link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

জন্ডিস হলেও তেলেভাজা খাবেন? Modi-Mamata-Common-People

মমতা ব্যানার্জি ও অনুব্রত মণ্ডল
শুরুতে কয়েকটা তথ্য জানাই।
দেশের সবচেয়ে ধনী ৯৮ জনের সম্পত্তি দরিদ্র ৫৫.২ কোটি মানুষের সম্পত্তির সমান। (সংখ্যাগুলো আরেক বার পড়ে দেখতে পারেন।) ৯৮ জনের সম্পত্তি দরিদ্র ৫৫.২ কোটি মানুষের সম্পত্তির সমান। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু সত্য। এই সবচেয়ে ধনী ৯৮ জনের সম্পত্তির উপর ১% কর বসালে আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পের সাত বছরের বেশি খরচ উঠে যাবে।
কোভিড মহামারীর সময় (মার্চ ২০২০ থেকে ৩০ নভেম্বর, ২০২১) দেশের ৮৪% মানুষের আয় ও জীবনমান কমেছে। কিন্তু ধনকুবেরের সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪২তাঁদের সম্পত্তি ২৩.১৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র দেড় বছরে বেড়েছে প্রায় সওয়া দু'গুণ। এই সময়ে ৪.৬ কোটি মানুষ হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছেন (রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেবে দুনিয়ার নতুন হতদরিদ্রের প্রায় অর্ধেক), যাঁদের বেশির ভাগ মহিলা, মুসলিম, এসসি-এসটি-ওবিসি এবং গ্রামের বাসিন্দা।
দেশের উপর দিকের ১% এবং ১০% মানুষের হাতে জাতীয় আয়ের যথাক্রমে ২২% এবং ৫৭%। উল্টোদিকে নীচের ৫০% মানুষের হাতে মাত্র ১৩%। রাষ্ট্রসংঘ বলছে, দুনিয়ার যে সব দেশে আর্থিক অসাম্য সবচেয়ে বেশি বাড়ছে, ভারত তার অন্যতম।
গরিবের জ্বালানি কেরোসিনের ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়েছে ২০২১ সালে। কত ভর্তুকি ছিল? '২০-২১ অর্থবর্ষে ২৬৭৭.৩২ কোটি টাকা, '১৯-২০ অর্থবর্ষে ছিল ৪০৫৮ কোটি টাকা। ফল? জুন, ২০১৯ কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ছিল ৩৩.৮৭ টাকা। জুলাই, ২০২২ হয়েছে ১০১.৭৬ টাকা।
রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি '১৯-২০ অর্থবর্ষে ছিল ৩৫,৬০৫ কোটি টাকা, '২০-২১ অর্থবর্ষে ছিল ২৫,৫২০.৭৯ কোটি টাকা, '২১-২২ অর্থবর্ষে হয়েছে ১২,৪৮০ কোটি টাকা। ফল? গ্যাস সিলিন্ডারের দাম জুন, ২০১৯ ছিল ৭৬৩.৫ টাকা। মে, ২০২২ সেটা হয়েছে ১০২৯ টাকা। এখন শুধু উজ্জ্বলা প্রকল্পে সিলিন্ডার প্রতি ২০০ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। আর কোনও ভর্তুকি নেই।
কাদের উপর কোপ পড়ল? গরিব ও মধ্যবিত্ত। অনেকেই বলবেন পড়ল তো পড়ল। দেশ গড়তে হলে কি ভর্তুকি রাখা উচিত? আচ্ছা বেশ। 

দেখুন, ২০১৪-২১ শুধু স্টেট ব্যাংক ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছে। সমস্ত সরকারি ব্যাংক ২০১৪-২০২১ সময়ে কর্পোরেটের মোট ৮.১৭ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করেছে। অতীতে কখনও এরকমটা হয়নি। কাদের ঋণ? সবাই বড় বড়লোক। লেখার শুরুতে যে ৯৮ জনের কথা বললাম তাঁদেরও কয়েকজন আছেন। মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়া, নীরব মোদিরা আছেন।
গরিব মধ্যবিত্তের জন্য সামান্য টাকা ভর্তুকি দেওয়া যায় না, অথচ কর্পোরেটদের কোটি কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দেওয়া যায়। সাধারণ মানুষের টাকায় শিল্পপতিদের ভান্ডার ভরানোর ব্যবস্থা। 
কেস জন্ডিস।
'বিকাশ পুরুষ উন্নয়নের ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন', 'আত্মনির্ভর ভারত', 'মেক ইন ইন্ডিয়া', 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ'। কান পেতে শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছেন না? শব্দগুলোর আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে না? সেজন্যই 'চোর ধরো জেল ভরো'র আওয়াজও বাড়ছে না তো? 
