link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

'বাম'-শূন্য বাংলা? কিছু এলোমেলো ভাবনা / ৮

গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৮

আশির দশক থেকেই জাতীয় ক্ষেত্রে ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে পরিচয় সত্ত্বার রাজনীতি। তার ছাপ এরাজ্যেও পড়েছে। কিন্তু ক্রমাগত তাকে অস্বীকার করে গেছেন 'বাম' নেতারা। ভারতের বিশেষ প্রেক্ষাপটে জাতপাত, জনজাতির সমস্যাকে অস্বীকার করা মানে যে কোনও রাজনৈতিক শক্তির স্বখাত সলিলে তলিয়ে যাওয়া।
মতুয়াদের 'বড়মা'র সঙ্গে
মমতা ব্যানার্জি (উপরে) ও নরেন্দ্র মোদি (নীচে)

স্রেফ অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনের কথা বলে 'বাম' নেতারা অস্বীকার করলেও তা তো আর উবে যাচ্ছে না। বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে থেকেই দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গেও সমস্যাটা কতটা গভীর ও নির্ণায়ক। গোর্খা, রাজবংশী, কামতাপুরি, মতুয়া-সমাজের নানা অংশের পরিচিতি কেন্দ্রিক দাবি দাওয়া সামনে এলেও শ্রেণি লড়াইয়ের উদ্ভট ব্যাখ্যায় তাকে অগ্রাহ্য করেন সিপিএম নেতারা।

জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
৩৪ বছর রাজ্য শাসনের পরেও কেন সমাজ-রাজনীতি-প্রশাসন-অর্থনীতিতে কেন ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট অটুট? সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিশেষ অধিকার থাকলেও শিক্ষা, চাকরিতে এসসি-এসটিদের জন্য সংরক্ষণ তুলে দিতে হবে। এই দাবি কেন উঠবে না? তাতে তো লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বেশি। উপকৃত হচ্ছে এসসি-এসটিদের বিশেষ  সুবিধাপ্রাপ্ত একটা অংশ, কিন্তু বেশির ভাগের আত্মসম্মান বিপন্ন হচ্ছে। এই সহজ কথাটা 'বাম'-শিবির তো কখনও তুলল না। বিকল্প হিসেবে উঠতে পারত শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে আর্থিক ভিত্তিতে সংরক্ষণের কথা।
মুসলমানরা শুধুই ভোট ব্যাঙ্ক?
রাজ্যের মুসলমান সমাজের উন্নতির আসল চেহারাটা সাচার কমিটির রিপোর্টেই বোঝা গেছে। মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে ইতিবাচক বদলের কাজ কিছু হল? মুসলমানদের কি স্রেফ ভোটব্যাংক হিসেবেই দেখা হয়নি? ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে শিখ নিধন যজ্ঞের সময় সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ছিলেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও কার্যত ছিল না। জ্যোতি বসু বিজেপি-কে বলতেন 'অসভ্য-বর্বর'। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলতেন, 'মাথা গুঁড়িয়ে দেব।' এতো গুন্ডামির ভাষা। তাতে গুন্ডারাই খুশি হয়। খুশি হলও। সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপে রাজ্য থেকেই নির্বাসিত করতে হল তসলিমা নাসরিনকে। কে যে কার মাথা গুঁড়িয়ে দিল!
তসলিমা নাসরিন
৩৪ বছর রাজ্য শাসন করা বামফ্রন্টকেও তো বলতে হবে, তারা ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে কেন এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব এত দ্রুত ছড়াতে পারল? কেনই বা 'বাম' ভোট গিয়ে ভিড়ল 'রামে'? বামপন্থীদের কাছে সরকার চালানো তো অন্য পাঁচটা দলের মতো হওয়ার কথা ছিল না।  
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালি তো জাতিগতভাবেও কোণঠাসা হয়েছে। এর পিছনেও তো সুনির্দিষ্ট রাজনীতি আছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালিয়ানার কথাই তো উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই যুদ্ধে বাঙালির জয় হয়েছিল। মানভূমকে বিহারের অংশ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯১১ থেকেই। দেশভাগের পরে মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। কংগ্রেস বিরোধিতা করায় অতুল চন্দ্র ঘোষ কংগ্রেস ছেড়ে নতুন লোকসেবক সংঘ গড়েন। গড়ে ওঠে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন। 

মানভূম ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব
বিহার সরকার জোর করে বাঙালিদের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে মানভূমের ১৯টি থানা নিয়ে তৈরি হল পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা পুরুলিয়া। তবে জামশেদপুর ও সংলগ্ন বাঙালি প্রধান এলাকাগুলি বিহারেই রেখে দেওয়া হল। ১৯১১-৫৬, ভাষার জন্য এত দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই।
মানভূম ভাষা আন্দোলনের ঢেউ কলকাতায়

বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণ বিরোধী সভায় মেঘনাদ সাহা
তীব্র প্রতিরোধের সামনে বাংলা সরকার সেই প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করতে পারেনি। ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ মারা যান মেঘনাদ সাহা। কলকাতা উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ভাষা পুনর্গঠন কমিটির সম্পাদক মোহিত মিত্রকে প্রার্থী করার কথা ঘোষণা করেন বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু। বিধানচন্দ্র বললেন, 'কংগ্রেস প্রার্থী হেরে গেলে বুঝব বাঙালি বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণ চায় না। আমিও ওই ভাবনা থেকে সরে আসব।' মোহিত মিত্র জিতলেন। বিধান রায়ও অবস্থান থেকে সরে এলেন। বিহার-বাংলা সংযু্ক্তি হল না। সেটাই ছিল স্বাধীন ভারতে একমাত্র গণভোট।
বিধানচন্দ্র রায় ও জ্যোতি বসু
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগের আগে থেকেই ভাষাগত বহুত্বের পক্ষে থেকেছে। তারপর? ভাষা প্রশ্নে ‘আঞ্চলিকতা’র পক্ষে দাঁড়াতে আজকের বামেরা দ্বিধাগ্রস্ত। তাতে শ্রেণি সংগ্রামের নাকি বারোটা বাজবে! 'নবজাগরণ' গড়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক দাশগুপ্ত, তপন মিত্ররা একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজি লেখা আলকাতরা দিয়ে মোছাতেই আটকে যায়। তবে চেষ্টা হয়েছিল। সিপিআইএম নয়, সেটা ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত উদ্যোগ।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
নিজেদের পিঠ নিজেরা চাপড়ানোর চেয়ে আয়নায় মুখ দেখাটা আদর্শগত ভাবে সৎ মানুষের কাছে বেশি জরুরি।
দেশের রাজনীতিতে মৌলবাদ (সাম্প্রদায়িকতা), ফ্যাসীবাদের প্রবণতা বাড়ার অর্থ কেন্দ্রীকরণের প্রবণতাও বাড়া। এক সময় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে আন্দোলনই জাতীয় রাজনীতিতে নতুন বিন্যাসের জন্ম দিয়েছিল। আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে সেই শক্তিজোটই ফ্যাসীবাদকে টক্কর দেওয়ার শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। কিন্তু সে রাস্তায় আর এগোলই না 'বাম' দলগুলো। 
অশোক মিত্র বলেছিলেন, '১৯৯৩ সালে পার্টি থেকে যখন আমাকে রাজ্যসভায় যেতে আহ্বান জানানো হল, আমি খানিকটা উৎসাহের সঙ্গেই সম্মত হলাম, প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস বিষয়ে মন্ত্রিসভায় থাকাকালীন—জ্যোতিবাবুর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে—দেশে এক বিশেষ ধরনের আলোড়ন তুলতে অংশত সফল হয়েছিলাম, সংসদে গিয়ে ফের তা নিয়ে উত্তাল হব, কারণ ইতিমধ্যে বামফ্রন্ট সরকার এ বিষয়ে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বড় কারণ, দু’বছর আগে, তথাকথিত মুক্ত অর্থনীতি প্রবর্তনের পর দেশ জুড়ে আর্থিক সংকট যে ক্রমশ ঘনীভূত এবং এই পথে দেশের যে মুক্তি নেই, তা গোটা দেশের প্রতিনিধিদের সামনে উচ্চারণের সুযোগ পাব।' 
ব্রিগেডের জনসভায় চন্দ্রবাবু নাইডু, হরকিষেন সিং সুরজিৎ, দেবেগৌড়া,
ইন্দ্রকুমার গুজরাল, জ্যোতি বসু ও রামবিলাস পাসোয়ান
জাতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ হতে শুরু করল। কিন্তু ওই সব দলগুলোর চরিত্র ঠিক করতে করতেই সময় চলে গেল 'বাম' নেতাদের (এখনও পেরেছেন বলে মনে হয় না)। জায়গা তো ফাঁকা থাকে না। কৌশলে তাকে কাজে লাগাল বিজেপি (যেমন এ রাজ্যে পা রাখতে মমতা ব্যানার্জির হাত ধরেছিল। সেই উদাহরণ দেখিয়ে আজকের সিপিএম মমতাকে আক্রমণের মূল লক্ষ্য করে।) আর জাতীয় রাজনীতিতে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হতে শুরু করল সিপিএম-সহ বামেরা। অনিবার্য ভাবে সেই ধাক্কা লাগল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও। 
মমতা ব্যানার্জি ও নরেন্দ্র মোদি 
তাত্‍ক্ষনিক ভাবে ভোটের ফলে এই ক্ষয় ধরা না পড়লেও এত দ্রুত সংসদীয় রাজনীতির পরিসর থেকে স্রেফ উবে যাওয়া (লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে শূন্য আসন পাওয়া) তার প্রমাণ (চলবে) 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad