link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

‘ঈশ্বর’, ‘দেবদূত’ ও রবীন্দ্রনাথের মানুষ #Justice-Abhijit-Ganguly-ray-of-Hope

অভিজিৎ গাঙ্গুলির মতো অন্য কোনও বিচারপতি সাধারণ মানুষের মধ্যে এত জনপ্রিয় হয়েছেন কিনা জানা নেই। বহু বিচারপতি অসংখ্য সাহসী রায় দিয়েছেন, কিন্তু তাঁরাও বাহবা পেয়েছেন শুধুমাত্র আলোকিত অংশের। সাধারণ মানুষ তাঁদের ‘ঈশ্বর’ বা ‘দেবদূত’ ভেবেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে মানুষ তাই ভাবছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে একজন বিচারপতির বেনজির জনপ্রিয়তা। 
এজলাসে বিচারপতি গাঙ্গুলির একটি মন্তব্য মনে করিয়ে দিচ্ছি: ‘মাথায় বন্দুক ধরে মারতেও পারেন। মরতে রাজি। কিন্তু দুর্নীতি দেখলে চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবই। আবার বলছি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছি, করব। যথেষ্ট হয়েছে।’ 
বিচারপতি গাঙ্গুলি একা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেপরোয়া লড়াই করছেন, মানুষের মধ্যে এরকম একটা মনোভাব তৈরি হয়েছে। সরকারি অনুদানপুষ্ট পুজো কমিটিগুলো মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলকে তুষ্ট করতেই ব্যস্ত। তারমধ্যেও দমদম ক্যানটনমেন্টের একটি ক্লাব তাঁদের পুজোর মঞ্চের নামকরণ করেছে বিচারপতি গাঙ্গুলির নামে। ক্লাবের উদ্যোক্তাদের একজন বললেন, বিচারপতির নামে মঞ্চ করার চাপটা বেশি দিয়েছেন পাড়ার মহিলারা। 
বিচারপতি গাঙ্গুলির এই জনপ্রিয়তার একটা কারণ, অসহায় মানুষেরা তাঁকে একজন মসিহা ভাবছেন। হাইকোর্টের আরেক বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু এজলাসেই বলেন, ‘বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই করছেন তাতে আমিও এবার সামিল হচ্ছি।’
এখানেই একটা প্রশ্ন। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই তো আদালতের কাজ। দুর্নীতি একটি অন্যায়। তার বিরুদ্ধে লড়াই তো গোটা বিচারব্যবস্থারই কাজ। তাহলে দুই বিচারককে কেন আলাদা ভাবে কেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলতে হচ্ছে? গোটা বিচারব্যবস্থার কাছ থেকে বারবার ন্যায়বিচার পেতে থাকলে এক বিচারপতিকে কি ব্যতিক্রমী মনে হত? 
দেখা যাবে, এখন রাজনীতির লোকেরা কিছু হলেই কোর্টে ছুটছেন। কোর্টের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। কেন? 

বিচারপতি গাঙ্গুলির রায়ে চাকরি পেয়েছেন প্রিয়াঙ্কা সাউ। তিনি বললেন, ‘আমি আন্দোলনে ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম তাতে প্রশাসনের হুঁশ ফেরানো যাবে না। বুঝতে পেরেছিলাম, আদালতে না গেলে হবে না।’ 
এটাই সংকটের ন্যাংটো ছবি। প্রশাসনের উপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না। প্রশাসন তো চালান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সদস্যরা। তাঁদের উপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না। কেন যাবে? ধরুন, বিচারপতি গাঙ্গুলি রায় দেওয়ার পর বিরোধীরা খুব হইচই শুরু করেছে। ‘চোর ধরো জেল ভরো’। পুরো প্রক্রিয়ায় তাঁদের ভূমিকা কী? নিয়োগে দুর্নীতির কথা তো নেতারা জানতেন। কোনও আন্দোলন ছিল না কেন? গতবার পুজোর সময়ও ধর্না ছিল। কেউ জানতাম সে কথা? 
