারে। তা-ও শুনুন। এবং দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখুন। উপদেশ দেওয়ার বাসনা চেপে রাখুন। তাহলে রুগীর উপকারের চেয়ে অপকারের আশঙ্কাই বেশি থাকে। মনে রাখুন, প্রিয়জন অসুস্থ। চিকিৎসাই তাঁকে সুস্থ করতে পারে। আর সে জন্য শারীরিক যে কোনও রোগের মত এক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞরা আছেন।
ব্যক্তিমানুষের অন্তরের রক্তক্ষরণ, মানসিক ভাবে তাঁর একা হয়ে যাওয়া, সব সময় বোঝা যায় না।
কেউ কেউ বলেন, মা-বাবার কথা ভাবো। কেউ বলেন, সন্তানের কথা ভাবো। রোগটা ঠিক মতো বুঝতে পারেন না বলেই বলেন। আরে ভাই, সেটা ভাবতে পারলে কি আর অসুস্থ হবে? এ সব ভাবতে না পারাটাই তো রোগ। আর মানব মনের একান্ত নিজস্ব উপলব্ধি হল, অন্যের জন্য নয়, মানুষ সবসময় নিজের জন্য বাঁচে। একা বাঁচা যাবে না বলে সে অন্যের হাত ধরে। মনোরোগীকে সাহায্য করতে গেলে এই কথাটা মনে রাখা খুব জরুরি। বাবা-মা-সংসার-সন্তানের কথা না ভাবানোর চেষ্টা করে, তাঁর নিজের জন্য কেন তাঁকে ভাল থাকতে হবে, সেটা বোঝান সবচেয়ে জরুরি।
এই সব পরিস্থিতিতে পাশের মানুষের ধৈর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিপ্রেশনের রুগীকে দেখে বোঝা যায় না। অন্যরা তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও রুগী সেটা নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রেও কাছের লোকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ডিপ্রেশনে ভোগা মানেই যে আত্মহত্যা, তা নয়। কিন্তু কখন কেন যে কারও কাছে জীবন অর্থহীন হয়ে যায়, বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে যায়, সেটা কেউ জানে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর দুনিয়ায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মঘাতী হন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি আত্মহত্যা। গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যা বেড়েছে ৬০%। এখন দুনিয়ায় ১৫-৪৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি, আত্মহত্যা। দুনিয়ার আত্মঘাতী মানুষদের ১৮% ভারতের। ভারতের দক্ষিণ ও পূর্বের রাজ্যগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি। পশ্চিমবঙ্গ তিন নম্বরে, তামিল নাড়ু ও মহারাষ্ট্রের পরেই। আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি ১৫-৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে। এখন শুধু নয়, বরাবরই। (নুসরত জাহান, রচনা ব্যানার্জিরা যখন ইন্ডাস্ট্রিতে নিউ কামার ছিলেন, পল্লবী বিদিশাদের মতো বয়সী ছিলেন, তখনও। যাঁরা প্রবল শিক্ষিত, আর্থিক ভাবে জাঁদরেল হয়েও বাবা-মায়ের নজর রাখেন না, বড়জোর বৃদ্ধাবাসের ব্যবস্থা করেই হাত ধুয়ে ফেলেন, তাঁরা স্বার্থপর, নৃশংস। তাঁদের সঙ্গে ডিপ্রেশনের রোগীদের এক আসনে বসিয়ে দেবেন না। কেনও মা-বাবা-সন্তান-পরিবারের কথা ভাবা ডিপ্রেশন রোগীর পক্ষে অসম্ভব, সেটা আগেই বলেছি। ওরা ইচ্ছাকৃত নয়, ওটাই রোগ।)
গবেষণা বলছে, আত্মহননকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই আগেভাগে ইঙ্গিত দেন। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই আবার লিখছি। আত্মহননকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই আগেভাগে ইঙ্গিত দেন।
যেমন ধরুন, হাসিখুশি-আড্ডাবাজ-সম্ভাবনাময় অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত। হঠাৎ ইনস্টাগ্রামে মাকে মনে রেখে একটা পোস্ট। হয়তো নিজের একাকীত্বের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। হয়তো অবচেতনে। তারপরের কথা তো সবার জানা।
শুনছি অতি সম্প্রতি আত্মঘাতী বিদিশা, মঞ্জুষাও নাকি আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বা আত্মহত্যার ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেছেন। পরিবারের লোকেরা বুঝিয়েছেন কিন্তু সমস্যাটা ঠিক কতটা গভীর সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি ছিল, কিন্তু নিয়ে যাননি। অনেকেই তো ভাবেন, মনের রোগ মানে বোঝালেই হয়ে যাবে। তাতে আবার ডাক্তার-বদ্যি কী করবে? অনেকে আবার মনের রোগের কথা পাঁচ কান করতে চান না। সমাজের মনোভাবই সে ভাবনার পেছনের কারণ। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে, একটি আত্মহত্যা একই পেশার অবসাদপ্রবণ অন্য কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আত্মহত্যা নিয়ে হইচই অবসাদগ্রস্ত কাউকে আত্মহত্যায় উৎসাহী করে তুলতে পারে। এটা নেশার মতো। হবেই তা নয়, তবে আশঙ্কা থাকে। তাই আত্মহত্যার খবর নিয়ে হইচই নিয়ন্ত্রিত হওয়াই ভালো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও, মুখরোচক গল্পের খোঁজে থাকা মিডিয়া সেই ভূমিকার কথা অনেক ক্ষেত্রেই ভুলে যায়। তারসঙ্গে আবোল তাবোল নানা ব্যাখ্যা হাজির করে পরিস্থিতি আরও গোলমেলে করে দিতে পারে।
![]() |
| সাম্য দত্ত |
আমি ভালো আছি|একটা কল আমাকে আজ বাঁচিয়ে দিল|হ্যাঁ Dhrubajyoti Pramanik দাদা, জীবনের লাস্ট বল অবধি খেলবো!!
