(দুর্গোৎসবের অর্থনীতি: চিনিয়েছেন মমতা, ডোবাচ্ছেনও মমতাই। এই লেখাটা পড়ার পরে এই লেখাটা পড়ার অনুরোধ রইল।)
দুনিয়ার উৎসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় ব্রাজিলের রিও ফেস্টিভ্যালে। ওই উৎসবকে অনেকে বলেন THE GREATEST SHOW ON THE EARTH. এবছর উৎসব দেখতে ভিড় করেছিলেন প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ। তাঁদের মধ্যে বিদেশী প্রায় ২০ লক্ষ। হিসেব বলছে, ২০২০ সালে রিও ফেস্টিভ্যালে ব্যবসা হয়েছে ১.৩ লক্ষ কোটি টাকার।
উল্টো দিকে দেখুন, এখনও দুর্গোৎসবে বাইরের দর্শক সংখ্যা খুবই কম। বিদেশ থেকে তো বটেই, অন্য রাজ্যের লোকও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আসেন না। তার মানে এখন যে ৪০-৫০ হাজার বা ১ লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, সেটা মূলত রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই। কর্মসংস্থানের ঠিকঠাক হিসেব পাওয়া না গেলেও মোটামুটি সংখ্যাটা সব মিলিয়ে অন্তত লাখ দশেক হবে। পর্যটক বাড়লে উৎসবের আর্থিক লেনদেনের আয়তনই শুধু বাড়বে না, নতুন মূল্ওযও যুক্ত হবে। আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রের দরজা খুলে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে।
প্রথমে দরকার দর্শক বাড়ানোর পরিকল্পনা করা। কেন্দ্র-রাজ্য সরকার একযোগে না চললে সেটা করা যাবে না। বিভিন্ন দেশে ভারতীয় হাইকমিশন, এদেশে থাকা বিভিন্ন দেশের হাইকমিশন, কলকাতায় থাকা বিভিন্ন দেশের কনসুলেট, বিভিন্ন দেশে থাকা অনবাসী বাঙালি ও অনাবাসী ভারতীয়রা হাত মিলিয়ে বিদেশের পর্যটক আনার কাজটা করা যায়।
দুর্গোৎসব তো আছেই। তার সঙ্গে আর কোথায় কোথায় যেতে পারেন ভিন দেশ বা ভিন রাজ্যের পর্যটকরা। সুন্দরবন, শান্তিনিকেতন, পুরুলিয়া, দার্জিলিং, ডুয়ার্স তো আছেই, খুঁজে দেখে দেখতে হবে আরও কী কী হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ধরা যাক, পশ্চিম মেদিনীপুরের কাছে গনগনিতে ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ দেখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মন্দির শহর বিষ্ণুপুর, সেখান থেকে জয়পুর জঙ্গল...। মালদা-মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস।
আমার মতে, দুর্গোৎসব মানে ষষ্ঠী থেকে দশমী। একাদশীতে কার্নিভাল। থিম পুজো, সাবেকি পুজো, বনেদি বাড়ির পুজো, ছোট পুজো, আবাসনের পুজো-এরকম নানা ভাগ দেখা যায় আমাদের দুর্গোৎসবে। এই বৈচিত্রগুলোকে আলাদা ভাবে কাজে লাগানো যায়।
ষষ্ঠীর আগে আসা পর্যটকরা দেখতে পাবেন কুমোরটুলিতে কী ভাবে প্রতিমা তৈরি হয়, কী ভাবে একেকটা মণ্ডপ সেজে ওঠে। গঙ্গায় নৌকো, নলবনের ঝিলে নৌকো, মাছ ধরা, গলফ কোর্স, রেসকোর্স...কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা, বিশেষত গ্রামগুলোয় সে ব্যবস্থা করা যায়।
আমাদের রাজ্যে এবং অন্য রাজ্যের হস্তশিল্প, কারুশিল্প, মিষ্টি, খাবার ইত্যাদির পসরা সাজানো থাকবে। থাকবে বিভিন্ন রকম লোকসংগীত, লোকশিল্পের আয়োজন। কোথাও ছৌ, কোথাও ভাঙরা, কোথাও বিহু, কোথাও ভাওয়াইয়া, কোথাও বাউল...কোথাও ভূমি-ফসিলস-ক্যাকটাস...নানা ব্যান্ড, কোথাও প্রসেনজিৎ-দেব-ঋতুপর্ণা-শিবপ্রসাদ,নন্দিতা-কৌশিক গাঙ্গুলি, কোথাও আবার লোপামুদ্রা-রূপম-শ্রীকান্ত-ইমন...পারলে বলিউড...। সিনেমা-নাটক-বই-চিত্রকলা...আরও কত কী। কোথাও মীর-সেন্টু-কাঞ্চন...।
থাকবেন কোথায় পর্যটকরা? হোটেল তো আছে। তার সঙ্গে থাক হোম স্টে। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে মিলে কোনও জায়গায় পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। বড় ট্যুর এজেন্সি থাকবে, কিন্তু ছোট ছোট ট্যুর এজেন্সিগুলেকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া গেলে লাভটা বেশি হবে। বিশেষত একসঙ্গে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে যুক্ত হয়ে এজেন্সি গড়লে সরকারের তরফে প্রাথমিক আর্থিক সহায়তা করা দরকার। বিভিন্ন পেশাকেন্দ্রীক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (যেমন টুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট) যৌথ ভাবে কাজ করলে বড় সুযোগ তৈরি করা যায়। দোভাষীর কাজেও প্রচুর লোক লাগবে। পরিবহণ ক্ষেত্রেও বড়সড় সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