চাকরিপ্রার্থীদের টানা ধরনার পাশে তো কোনও রাজনৈতিক দলকে দেখা যায়নি। তাঁদের মামলার জেরে এখন পর্দাফাঁস হতেই ‘চোর ধরো জেল ভরো’ বলে চিৎকার শুরু করেছে বিরোধীরা। টার্গেট গদি। গদি পেলে তাঁরা এই দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না, সেটা নিশ্চিত? বাস্তব অভিজ্ঞতা মাথায় রাখলে তো ভরসা রাখা যায় না। রাজনীতির লোকেরাও সেটা জানেন। তাই কোর্টকে আঁকড়েই তাঁরা বাঁচতে চান।
এটা গণতান্ত্রিক কাঠামোর বড় বিপদের দিক। 
আইনসভা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা-এই তিন স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তারা একে অন্যের পরিপূরক। কোনও একটা পায়া নড়বড়ে হয়ে গেলে কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। শুধু কোনও একটা স্তম্ভের উপরই মানুষের ভরসা রাখতে শুরু করা মানে বাকিগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। তৃতীয় পায়াটাও বেশি দিন টিকবে না।
বিচারপতি গাঙ্গুলি অঙ্কিতা অধিকারীর বদলে ববিতা সরকারকে চাকরি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশ কার্যকরও হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন যদি সে নির্দেশ পালন না করত? ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, আদালতের জাস্ট কিস্যু করার নেই। একটা উদাহরণ দিই। পরিবেশ আদালত ভিআইপি রোডের পাশে বন্ধ করে দেওয়া নয়ানজুলি ফিরিয়ে দেওয়ার রায় দিয়েছে ২০১৫ সালে। প্রশাসন কিস্যু করেনি। কী করতে পেরেছে আদালত? তার মানে আদালতের গুরুত্ব থাকবে কিনা সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রশাসন পরিচালনায় থাকা রাজনীতির লোকেদের মনোভাবের উপর।
দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে এক সভায় প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের সামনে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এনভি রমানা বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার, সংসদ এবং বিচার ব্যবস্থার ক্ষমতা আলাদা করে দিয়েছে সংবিধান। কর্তব্যপালনে সেই লক্ষ্মণরেখা সম্পর্কে সকলের সতর্ক থাকা উচিত। তাতে গণতন্ত্রই শক্তিশালী হবে।’ তাঁর অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই আদালত রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ভাবে সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। 
অর্থাৎ শুধু রাজ্যের নয়, সমস্যাটা সারা দেশের।
বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কথা বলার আগে অন্যান্য স্তম্ভ ও সংস্থাগুলো সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে চাইছি। আইনসভা-প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা ছাড়াও সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন, রিজার্ভ ব্যাংক, মিডিয়া, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা ও এজেন্সির স্বাধীন ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। 
নির্বাচন কমিশন
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হন এক সময় রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভৈরোঁ সিং শেখাওয়াতের সচিব এবং বসুন্ধরা রাজের প্রধান সচিব হিসেবে কাজ করা সুনীল অরোরা। তার ৪ মাস পরেই ছিল লোকসভা ভোট। সেবার ২ মাসের ভোটপর্বে অন্তত ৬ বার নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকার ব্যাপারে সতর্ক করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এমনকী মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছিল। 
লোকসভা ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার কোনও অভিযোগই মানেনি কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্রের সঙ্গে একমত হননি আরেক নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা। পরে তিনি বলেছিলেন, ‘নরেন্দ্র মোদীর চারটি এবং অমিত শাহের দুটি বক্তৃতায় এমন কিছু কথা ছিল, যা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে কমিশন ক্লিনচিট দিয়েছে। সংখ্যালঘু মত হিসেবে আমার বক্তব্য রেকর্ডও করা হয়নি।’ 