এরকম অনেক 'ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক' দরকার। এরকম অনেক 'সাম্য দত্ত'-কে যে বাঁচাতে হবে। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এরকম একটা ফোন কলেই সব সময় কাজ হবে, তা কিন্তু নয়। খানিক বুঝিয়ে ছেড়ে দিলে হবে না। নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। রোগটা কেন, রোগটা সারবে কী করে, সেটা জানেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোবিদরা। তাঁদের কাছেই নিয়ে যেতে হবে। অমুকটা কারণ হতে পারে, তমুকটা কারণ হতে পারে, এইসব ভেবে দেরি করার চেয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটাই রাস্তা।
ডিপ্রেশন রোগটা কিন্তু মহামারীর মতো ছড়াচ্ছে। বাসে-ট্রেনে-রাস্তায় মাস্ক পরা নিয়ে যে সতর্কতা, এই ক্ষেত্রেও সেই সতর্ক মনোভাব যদি আমরা দেখাতে পারি, তাহলে অনেক পল্লবী-বিদিশা-মঞ্জুষারা বেঁচে থাকবেন।
দোহাই, কার কজনের সঙ্গে প্রেম ছিল, আর্থিক সংকট ছিল কিনা, প্রত্যাশা-লোভ বেশি ছিল কিনা সে সব নিয়ে কাটাছেঁড়া করে অবসাদের কারণ খুঁজতে গিয়ে মৃত মানুষটিকে অপমান করবেন না। একটু, অন্তত একটু, সংবেদনশীল হোন।
এদেশে বেশির ভাগ মনোরোগীই চিকিৎসা পান না। সংখ্যাটা প্রায় ৯০%। তার বড় কারণ সঠিক চিকিৎসার সুযোগটাই নেই। তার সঙ্গে মনোরোগ সম্পর্কে অদ্ভুত সামাজিক বিরূপ মনোভাবও আছে। মনোরোগীরা তাতে আরও বিপন্ন বোধ করেন।
যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে মনোরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, একজন মনোরোগী হিসেবে তাঁদের প্রতি অনুরোধ, নিজেদের রোগ গোপন করার কোনও কারণ নেই। পেট খারাপ, জ্বরের মতো মনের রোগও একটা রোগ। সময়মতো চিকিৎসা হলে সেরে যায়। মনোরোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা কেউ সে সম্পর্কে বললে অনেক সামাজিক, মানসিক বাধা যেমন কাটতে পারে, তেমনই অনেকে নিজের রোগের চিকিৎসা করাতে উৎসাহী হতে পারেন। মানে, ডবল অ্যাকশন।
মিডিয়ার কাছে অনুরোধ, সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালনের দায়টা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আত্মহত্যা, অবসাদ, মনোরোগের মতো অতি সংবেদনশীল বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি আমরা, যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নেয় বাংলা মিডিয়া।
সরকার বাহাদুরের কাছে অনুরোধ, প্রাথমিক স্কুলস্তর থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ার কাজটা শুরু হোক। ছাত্রছাত্রীদের মনের খোঁজ পেতে স্কুলে স্কুলে নিয়মিত শিবির করা হোক। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, অনেক সংস্থা ও চিকিৎসক সোৎসাহে কাজটা করতে রাজি হয়ে যাবেন। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা পাঠ্যসূচিতেও আনা হোক। ফয়েজ আহমদে ফয়েজের কবিতা বাদ দেওয়া বা সিঙ্গুর আন্দোলনের কথা সিলেবাসে ঢোকানোর চাইতে সেটা অনেক বেশি জরুরি।
শেষে আবার বলছি,
অনেক 'ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক' চাই। অনেক 'সাম্য দত্ত'-কে বাঁচাতে হবে। আর 'পল্লবী-বিদিশা-মঞ্জুষা'দের মৃত্যুর সাক্ষী হতে চাই না।
(কোনও ব্যক্তি ধ্রুবজ্যোতির স্তুতি গাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক স্রেফ একটা প্রতীক।)
এক মনোরোগীর অন্তরের সবটুকু শুভেচ্ছা-ভালবাসা-শ্রদ্ধা রইল ধ্রুবর জন্য। ধ্রুবদের জন্য।
সচেতন হোন। সচেতন করুন।
যাঁরা মনে করছেন, মনের কোণায় কেমন যেন একটা খাপছাড়া ভাব জন্ম নিচ্ছে, পৃথিবীটা বিস্বাদ ঠেকছে। সময় নষ্ট না করে কথা বলুন, যোগাযোগ করুন। মনে রাখবেন 'বন্ধু চল' বলার অনেক মানুষ আছেন হাতের কাছেই।







