গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ৬
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে 'সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা'র পতনের পরে আদর্শগত ক্ষেত্রেও নতুন পরিস্থিতির মুখে পড়ল সিপিএম। প্রশ্নের মুখে পড়ল মৌলিক বলে পরিচিত অনেক ধারণাই (যেমন, আজকের সময়ে কোন রাস্তায় সমাজবদল, শ্রেণির ধারণা, সর্বহারার একনায়কত্বের ধারণা, পার্টি সংগঠনে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ধারণা ইত্যাদি ইত্যাদি।) কিন্তু গভীর আত্মানুসন্ধানের বদলে 'মতাদর্শগত দলিল তৈরি করেছি', 'বিশেষ প্লেনাম করছি', এরকম নানা কথার আড়ালে জোড়াতালি মেরে চলার চেষ্টা শুরু হল। পার্টির ভিতরে কেউ প্রশ্নগুলো তুললে তাঁদের কোনঠাসা করে দেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ রাজনীতিতে, বিশেষত বাম রাজনীতিতে আদর্শগত অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
![]() |
| লেনিন, ১৯১৭ |
ডঃ অশোক মিত্রর কথায়, 'লেনিন যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটা করেছিলেন একটি বিশেষ অবস্থায়। পার্টি গোপন ছিল, পার্টির একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিপ্লব সাধন। একটা গোপন দলকে বিপ্লব সফল করতে হলে অটুট শৃঙ্খলা দরকার এবং সেই কারণেই গোপনীয়তার একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এখন...আপনারা এই গণতান্ত্রিক বহুদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে নির্বাচনে লড়ে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতায় পৌঁছতে চান। তা হলে দুটো জিনিস করতে হবে। এক, বাইরের পৃথিবীতে কী হচ্ছে সেটা আপনাদের জানা দরকার। দেশের লোকেরা কী বলছে, কী চাইছে এবং আপনাদের সম্বন্ধে কী ভাবছে, এগুলো আপনাদের জানতে হবে এবং জানতে হলে আপনাদের খোলাখুলি সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আপনারা কী ভাবছেন, কী করতে চাইছেন সেটা বাইরের লোককে জানানো দরকার। আপনারা হয়তো বলবেন, 'আমরা সজাগ আছি, পার্টির ভিতরে সব কিছু আলোচনা করে নিচ্ছি।'...বাইরের মানুষ দেখছেন আপনারা অনেক নীতি-নিয়ম মানছেন না, তাই আপনারা পার্টির ভিতরে কী আলোচনা করছেন সে কথা তাঁরা জানতে চান এবং সেটা যতক্ষণ আপনারা তাঁদের জানতে না দেবেন, আপনাদের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস কমবে না।'
![]() |
| অধ্যাপক অমর্ত্য সেন |
নিজেকে বরাবর বামপন্থী বলে দাবি করা অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের কথায়, 'এটা প্রায়শ স্বীকার করা হয় না যে রাজনৈতিক সংগঠনের বিষয়ে কার্ল মার্ক্সের আগ্রহ ছিল খুবই সামান্য। সর্বহারার একনায়কত্বের ভাবনাটির আসলে কোনও অর্থ হয় না। আর জন কেনেথ গ্যালব্রেইথ যেমন বলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রয়োজন, যেটাকে তিনি বলেছিলেন, 'কাউন্টারভেইলিং পাওয়ার' বা ক্ষমতার ভারসাম্য। কমিউনিস্টদের ভাবনায় ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি নেই।'
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা প্রসঙ্গেই সিপিএমের দ্বিচারিতার উদাহরণ টেনেছেন ডঃ অশোক মিত্র, 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কথা বলা হয় এবং এখনও পর্যন্ত নিয়ম হল, কেন্দ্রই শেষ কথা বলবে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তা-ই হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রের পার্টির মধ্যে যে সম্পর্ক, তা একটু অন্য রকম। কেন্দ্রে যাঁরা হাল ধরে আছেন, তাঁদের নিজেদের অঞ্চলে প্রভাব অত্যন্ত সীমিত। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে, তাঁদের পেছনে এত জমাট একটা আন্দোলন, এত সম্ভ্রান্ত একটি প্রশাসন। তাই অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পছন্দ হোক বা না হোক, এ রাজ্যের নেতৃত্বের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর পার্টির সিদ্ধান্ত অনেকটাই নির্ভর করত। যদিও কোনও কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানতেন, পশ্চিমবঙ্গে এখানে ওখানে অনেক গলদ ঢুকছে, তাঁদের কিছু করার ছিল না। তাঁরা অসহায় বোধ করতেন।'
অনেকের মনে থাকতে পারে সিপিএমের ভিতরে সর্বহারার একনায়কত্ব, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগত বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে সৈফুদ্দিন চৌধুরীকে শেষ পর্যন্ত 'সম্মানজনক বিচ্ছেদ নিতে হয়েছিল।
ডঃ অশোক মিত্র বলেছিলেন, 'একটা কমিউনিস্ট পার্টির তো কেবল ভোটের হিসেব কষার কথা নয়। তার আদর্শ সে কতটা অনুসরণ করতে পারছে, বাস্তব অনুযায়ী সেই আদর্শের পরিমার্জন দরকার কি না, এগুলোও ভাবার কথা। তেমন চিন্তার লক্ষণ তো দেখা গেল না!' (চলবে)




.jpeg)