ভোটের পরেই লাভাসার স্ত্রী, ছেলে ও বোনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে আয়কর দফতর। তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে ইডি। পরবর্তী মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার কথা ছিল লাভাসারই। কিন্তু ২০২০-র অগাস্টে তিনি ইস্তফা দেন। পরে দেখা যায়, ভিন্ন মতপ্রকাশের পর থেকেই পেগাসাস স্পাইওয়ারের সম্ভাব্য টার্গেটের তালিকায় ছিল লাভাসার মোবাইল।
কথায় বলে, হাঁড়ির একটি চাল টিপলেই বোঝা যায়। তাই উদাহরণ বাড়াতে চাইছি না।
পরিসংখ্যান কমিশন
ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদী বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থানের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সরকারে আসার পর মোদী সরকার কর্মসংস্থানের রিপোর্ট প্রকাশই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সরকারে আসার পর মোদী সরকার কর্মসংস্থানের রিপোর্ট প্রকাশই বন্ধ করে দেয়। তারপরই ইস্তফা দেন দেশের পরিসংখ্যান কমিশনার পিসি মোহনন ও কমিশনের আরও এক সদস্য। মোহনন জানান, মোদী জমানায় কেন্দ্রীয় সরকার কত কর্মসংস্থান করতে পারল, তার পূর্ণাঙ্গ হিসেব প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় ইস্তফা। তাঁর কাজে কেন্দ্রীয় সরকার যে হস্তক্ষেপ করেছে, স্পষ্টই সেই অভিযোগ তোলেন তিনি।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক
নোটবন্দির বিরোধিতা করা রঘুরাম রাজন দ্বিতীয় বার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হতে রাজি হননি। তাঁর সঙ্গে মোদী সরকারের মতবিরোধ ওপেন সিক্রেট। কিন্তু পরের গভর্নর উর্জিত প্যাটেলও মেয়াদ শেষের আগেই পদত্যাগ করেন। সরে যান তাঁর ডেপুটি বিরল আচার্যও। তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে উদ্বৃত্ত তহবিলের এক-তৃতীয়াংশের ভাগ লভ্যাংশ হিসাবে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, যাতে অনাদায়ী ঋণের ধাক্কায় ধুঁকতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলিকে নতুন মূলধন দেওয়া যায়। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রাজি হয়নি। সেই বিরোধের জেরেই পরপর সরে যান উর্জিত ও বিরল। তাতে সরকার এতটাই চাপে পড়ে যে উর্জিতের পদত্যাগের পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়, ‘উনি নিজেই ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। আমি এই প্রথম এ কথা প্রকাশ করছি। ছ’সাত মাস আগে থেকেই আমাকে বলছিলেন। উনি আমাকে চিঠিও লিখেছিলেন।’ তারপরই মোদীর বিখ্যাত মন্তব্য, ‘হার্ভার্ডের চেয়ে অনেক ভাল হার্ড ওয়ার্ক।’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে বসানো হল ইতিহাসের শিক্ষক শক্তিকান্ত দাসকে। 
কেন অনাদায়ী ঋণের ধাক্কার মুখে পড়তে হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে? 
নীরব মোদী-মেহুল চোক্সী পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের প্রায় ১৩,০০০ কোটি টাকা প্রতারণা করেন। তার আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের প্রায় ৯,০০০ কোটি টাকা পাওনা বাকি রেখে পালান বিজয় মালিয়া। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যই বলছে, মালিয়া-নীরব মোদী-চোক্সীদের কাণ্ডের পরও জালিয়াতি ঠেকাতে সতর্ক হয়নি কেন্দ্র। এখন প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকা জালিয়াতির শিকার হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলি। গত ৯ বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া শিল্পপতিদের প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছে এসবিআই। কিন্তু ওই শিল্পপতিদের নাম প্রকাশ্যে আনতে নারাজ দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক। অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে, ১৩ বছরে ১৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকার কার্যকরী মুনাফা করেছিল ব্যাঙ্কগুলি। কিন্তু টাকা ধার দিলে তা আর শোধ করবে না ঋণগ্রহীতারা, এটা ধরে নিয়ে ব্যাঙ্কের লভ্যাংশ থেকে মোট ১৪ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে রাখতে হয়েছে। অর্থাৎ মুনাফার প্রায় পুরোটাই খেয়ে নিয়েছে অসৎ ঋণ খেলাপিরা। এই টাকা কাদের? বেশির ভাগটাই আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জমানো টাকা। 

