গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৪
বামফ্রন্ট সরকার আসার পর থেকে দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বদল হয়।
স্বাধীনতার আগে-পরে দেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তেমন মাথা তুলতে পারেনি। কিন্তু ইন্দিরা-জমানায় আর্থিক সংকট যত বেড়েছে ততই প্রাসঙ্গিক হতে শুরু করে আরএসএস ও তার রাজনৈতিক শাখা জনসংঘ। মহাত্মা গান্ধী খুনে অভিযুক্ত, 'রাজনৈতিক হিন্দুত্ব' ধারণার প্রথম তাত্বিক বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে প্রথম সরকারি স্বীকৃতি দেন নেহরু-কন্যাই।
![]() |
| ইন্দিরা আমলে প্রকাশিত ডাকটিকিটে সাভারকার |
জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়ায় আরএসএস, জনসংঘ। প্রথম বার ভারতীয় রাজনীতির মূল ধারায় যুক্ত হয়েই শিকড় অনেকটা ছড়িয়ে দিতে পারে সংঘ পরিবার।
![]() |
| নভেম্বর, ১৯৭৭। আরএসএস প্রধান বালাসাহেব দেওরসের সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণ। |
১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির জামা পরে কেন্দ্রের সরকারে যোগ দেয় জনসংঘ। মন্ত্রী হন জনসংঘের সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি, প্রাক্তন সভাপতি অটলবিহারী বাজপেয়ী।
![]() |
| মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চৌধরী চরণ সিং, অটলবিহারী বাজপেয়ী, জগজীবন রাম |
আবার সরকার পড়ে গেলে দ্বৈত সদস্যপদ বিতর্ককে কাজে লাগিয়ে জনতা পার্টি ছেড়ে তৈরি করে ভারতীয় জনতা পার্টি, আরএসএস-এর নতুন রাজনৈতিক শাখা বিজেপি। তার প্রথম সভাপতি হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার লিখছেন, 'জনসংঘের নেতারা গান্ধীবাদী জয়প্রকাশ নারায়ণকে কথা দিয়েছিলেন, জনতা পার্টিতে জায়গা পেলে তাঁরা আরএসএস ছাড়বেন। জয়প্রকাশ আমাকে বলেছিলেন, জনসংঘ তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল।'
![]() |
| জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে জ্যোতি বসু ও এম বাসবপুন্নাইয়া |
রাজীব গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে ভিপি সিংয়ের আন্দোলনেও অংশ নেয় বিজেপি। স্বাধীন ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় দ্রুততম উত্থান হয় সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি-র। লোকসভায় ২ থেকে বেড়া তাদের আসন সংখ্যা হয় ৮৯। সেখানেও সেই একই কৌশল।
![]() |
| অটলবিহারী বাজপেয়ী, এনটি রামা রাও, লালকৃষ্ণ আদবানি, ভিপি সিং, সুরজিৎ সিং বারনালা, রামবিলাস পাসোয়ান, জ্যোতি বসু, ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, রাজেশ্বর রাও |
১৯৮৯ সালে একদিকে বাম, অন্য দিকে বিজেপির সমর্থন নিয়ে সরকার গড়েন ভিপি। তাঁর জমানাতেই মণ্ডল কমিশন, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একাংশ উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কথা জোরাল করতে রথযাত্রায় বেরোলেন বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানী। তাঁর রথ আটকে দেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। তারপরই ভিপি সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় বিজেপি।
![]() |
| রাজীব গান্ধীর শেষকৃত্যে রাহুল-সোনিয়া-প্রিয়াঙ্কা |
১৯৯১ সালের ভোটে একার শক্তিতে সরকার গড়তে পারল না কংগ্রেস (ভোটপর্বের মাঝে রাজীব গান্ধী খুন হওয়ায় শেষ পর্বের ভোটে সহানুভূতির হাওয়া যায় কংগ্রেসের পক্ষে। নাহলে বিপর্যয়ের মুখে পড়ত কংগ্রেস)। প্রথম বার প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে এল বিজেপি।
![]() |
| এআইসিসি অধিবেশনে রাজীব গান্ধী, পিভি নরসীমা রাও, ইন্দিরা গান্ধী |
রাজনীতি থেকে অবসরে চলে যাওয়া পিভি নরসীমা রাও সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর টেনে দিলেন। তাঁর আমলেই ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ পরিকল্পনা করে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হল।
১৯৯৬। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে রাজি হল না সিপিএম। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই জেনেও সরকার গড়েন অটলবিহারী বাজপেয়ী। ১৩ দিনের সরকার যাওয়ার পরে দেবেগৌড়া ও গুজরালের নড়বড়ে জোট সরকার। তারপর?
১৯৯৮ সালে ভোটে জিতে ১৩ মাসের জোট সরকার গড়লেন বাজপেয়ী। ১৯৯৯ সালে ফের বাজপেয়ীর নেতৃত্বে জোট সরকার। এবার টিকল পুরো ৫ বছর।
১৯৭৫ সালের আগে দেশের রাজনীতিতে কার্যত অস্তিত্বহীন ছিল সংঘ পরিবারের রাজনীতি। দুই দশকের মধ্যেই তারা কেন্দ্রের ক্ষমতায়। ২০১৪ সালে প্রথমবার একাই ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে যায় বিজেপি। ২০১৯ সালে আবার। আরও বেশি শক্তি নিয়ে। দুবারই অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে জোট সরকারই হয়।
নব্বই দশকের শুরুতেই আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ পূর্ব ইউরোপের 'সমাজতান্ত্রিক' শিবিরের পতন আর নরসীমা রাও-মনমোহন সিং-এর হাত ধরে ভারতে বাজার অর্থনীতির সূচনা।
পুরো আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষিতটাই বদলে গেল। চারপাশের ঘটনাগুলো দেখার (NARRATIVE) ধরণটাই বদলে গেল। বদলটা হল অত্যন্ত দ্রুত।
এইসব বদলের কোনওটাই বামপন্থীদের হাত ধরে হয়নি। বরং বলা যায়, প্রচলিত বামপন্থী ধ্যানধারণার উল্টোই ছিল। এদেশের বামপন্থীদের প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দেয়, এইসব বদলের জন্য তাঁরা একদমই তৈরি ছিলেন না। এইসব মৌলিক বদলগুলোর সঙ্গে চিন্তাধারার বদল ঘটিয়ে নিজেদের সময়োপযোগী করা জরুরি ছিল। সে কাজ কতটা হয়েছে, আদৌ কিছু হয়েছে কি না, কাজটা করার চেষ্টা হয়েছে কি না-এসব বিবেচনায় না রাখলে রাজ্যে বামেরা কেন শূন্য হয়ে গেল, সে আলোচনা অর্থহীন হয়ে যাবে।
(চলবে)












.jpeg)