গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৭
 |
| জ্যোতি বসু ও অটলবিহারী বাজপেয়ী |
দেশের রাজনীতিতে বিজেপির দ্রুত উত্থানকে গুরুত্বই দেয়নি সিপিএম। হিসেবে চোখ রাখলে দেখা যাবে, কংগ্রেসের শক্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েছে ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর আমলে। ঠিক সে সময়ই শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়কে অগ্রাহ্য করে মুসলিম মৌলবাদীদের স্বার্থে মুসলিম মহিলা আইন চালু হল। অথচ ওই সূত্র ধরে তিন তালাক বাতিল, পরবর্তীতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকেও যাওয়া যেত।
 |
| ইন্দিরা গান্ধীর মরদেহের সামনে রাজীব গান্ধী। পাশে অমিতাভ বচ্চন |
অযোধ্যায় বিতর্কিত জমিতে তালা দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। হিন্দু মৌলবাদীদের খুশি করতে সেই তালা খুলে দেন তাঁর নাতি। বোতল থেকে বেরিয়ে পড়ে দৈত্য।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে শিখ নিধন যজ্ঞ কংগ্রেসের চেহারাটা প্রকাশ করে দিয়েছিল।
 |
| ইন্দিরার মৃত্যুর পর দিল্লিতে শিখ নিধন যজ্ঞ। ১৯৮৪ |
খেয়াল করলে দেখা যাবে, সে সময় শাহবানু মামলার রায়ের পক্ষে সংসদে যাঁরা সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সিপিএম সাংসদ সৈফুদ্দিন চৌধুরী। রাজীব গান্ধী তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু নীতিগত ক্ষেত্রে কড়া বিরোধিতা করেছিলেন সৈফুদ্দিন।
দেখা যাবে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সংস্কারের কাজ না করে মৌলবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে কংগ্রেস এবং তারপর থেকে ক্রমশ ক্ষয়ে গিয়েছে। ১৯৮৪ সালের পর কখনও একার শক্তিতে সরকার গড়তে পারেনি তারা। সেই ক্ষয় এখনও চলছে।
 |
| প্রিয়াঙ্কা, রাহুল, সোনিয়া |
অন্য দিকে ক্রমশ শক্তি বাড়ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির। কংগ্রেসের প্রতিস্পর্ধী দৃষ্টিভঙ্গী (alternative narraitve) ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, উন্নয়নের নতুন ভাষ্য (narrative)। ঐতিহাসিক ভাবে সেই কাজটা বামপন্থীরাই করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে কী হল? সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রধান বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করায় সৈফুদ্দিন চৌধুরীকে দলের মধ্যে কোনঠাসা করে দেওয়া হল। কংগ্রেস ও বিজেপি থেকে সমদূরত্বের নীতি থেকে সরে আসার কথা বলায় কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বিতাড়িত সৈফুদ্দিন থাকলেন স্রেফ দলের একজন সাধারণ সদস্য হয়ে।
 |
| সৈফুদ্দিন চৌধুরী |
দেখা যাচ্ছে, আদর্শগত ক্ষেত্রে সর্বহারার একনায়কত্ব, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তোলা সৈফুদ্দিন চৌধুরীই আবার দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকই প্রধান বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তিনিই আবার ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে সরব। আপাত ভাবে বিচ্ছিন্ন বিষয় মনে হলেও বাস্তবে এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
.jpeg) |
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উত্তম কুমার, সত্যজিৎ রায় ও জ্যোতি বসু |
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও প্রকাশ্যে দলের মতের বিরোধিতা না করা জ্যোতি বসু ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'ঐতিহাসিক ভুল'।
 |
| জ্যোতি বসু |
অনেকের মনে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী না হতে পেরেই ক্ষুব্ধ জ্যোতিবাবু ওই কথা বলে ছিলেন। তাঁদের বোধগম্য হয় না, ওই সিদ্ধান্তের অভিঘাতের মাত্রা বোঝাতেই কথাটা প্রকাশ্যে বলেছিলেন প্রবীণ নেতা। ওই ইস্যুকে 'ক্লোজড চাপ্টার' করে দিয়েছিল সিপিএম। দলের শাখা থেকে রাজ্য স্তরের সম্মেলনগুলোয় ওই ইস্যুতে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে ওই বিষয়ে বিতর্ক হল। ভোটাভুটিও হল।
১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া এবং ২০০৮ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়া একই মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ফসল।
 |
| জ্যোতি বসু ও প্রণব মুখার্জি |
ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ছাড়া ভারতের অস্তিত্ব থাকবে না। কংগ্রেস ভোটের রাজনীতির স্বার্থে তাকে ধর্ষণ করেছে। সেই রাস্তায় হেঁটেছে আরও অনেক দল। ('সেকুলারিজম' শব্দটার যথার্থ প্রতিশব্দ ধর্মনিরপেক্ষতা হয় না। তাতে গোলমাল বাড়ে। কেন সংবিধানের প্রবক্তারা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা গ্রহণ করেননি সেটাও বিবেচনায় রাখা দরকার।) লালুপ্রসাদ, মুলায়ম যাদবদের মতো আঞ্চলিক দলের নেতারা দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে থাকতে পারেন, কিন্তু নেতৃত্ব দিতে পারেন না। পারতেন বামেরা। কিন্তু তাদের অবস্থানের কথা তো আগেই বললাম।
.jpeg) |
| নরেন্দ্র মোদী |
যা হওয়ার তা-ই হল। সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সারা দেশে বিরাট চেহারায় আত্মপ্রকাশ করল বিজেপি। |
| বিধানসভা ভোটের আগে ব্রিগেড সমাবেশে অধীর চৌধুরী, আব্বাস সিদ্দিকি, মহম্মদ সেলিম |
(গত বিধানসভা ভোটে বিপর্যস্ত হওয়ার পরেও সিপিএম নেতা-কর্মীদের 'বিজেমূল' তত্বে অটুট আস্থা দেখে মনে হয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদ এখনও তাঁদের অনুভবে আসেনি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মূল্যায়নকে ফুঃ মেরে উড়িয়ে দিতেও আটকায় না।)