দেশের অগ্রগতির নানা বিজ্ঞাপন করা হয়। কিন্তু লোকসভায় কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, মনমোহন সিংয়ের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শেষ দিকে, ২০১৪-১৫ সালে দেশের মোট ঋণ ছিল ৫৮ লক্ষ ৬৭ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালের মার্চে সেই ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৯৭ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। মানে ৬৮ বছরে যা ঋণ হয়েছে তার প্রায় তিন গুণ ঋণ নিয়েছে ৭ বছরের মোদী সরকার। কীভাবে বিপুল ঋণ মেটাবে সরকার? কেন্দ্রের তরফে সরকারি জবাব, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা ও সরকারি জমি বিক্রি করে ঋণ মেটানো হবে।
ঋণ মেটাতে গেরস্থ ঘটিবাটি বিক্রি করলে তাকে তো দেউলিয়াই বলে। অথচ সেই ‘গেরস্থ’ই এই রাজ্য-সেই রাজ্যকে ঋণ নিয়ে ধমকে বেড়াচ্ছে। 

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কথা বলতে গিয়ে অন্য কিছু প্রসঙ্গ টানলাম যাতে কেন্দ্রের উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট করা যায়।
পরিকল্পনা কমিশন
স্বাধীনতার আগে সুভাষ বসু, জওহরলাল নেহরু, মেঘনাদ সাহারা ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষে। স্বাধীনতার পর সেই কমিশন দেশের মানুষের প্রয়োজন হিসেব করে পরিকল্পনা করত ও স্বাধীন ভাবে তা রূপায়ন করত। তা তুলে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী তৈরি করলেন নীতি আয়োগ, যার কাজ সরকারকে সুপারিশ করা। সুপারিশ মানবে কিনা, সেটা সম্পূর্ণ সরকারের সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ ক্ষমতা সরকার কুক্ষিগত করল।  
সিবিআই ও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি
সিবিআই-ইডি-আয়কর দফতরকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে বারবার।
গত ১৮ বছরে দুশোর বেশি রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফাতারি, তাঁদের বাড়িতে হানা, জেরা ইত্যাদি করেছে সিবিআই। তার মধ্যে ৮০ শতাংশই বিরোধী দলের। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ আমলে ১০ বছরে (২০০৪-২০১৪) অন্তত ৭২ জন নেতা ছিলেন সিবিআইয়ের নজরে। তার মধ্যে ৪৩ জন (৬০%) বিরোধী পক্ষের। নরেন্দ্র মোদি জমানার ৮ আট বছরে অন্তত ১২৪ জন নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে সিবিআই। যার মধ্যে ১১৮ জনই বিরোধী পক্ষের (প্রায় ৯৫%)। বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টার্গেট তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা। রাজ্যের শাসকদলের ৩০ জন নেতা এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার র‍্যাডারে। কংগ্রেসের ২৬ নেতা। উল্টো দিকে, বিজেপির মাত্র ৬ জন। বিরোধী দলের কোনও নেতা বিজেপিতে যোগ দিলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ধাপাচাপা পড়ে যাচ্ছে।
মনে আছে নিশ্চয়ই ২৩ অক্টোবর, ২০১৮ মধ্যরাতে সিবিআই-এর দখলদারি নিয়ে সেই অলোক ভার্মা আর রাকেশ আস্থানার থ্রিলার। রাজনৈতিক কারণে নেতাদের টার্গেট করতে রাজি ছিলেন না সিবিআই প্রধান ভার্মা। রাফাল-তদন্ত করবেন না, সে আশ্বাসও দেননি। উল্টে ৪ অক্টোবর নিজের অফিসে বসেই প্রশান্ত ভূষণ ও অরুণ শৌরির কাছ থেকে রাফাল চুক্তিসংক্রান্ত বেশ কিছু নথি নেন। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের সিবিআই অফিসার রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তের নির্দেশও দিয়েছিলেন ভার্মা। পরবর্তীতে ফাঁস হওয়া পেগাসাস স্পাইওয়ারের ডেটাবেসে দেখা যায়, সেই সময় থেকেই অলোক বর্মা ও তাঁর পরিবারের ৭ সদস্যের ব্যক্তিগত মোবাইলে সম্ভবত পেগাসাস সক্রিয় ছিল। মধ্যরাতের সেই থ্রিলারের সময় পেগাসাস ডেটাবেসে যুক্ত হয় রাকেশ আস্থানা, এ কে শর্মার নামও। তাঁদের সবাইকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। সরানো হয় সিবিআই-এর ডিআইজি মণীশ সিনহাকেও। সে সময় নীরব মোদী-মেহুল চোকসির ব্যাঙ্ক জালিয়াতির তদন্ত করছিলেন তিনি। আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্তের ভারও ছিল তাঁর হাতেই। সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করে মণীশ দাবি করেন, আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্তে পাওয়া বেশ কিছু নথিতে স্পষ্ট এক ব্যবসায়ীকে সিবিআই-এর হাত থেকে রেহাই দিতে বহু কোটি টাকা ঘুষ নেন কেন্দ্রীয় কয়লা ও খনি প্রতিমন্ত্রী, গুজরাতের বনসকাঁঠার সাংসদ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের স্নেহভাজন হরিভাই পার্থিভাই চৌধুরি। মনীশ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের নামও জড়িয়েছিলেন। 
পরবর্তীতে রাকেশ আস্থানাকে সিবিআই প্রধান করতে চেয়েছিলেন মোদী। কিন্তু বিরোধী দলনেতা ও প্রধান বিচারপতির আপত্তিতে ইচ্ছেপূরণ হয়নি। সেই অধ্যায় হাট করে দিয়েছিল সিবিআই-কে কুক্ষিগত করতে কীভাবে সক্রিয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর। আর এখন সিবিআই-এর মতো ইডি-আয়কর দফতরকেও যে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, নানা ঘটনায় তা স্পষ্ট। 

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রমানা সিবিআই-এর মঞ্চে দাঁড়িয়েই বলেন, ‘আগে নিরপেক্ষতার জন্য সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার দেওয়ার আর্জির পাহাড় জমত আদালতে। এখন সিবিআই তার সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তার ফলে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নিজেই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক সরকার সময়ের সঙ্গে বদলে যাবে। আপনাদের প্রতিষ্ঠান পাকাপাকি থাকবে। আপস করবেন না, স্বাধীন হোন। নিয়মের বই মেনে চলুন।’ 
বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি নিশ্চয়ই জানেন, দুর্নীতির গোড়া কোথায়? তিনি নিশ্চয়ই জানেন, কেন দুর্নীতি আমাদের দেশে শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে দিতে পারছে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে তাঁর অস্ত্র সিবিআই। তাঁর কথায়, ‘পুলিশের উপর বিশ্বাস থাকলেও নিয়ন্ত্রণ তো হয়ই, তাই সিবিআইকে তদন্তের ভার দিয়েছি।’ আগে উল্লেখকরা তথ্যেই নিশ্চয়ই স্পষ্ট, কতটা স্বাধীন সিবিআই! হয়তো তাই বিচারপতি গাঙ্গুলিকেই বলতে হচ্ছে, ‘সিবিআই-এর কাজে হতাশ। অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলো দেখতে পাচ্ছি না।’ তিনি বলছেন, সিবিআই-এর উপর চাপ বাড়াতেই এটা তাঁর কৌশল। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই জানেন, সারদা-সহ চিটফান্ডগুলোর কেলেংকারির তদন্তভার সিবিআই-কে দিয়েছিল কোর্টই। তার হাল কি? নারদ-তদন্তের হালই বা কি? বিচারপতি গাঙ্গুলি নিশ্চয়ই জানেন, সিবিআই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট মনমোহন সিং বা নরেন্দ্র মোদী জমানায় সুপ্রিম কোর্টে কী বলেছে। আগেই বলেছি, কোর্ট নির্দেশ দিতেই পারে। তা কাজে লাগানো হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে থাকা প্রশাসনের উপর। 
লোকসভা-রাজ্যসভা-বিধানসভা
কৃষক আন্দোলনের চাপে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র। আইন হওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি তা প্রত্যাহারের নজির নেই। সাধারণত কোনও বিল সংসদে পেশের পর তা নিয়ে বিস্তারিত চর্চার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোটাই রীতি। কৃষি বিলগুলিকেও সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে বলেছিল বিরোধীরা। রাজি হয়নি সরকার পক্ষ। পরিণতি দেখাই যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মনমোহন সিং-এর দু’দফায় ৬০% এবং ৭১% বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হত। মোদীর প্রথম দফায় সেই হার ছিল ২৫%। দ্বিতীয় দফায় ১২%। সরকারের মনোভাব হল, সংসদে আমার সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তার জোরেই যে কোনও বিল পাশ করে নেব। কিন্তু সেটাই তো শুধু সংসদীয় গণতন্ত্রের পদ্ধতি নয়। বিল নিয়ে সিলেক্ট কমিটি বিস্তারিত খোঁজখবর করবে, সংসদে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা হবে, সে ভাবেই কাজ চলার কথা।
কোনও আলোচনা ছাড়াই বা সামান্য আলোচনার মাধ্যমেই বিল পাশের অভ্যাস মনমোহন সিং জমানাতেই শুরু হয়েছে। এবং মোদী জমানাতেও তা চলছে।
তাতে কী সমস্যা তৈরি হচ্ছে? 
সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এনভি রমানা স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে সংসদ বা রাজ্য বিধানসভাগুলোয় কী হয় তা সকলের জানা। আগে যে কোনও বিল পাসের আগে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা, বিতর্ক হত। ফলে আইন নিয়ে বিভ্রান্তি থাকত না। তাতে আইন তৈরি হওয়ার নেপথ্যে আইনসভার ভূমিকাটি স্পষ্ট হয়ে উঠত। এখন আইনসভার কাজে অনেক ফাঁক ধরা পড়ছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সংসদীয় কাজকর্মের মান খারাপ হচ্ছে। ফলে আইনে সামঞ্জস্যের অভাব থাকছে। কোন আইন কেন তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে অস্বচ্ছতা থাকছে। মুশকিলে পড়তে হচ্ছে আদালতকে। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে মানুষকে।’
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই একমাত্র বিষয় নয়। বিরোধী মতকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্কও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বলছেন প্রধানমন্ত্রীর কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর কথা, প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে চটুল স্বরে বলছেন ‘দিদি...ও দিদি...।’ উদাহরণ বাড়িয়ে কাজ নেই। নেতাদের ভাষার বাহাদুরি আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতায় আছে। সেসব শুনলেই বোঝা যায় সরকার ও বিরোধীদের পারস্পরিক সম্পর্ক কতটা শ্রদ্ধার, কতটা সম্মানের।
কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে বিধায়ক কিনে রাজ্যে রাজ্যে সরকার দখলের নয়া নজির তৈরি করছে কেন্দ্রের শাসক দল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দেওয়া হিসেবে, ২৭৭ বিধায়ক কিনতে খরচ হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
সংসদ বা বিধানসভা স্রেফ রাবার স্ট্যাম্প হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ি আমাদের মতো সাধারণ মানুষই। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের একমাত্র এই স্তম্ভই মানুষের ভোটে নির্বাচিত। প্রশাসন চালানো আইএএস-আইপিএস বা কোর্টের বিচারপতি, কোনওটাই আমাদের ভোটে নির্বাচিত নয়।
আদালত
নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানার শুরুর দিকে বারবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে সরকার। চার বিচারপতি প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে অনিয়মের কথা বলছেন, সেই ঘটনাও ঘটেছে। ‘বিদ্রোহী’ চার বিচারপতির অন্যতম রঞ্জন গগৈ প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মী। সেই অভিযোগ পরবর্তীতে ভিত্তিহীন বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের প্যানেল (বিচারপতি গগৈ নিজেও প্যানেলে ছিলেন)। পরবর্তীতে দেখা যায়, পুরো অধ্যায়ে ওই মহিলা কর্মী ও তাঁর পরিবারের ১১ জনের মোবাইল ছিল পেগাসাস স্পাইওয়ারের টার্গেট লিস্টে। ‘বিদ্রোহী’ বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের অবস্থানেরও আশ্চর্য বদল দেখা যায়। রাম মন্দির তৈরি, রাফাল তদন্তের আবেদন খারিজ-সহ কেন্দ্রের দিল খুশ করা একাধিক রায় দেন তিনি, এমনকী প্রধান বিচারপতি হিসেবে মেয়াদের শেষ দিনও। এবং প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরের মাস চারেক পরেই তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত করে কেন্দ্র।    
সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এনভি রমানা বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। তাঁদের মধ্যে অজ্ঞতার প্রচার করা হয়েছে। তার ফলে যে সব শক্তি ভারতীয় গণতন্ত্রের একমাত্র নিরপেক্ষ অঙ্গ বিচার বিভাগকে দমিয়ে রাখতে চায় তাদের সুবিধে হচ্ছে।’ বিলকিস বানুকে ধর্ষণে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে যেভাবে ছেড়ে দেওয়া হল, তাতেই স্পষ্ট সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির আশংকা কতটা বাস্তব।
শুধু বিচার বিভাগকে নয়, সমস্ত স্তম্ভ ও প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিত ভাবে কব্জা করে ফেলা হচ্ছে। বিরোধী মতকে নির্বিচারে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। ইউএপিএ আইন সংস্কার করে সরকারের হাতে এখন অঢেল ক্ষমতা। কোনও প্রমাণ ছাড়াই যে কাউকে জঙ্গি দেগে দিয়ে মাসের পর মাস আটকে রাখা যাবে। 
যে ভাবে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট কেন্দ্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ধার ধারে না। সংখ্যার জোরে, গায়ের জোরে, গলার জোরে কাজ হাসিল করতে চায়। 
উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশের ভানাতারা রিসর্টের মহিলা কর্মীকে খুন করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন বিজেপি নেতার ছেলে পুলকিত আরিয়ার। তারপরই মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামীর নির্দেশে রিসর্টটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় প্রশাসন। তাতে খুনের সমস্ত তথ্যপ্রমাণ মুছে গেল। 
উত্তরপ্রদেশে কেউ দাঙ্গা বাধিয়েছে বা সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করেছে বলে সরকারের মনে হলেই তার বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে গ্যাংস্টার দেগে দিয়ে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হচ্ছে। আইন-কানুনের বালাই নেই। যা ইচ্ছে তা-ই করছে।
একজন আদিবাসী প্রথম বার দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন। আগের রাষ্ট্রপতি ছিলেন দলিত। তা নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছে ও হচ্ছে। অথচ সারা দেশে আদিবাসী ও দলিতদের উপর হামলা বাড়ছে। তাদের অধিকারের উপর আক্রমণ বাড়ছে। 
উঁচু জাতের কলসি ছুঁয়ে ফেলায় রাজস্থানে আরএসএস পরিচালিত স্কুলে উচ্চবর্ণের শিক্ষকের মারে মারা গেছে ৯ বছরের ইন্দ্র মেঘওয়াল। 
২০১১-’২০ এই ১০ বছরে আদিবাসীদের উপর হামলার ৭৬ হাজার ৮৯৯টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোতে। 
টোকিও অলিম্পিক্সে দেশের প্রথম মহিলা হকি খেলোয়াড় হিসাবে হ্যাটট্রিক করে ইতিহাস গড়েন বন্দনা কাটারিয়া। সেমিফাইনালে ভারত হেরে যাওয়ার পর সেই বন্দনার বাড়ির সামনে বাজি ফাটাতে থাকে কয়েকজন উচ্চবর্ণের লোক। তারা বলে, টিমে প্রচুর দলিত খেলোয়াড় থাকাতেই ভারত হেরেছে। 
জন্মদিন পালনে মধ্যপ্রদেশের কুনো অভয়ারণ্যে মোদীর চিতা ছাড়া নিয়ে কত হইচই! কিন্তু সে জন্য বাগচা গ্রামের আদিবাসীরা এখন উচ্ছেদের মুখে, সে কাহিনী তো ঢাকাই থেকে যাচ্ছে। 
কে কী খাবে, কে কী পরবে, কে কার সঙ্গে প্রেম করবে কাকে বিয়ে করবে, কে কী লিখবে-গাইবে, কে কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেবে সব ঠিক করে দেবে শাসক শক্তি। ক্রমাগত বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কথা বলছি।
গুজরাটে গরবা অনুষ্ঠানে কয়েকজন হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। পুলিশ তাদের সবার চোখের সামনে লাইটপোস্টে বেঁধে পেটাল। শয়ে শয়ে লোক ভিড় করে দেখছে। আনন্দে লাফাচ্ছে। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান উঠছে। তাঁদের মধ্যে মহিলারারও আছেন।
মধ্যপ্রদেশে বজরং দলের হাতে ধরা পড়া ১৪ জন মুসলিমকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কেন? তাঁরা গরবা দেখতে গিয়েছিলেন। ওই রাজ্যের সংস্কৃতি মন্ত্রী উষা ঠাকুর আগেই বলে দিয়েছিলেন, ‘গরবা প্যান্ডেল লাভ জিহাদিদের আখড়া হচ্ছে। মা দুর্গার প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই তারা গরবায় যাবেন না।’ তারপর উপমুখ্যমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র গরবা দেখার জন্য পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করেন।
নূপুর শর্মাকে নিশ্চয়ই মনে আছে? তিনি টুইট করলেন, ‘প্রিয় মুসলিমরা, গরবা কোনও বিনোদন নয়, এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। আপনারা যোগ দিতে চাইলে ঘর ওয়াপসি (পড়ুন ধর্মান্তরণ) করে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। নাহলে দূরে থাকুন।’ আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মতে, ‘ভারতের সংস্কৃতির মধ্যেই সামাজিক ঐক্যের ধারণা নিহিত রয়েছে।’ মানে নূপুরের কথা ভারতীয় সহিষ্ণুতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। 
সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম টুইটার কর্নাটক হাইকোর্টে দায়ের করা মামলায় বলেছে, ‘রাজনৈতিক বক্তব্য পছন্দ না হওয়ায় কয়েক হাজার টুইটার আকাউন্ট ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। অত্যধিক ক্ষমতা দেখাচ্ছে কেন্দ্র। সুপ্রিম কোর্টের রায়ও মানছে না।’ অথচ প্রবল বিদ্বেষ ছড়ানো হলেও নূপুরের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে না কেন্দ্র। 
পাল্টা দাঁত-নখ বের করছে মুসলিম মৌলবাদ। এক মুসলিম তরুণীর সঙ্গে প্রেম করার জেরে তালিবানি কায়দায় গলা কেটে খুন করা হয়েছে মীরাটের তরতাজা যুবক দীপক ত্যাগীকে।আমেরিকায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের অনুষ্ঠানে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রামানা বলেছিলেন, ‘আমেরিকা বৈচিত্রকে সম্মান করে বলেই আপনারা এখানে এসে কঠিন পরিশ্রম ও দক্ষতার ফলে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার নীতিই শান্তি ও উন্নতির মূল চাবিকাঠি। একবিংশ শতাব্দীতে সংকীর্ণ ও বিভাজনকারী কোনও বিষয়ের ভিত্তিতে মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক চলবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সকলকে সঙ্গে নিয়ে না চলার অর্থ বিপর্যয় ডেকে আনা। দয়া করে মনে রাখবেন, আপনারা কোটিপতি হতে পারেন। কিন্তু সেই সম্পদ ভোগ করার জন্য শান্তি প্রয়োজন। ভারতে আপনাদের বাবা-মায়েদেরও এমন সমাজে থাকতে পারা উচিত যেখানে ঘৃণা ও হিংসার স্থান নেই।’
ঠিক এই ধারণাকেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে আজকের ভারতে। ফল কী হচ্ছে? বিশ্ব গণতন্ত্র সূচকে ক্রমশ নামছে আমাদের দেশ। The Economist Intelligence Unit (EIU) অনুযায়ী ২০০৬ সালে ভারত ছিল ৩৫ নম্বরে। ২০১৯ সালে ৫১, ২০২০ সালে ৫৩ নম্বরে। ২০২১ সালে ভারত ৪৬ নম্বরে (অবস্থার উন্নতির মূল কারণ সফল কৃষক আন্দোলন)। এরকম আরও অনেক সমীক্ষার রিপোর্ট দিয়ে লেখা আর লম্বা করতে চাইছি না। 
গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দেশের শাসক দলের মতোই মনোভাব দেখা যাবে বেশ কিছু আঞ্চলিক দলের মুখ্যমন্ত্রীদের কাজেও। আমাদের রাজ্যেই ধরুন। 

বিধানসভা ভাঙচুরে নেতৃত্ব দেওয়া এক নেত্রী এখন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর রাজত্বে কার্টুন ফরোয়ার্ড করলে অধ্যাপকের জেল হয়। সারের দাম বাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করলে দিনমজুরকে জেলের ঘানি টানতে হয়। বিরোধীরা সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পান না। বিরোধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নানা মামলা দায়ের হয়। 
ঠিক এখানেই একটা বিরোধের জায়গা লুকিয়ে আছে। কেন্দ্রের শাসকের সঙ্গে রাজ্যের শাসকের অভ্যাসে অনেক মিল থাকলেও, কেন্দ্রের শাসককে হারাতে না পারলে রাজ্যের শাসকের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
সারা দেশে গণতন্ত্রের একের পর এক স্তম্ভকে ক্রমশ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন সমীক্ষা রিপোর্টে ভারতকে আর গণতান্ত্রিক দেশ বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে ভোটে জেতা স্বৈরতন্ত্র। হিটলার-মুসোলিনিদের ধাঁচে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে আধুনিক ফ্যাসীবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে জোরকদমে। তারমধ্যে বিচারপতি গাঙ্গুলিরা আশা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু অবস্থা বদলাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাজনীতির সংস্কৃতির বদল। মূল ধারার রাজনীতির প্রধান প্রধান দলগুলো মূলত একই গতে ভাবে, একই গতে চলে। আচমকা তো নরেন্দ্র মোদীদের জন্ম হয়নি। এই গতবাঁধা রাজনীতির পাঁকেই তো তার জন্ম। তাই প্রয়োজন নতুন ধারার রাজনীতি। তার প্রথম শর্ত, ইতিবাচক (পজিটিভ) মনোভাবের রাজনীতি। বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা, আজকের সময়ে রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। দেখবেন, কোনও একটি রাজনৈতিক দল অন্য কোনও দলের যে কাজের সমালোচনা করছে, নিজেরাই সে কাজ করেছে বা করছে। 
অন্ধকারের মধ্যেও সেই নতুন ধারার আন্দোলনের আলো যে একদম দেখা যাচ্ছে না, তা নয়। পাকিস্তানে মন্দির ভাঙা হচ্ছে কেন, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে আমরা ওস্তাদ। কিংবা ‘চোর ধরো জেল ভরো’। তাতে উত্তেজনা আছে কিন্তু লাভের লাভ কিছু হবে না। বরং নরওয়ে-সুইডেন কী ভাবে বিনা পয়সায় সবার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে পারছে কিংবা কীভাবে দিল্লির সরকারি স্কুল-সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল বদলে যাচ্ছে, কেরল সরকার কীভাবে কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে কাজ করেছে, সে সব নিয়ে চর্চা বাড়ানো যাক। চপ-ঘুগনি-কচুরিপানা নিয়ে খিল্লির বদলে চর্চা বাড়ানো যাক, কী ভাবে রাজ্যে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়। 
গভীর বিশ্বাস রাখি রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’ 
গভীর ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা মানুষই ইতিহাস তৈরি করি। একজন বিচারপতি গাঙ্গুলি নন, আমি-আপনি-আমরাই আমাদের প্রকৃত মসিহা। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
নামহীন বলেছেন…
আহা... সাধু সাধু। অনেকদিন পর খুব ভালো একটি লেখা পড়লাম।
Suman Chakraborty বলেছেন…
বিচারপতির আপোষহীন মনোভাব এর প্রশংসা করলেও, সংবাদ মাধ্যমে interview দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না দেখে অবাক হলাম। তবে কি সবাই Superman হবার প্রতিযোগিতায় নামলো!

Top Post Ad