দেখা যাচ্ছে, ওই রিপোর্টে পর্যটনের হিসেবটা নেই। কারণ সেই পরিকল্পনাটাই তো নেই। ১০টি চিহ্নিত ক্ষেত্রের সঙ্গে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনাটা যুক্ত করুন। বোঝা যাবে হয়তো, দুর্গোৎসব রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র কী ভাবে হতে পারে।এখন আমাদের রাজ্য বাজেটের আয়তন কত? এই আর্থিক বর্ষে ৩.২১ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পেশ হয়েছে। দুর্গোৎসবেই তার থেকে বেশি লেনদেন অসম্ভব কিছু ব্যাপার? এখন আমাদের রাজ্যের জিডিপি ১৭ লক্ষ ১৩ হাজার কোিট টাকা। দুর্গোৎসবের অর্থনীতি ম্যাজিক দেখাতে পারে।
ম্যাজিক দেখাতে কিছু শর্ত পূর্ণ দরকার বলে মনে হয়।
দুর্গোৎসবের অর্থনীতি কীভাবে রাজ্যের চেহারা বদলে দিতে পারে, সে সব কথার বদলে বলে যাচ্ছেন: বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার করছে; এজেন্সি সুব্রত মুখার্জিকে গ্রেফতার করায় সেই ‘অপমানের ধাক্কা’ সামলাতে না পেরে তিনি অকালে প্রয়াত হয়েছেন; সিপিএম জমানার কাগজপত্র কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাল্লা দিচ্ছে বিরোধীরা। কবে মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হবেন, কবে সরকার পড়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি বিরোধিতার রাজনীতিতেই তাঁরা ব্যস্ত। এর ফলে কী সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে সেটা বোঝার মতো ইচ্ছে বা বুদ্ধি কোনওটাই নেই।
বিভিন্ন উন্নত দেশ তো বটেই, আমাদের দেশের অন্যান্য অনেক রাজ্যেই দেখা যায় রাজ্যের স্বার্থে, শাসক-বিরোধী এক জায়গায়। আমাদের রাজ্যেও এই সংস্কৃতি ছিল। এখন এক বিন্দুও নেই। দলাদলির রাজনীতির লোকেদের কে বোঝাবে, এই সময় ক্ষুদ্রতার রাজনীতিতে আটকে থাকলে রাজ্যের সম্মান নষ্ট হবে। রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙা করার সুযোগ নষ্ট হবে। তাই বর্তমান সময়ে শাসক ও বিরোধী দলের রাজনীতিকদের উপর আমার কোনও আস্থা নেই।
বিভিন্ন উন্নত দেশ তো বটেই, আমাদের দেশের অন্যান্য অনেক রাজ্যেই দেখা যায় রাজ্যের স্বার্থে, শাসক-বিরোধী এক জায়গায়। আমাদের রাজ্যেও এই সংস্কৃতি ছিল। এখন এক বিন্দুও নেই। দলাদলির রাজনীতির লোকেদের কে বোঝাবে, এই সময় ক্ষুদ্রতার রাজনীতিতে আটকে থাকলে রাজ্যের সম্মান নষ্ট হবে। রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙা করার সুযোগ নষ্ট হবে। তাই বর্তমান সময়ে শাসক ও বিরোধী দলের রাজনীতিকদের উপর আমার কোনও আস্থা নেই।
দুর্গোৎসবকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের অর্থনীতির মোড় ঘোরানোর সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে পরিকল্পনা ও কার্যকর করার ভারটা পেশাদার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি হাইপাওয়ার কমিটির হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে। জ্ঞান ও বাণীসর্বস্ব, চাটুকার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে হবে না। সরকারও হাইপাওয়ার কমিটির উপর ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করবে না। অল্প কিছু কর্পোরেট নয়, বেশিসংখ্যক সাধারণ মানুষ যাতে উপকৃত হন, সেই নজরদারির কাজটাই মূলত সরকারকে করতে হবে।
কর্মযজ্ঞ হাতেকলমে করার কাজটা সাহস ভরে দিতে হবে ১৪ থেকে ৩৫ বছরের হাতে। ওদের মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান, উৎসাহ, কর্মোদ্যোগ ম্যাজিক ঘটাতে পারে। চাকরিকেই আমরা বাঙালিরা মোক্ষ বলে মনে করি। এবং তারপর চিৎকার করি মারোয়ারি-বিহারী-ওডিয়ারা সব দখল করে নিচ্ছেন। সকাল-সন্ধ্যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়-প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরদের ছবিতে ফুল-মালা চড়িয়ে ব্যবসায় নামতে হবে। ডোকরা-বাউল-মোরব্বা-ল্যাংচা-গান-ছবি আঁকা-চলচ্চিত্র, সব রকমের ব্যবসা।
ঝুঁকি নেওয়ার মনোভাব, জেদ, উৎসাহ ইত্যাদিকে সঙ্গী করে দুর্গোৎসবের অর্থনীতি চাঙা করা গেলে রাজনীতির দাদাদের লগে ঘোরার দরকার পড়বে না। দাদারাও কোটি কোটি টাকা কামাইয়ের সুযোগ পাবে না। কেন আমাদের রাজ্য পিছিয়ে পড়ছে তা নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি ছেড়ে একটু অন্য ভাবে ভাবা যাক। কী বলেন?
নীচে দেখুন কমেন্ট করার জায়গা আছে। খুঁজে পেতে অসুবিধা হচ্ছে বলে অনেকে বলেছেন। চেষ্টা করছি সমস্যা মেটানোর। ততক্ষণ একটু কষ্ট করে কমেন্টের জায়গাটা খুঁজে নিয়ে লিখুন না আপনার মতামত। যুক্তিযুক্ত কড়া সমালোচনা পেলে বেশি ভাল লাগবে।