গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ১০
 |
| বিমান বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য |
মূল ধারণাতেই গোলমাল। সংসদীয় ব্যবস্থা ছাড়া বদলের আর কোনও রাস্তা নেই। অভিজ্ঞতা সে কথাই বলছে। কিন্তু তাকে স্বীকার করা হচ্ছে না। এই দ্বিচারিতা থাকলে আদর্শগত অবস্থানে দৃঢ় থাকা যায় না। গেলও না। ক্রমশ বামপন্থা থেকেই সরে এল বামফ্রন্ট সরকার। যার খুল্লামখুল্লা প্রকাশ ঘটে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে।
অংকটা সোজা। নিজেদের বোঝাপড়ার সঙ্গে বাস্তব মিলছে না। বাস্তব যা শেখাচ্ছে তা আদর্শগত বোঝাপড়ার সঙ্গে মিলছে না। অনিবার্য পরিণতি উদ্যোগহীনতা, থমকে যাওয়া। যখন যেমন তখন তেমন রাস্তায় চলার অভ্যাস। তা বলে কি সরকার চালানোর রাস্তা থেকে সরে আসা হবে? অসম্ভব। আদর্শগত দুর্নীতি (যে বিশ্বাসের কথা বলি তা করি না, যা করি তা বিশ্বাস করি না বলে দাবি করি) থাকলে অনিবার্য ভাবে রাজনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতি তো হবে। নীচের দিকের বাম নেতাকর্মীদের দুর্নীতিকেই যাঁরা বামফ্রন্ট সরকারের পতনের কারণ মনে করেন, বিশেষত তাঁদের জন্য এই কথাটা জরুরি।
 |
| ২৭ জুলাই, ২০০০। নানুরের সূচপুরে খুন ১১ দিনমজুর |
কী দেখা গেল? ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে, যে কোনও ভাবেই হোক। অতএব, ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটে কেশপুর কেন্দ্রে সিপিআইএম প্রার্থী নন্দরানী ডল ১,৩৩,০২০ বৈধ ভোটের মধ্যে ১,২০,৫৬৬ পেয়ে জিতলেন ১,০৮,১১২ ভোটের ব্যবধানে। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে আরামবাগ কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী অনিল বসু জিতলেন ৫,৯২,৫০২ ভোটের ব্যবধানে। ২০১৯ পর্যন্ত সেটাই ছিল সারা দেশে লোকসভা ভোটে সব চেয়ে বেশি ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড।
 |
| অনিল বসু |
২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ১১% ('৭৮ ও '৮৩ সালে ১ শতাংশেরও কম, ‘৮৮- ৮%, '৯৩- ২.৮১%, '৯৮- ১.৩৬%, ২০০৮- ৫%)। তৃণমূল জমানায় ২০১৩ সালে ১০.৬৬% এবং ২০১৮ সালে ৩৫.২৬% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় সেই ট্র্যাডিশন মেনেই। তখন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস যা বলতেন এখন সেটাই বলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়-'বিরোধীরা প্রার্থী না পেলে আমরা কী করব? ওদের জন্য প্রার্থী জোগাড় করে দেব?'
 |
| অনিল বিশ্বাস (উপরে), পার্থ চ্যাটার্জি (নীচে) |
ক্ষমতায় টিকে থাকতে চলল গায়ের জোরে এলাকা দখল। খুন-জখম-বাড়ি ভাঙচুর-আগুন-বাড়িছাড়া, রাজনৈতিক হিংসা রোজকার ঘটনা হয়ে উঠল। ছোট আঙারিয়া, সুচপুর... গণহত্যা। যে কোনও ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই লক্ষ্য হলে মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ারের দাপট বাড়বেই।
রাজনৈতিক কর্মীদের আত্মরক্ষায় অস্ত্র ব্যবহার আর ক্ষমতার স্বার্থে দুষ্কৃতীদের মাসল পাওয়ার ব্যবহার--- দুয়ের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। দ্বিতীয় পথটাই নেওয়া হল। সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক হিংসা বরাবর বাংলার রাজনীতিতে ছিল, কিন্তু এবার দুষ্কৃতী নির্ভর হিংসার রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে গেল। শাসক-বিরোধী দুই শিবিরেই।
 |
| ৪ জানুয়ারি, ২০০১। ছোট আঙারিয়া হত্যাকাণ্ড। |
সাম্প্রতিক সময়ের বগটুই গণহত্যা রাজ্যের পরিস্থিতির নির্মম প্রতিফলন। বখরার দখল নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে জ্যান্ত পুড়িয়ে খুন। সুচপুর গণহত্যাও ছিল তেমনই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। যাঁরা খুন হয়েছিলেন তাঁরা সবাই তৃণমূল সমর্থক ছিলেন। খুনে সাজাপ্রাপ্তরা সবাই সিপিএমের লোক। তবু ওটাকে রাজনৈতিক গণহত্যা বলা উচিত হবে না। কোন জমিতে কে খেতমজুরি করবে তা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই ওই গণহত্যা। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ওই ঘটনার কাঁটাছেড়া করার দরকার ছিল। কারণ সেটা ছিল গ্রামীণ বাংলার অর্থনৈতিক সংকটের নির্মম প্রতিফলন। (চলবে)
 |
| ১৪ এপ্রিল, ২০২২। বগটুই গণহত্যা |