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক
আমার এক সাংবাদিক বন্ধু হোয়াটস অ্যাপে লিখলেন, 'তোমার অপা পার্থর মালকিনকে নিয়ে লেখ। বন্ধ ঘরে (মোদীর সঙ্গে) ৪০ মিনিট কী হল সেটা নিয়ে লেখ। এসব এ বাজারে খাবে না।' জবাবে বলেছি, 'আমি খাওয়ানোর জন্য লিখি না।' উত্তর পেয়েছি, 'তবে কি দাদা বঙ্গবিভূষণের জন্য?' কথোপকথনের ভাষাতেই আমার সেই বন্ধুর রাজনৈতিক মতলবটা স্পষ্ট। স্পষ্ট ইঙ্গিত, তুমি ব্যাটা দিদির লোক! এত চুরি, এত চুরি, কিন্তু তা নিয়ে তেমন কিছু লিখছ না, শুধু দেশে কী হল তা নিয়ে লেখা!
আমার সেই সাংবাদিক বন্ধু একা, এটাই বা বলি কী করে? ২৩ জুলাইয়ের পর থেকে টিভি সিরিয়ালগুলোর দর্শক কমেছে। নিউজ চ্যানেলেই যা দেখা যাচ্ছে...। পার্থ-অর্পিতা-অনুব্রত...। আমরা দেখছি। খিল্লিতে মাতছি। কেউ কেউ ভোটের অংক করছি। দুর্নীতি একটা রোগ। তার কারণ খুঁজে বের করে রোগ সারাতে হবে, এভাবে কেউ ভাবছি কি? রোগের গোড়াটা কি, খুঁজছি? 
তৃণমূল কংগ্রেস দলটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে, কে জানতাম না? পুরো তৃণমূল কংগ্রেস দলটাকে গারদে ভরে দিলে দুর্নীতি চলে যাবে? বাম জমানার ছবিটা কী ছিল তা লিখে লেখার দৈর্ঘ বাড়াতে চাইছি না। 'না খায়ুঙ্গা না খানে দুঙ্গা'-র দলের কথাও এখানে বিস্তারিতে বলছি না। শুধু বলছি, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের আমলেই বেআইনি নথি কাজে লাগিয়ে নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। কোনও হইচই আছে? পিএম কেয়ার ফান্ড তো বেআব্রু দুর্নীতি। এরকম আরও উদাহরণ দিয়ে লেখা লম্বা করতে চাইছি না।  তো রোগটা সিস্টেমে। 
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলব না, সেটা আমার বক্তব্য নয়। কিন্তু দুর্নীতি আজকের ভারতের সমাজ ও রাজনীতিতে কোনও ইস্যু নয়। বরং দুর্নীতি এমন একটা বিষয় যে দিকে নজর ঘুরিয়ে দিয়ে জন্ডিস আড়াল করে রাখা যায়। আমরা পাবলিক দুর্নীতি শুনলে খুব রেগে যাই, গর্জাই এবং তারপর নিজেরাই নিজেদের জায়গায় দুর্নীতি করি বা দুর্নীতি করতে দেই। দেশের শরীরে জন্ডিসের লক্ষণগুলো শুরুতেই লিখেছি। দুর্নীতি নিয়ে মেতে থাকা হচ্ছে জন্ডিসের সময় তেলেভাজা খাওয়ার মতো ব্যাপার। 
অসাম্যের জন্ডিস সারা দুনিয়ায়। আমাদের দেশেও অসাম্য আছে। এবং বাড়ছে। ১৯৯১ সালে মুক্তি বাজার অর্থনীতি চালুর পর থেকে আরও বাড়ছে। আর মোদী জমানায় বিলিরুবিন বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গেছে। 
(পাশের গ্রাফ দেখলে বোঝা যাবে)
এই রোগের জন্ম মুনাফা সর্বস্ব অর্থনীতির হাত ধরে। এবং এই রোগ সারানোর কোনও ওষুধ এখন আর মাতব্বরদের হাতে নেই। তাই জড়িবুটি। মানে মৌলবাদ, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, যার ধারক-বাহক আরএসএস-বিজেপি। এই বিপদকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে আরও অনেকটা সময়। তার মানে ২০২৪ সালে ফের নরেন্দ্র মোদীর সরকার? না, তেমনটা বলছি না। ভোটের অংকে এই বিপদকে দেখা সম্ভব নয়। আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপি গোহারা হারলেও ভারতের রাজনীতি থেকে এই বিপদ যেতে অনেক সময় লাগবে।
কেন মনে করি, মৌলবাদ বিপদ? কেন মনে করি, আরএসএস-বিজেপি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ? বিজেপি সম্পর্কে ব্যক্তিগত কোনও রাগ থেকে একথা বলি না। আমার বন্ধুদের অনেকেই আছেন বিজেপি নেতা-কর্মী-সমর্থক। এমনকী কট্টর আরএসএস কয়েক জনের সঙ্গেও ভালই ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। আরএসএস-বিজেপি যে ভাবাদর্শটা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটা সভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক। সেটা সভ্যতাকে পিছন দিকে নিয়ে যাওয়ার মতাদর্শ। তাই আমার বিরোধিতা। সভ্যতা না বাঁচলে তো আমিও বাঁচব না। 
পিনারাই বিজয়ন ও নরেন্দ্র মোদী

রাজনীতি ভাবাদর্শের লড়াই। যে কোনও আরএসএস নেতা-কর্মীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন, দেখুন একবাক্যে বলবেন, তাঁদের সবচেয়ে বড় ভয় কমিউনিস্টদের নিয়ে। মোদী-মমতার সাম্প্রতিক মিটিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতি বারবার কী বললেন? 'অন্যদের কথা ছেড়ে দিন। এমনকী পিনারাই বিজয়ন, মতাদর্শগত ভাবে আমাদের ১৮০° উল্টোদিকে, তিনিও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।' সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা কাকে নিয়ে, সেটা স্পষ্ট।
জ্যোতি বসু ও অটলবাহিরী বাজপেয়ী
এই দেখাটা কি ভোটের অঙ্কে? কটা আসন এখন বামপন্থীদের? কত শতাংশ ভোট? বিজেপির শক্তির তুলনায় জাস্ট কিস্যু না। কিন্তু তাদের নিয়েই বেশি চিন্তা প্রবল পরাক্রমী আরএসএস-এর। কারণ আরএসএসের কাছে লড়াইটা আদর্শগত। 
পরিচিত আরএসএস বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সংঘ-বাড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি সে প্রস্তাব বাতিল করতেই স্বস্তি। 
২০২১। জয়ের পর
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আমি সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেসকে জেতানোর আবেদন করেছিলাম। তৃণমূল কংগ্রেস দলটা কেমন, সেটা জেনেও বলেছিলাম। একটাই কারণ, বিজেপিকে আটকাতে চেয়েছি। বামবাদী পার্টিগুলির অবস্থানের সমালোচনা করেছিলাম। একটাই কারণ, তাতে বিজেপি লাভবান হচ্ছিল। এখনও বিজেপিকে আটকাতে চাই। বাস্তবতা হল, সে ক্ষমতা আর তৃণমূলের নেই। সেটা আগেও স্পষ্টই বলেছি। 
মোহন ভাগবত ও নরেন্দ্র মোদী
যে বোঝাপড়া, যে মতাদর্শ সভ্যতাকে পিছন দিকে ঠেলে দেয়, তাকে অবশ্যই মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যেমন হিটলার জার্মানদের খাঁটি আর্য বলে প্রচার করেছিলেন। ঠিক তেমনই আমাদের দেশেও রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধারণা দাঁড়িয়ে আছে একটা মিথ্যার ওপর, আর্যরা নাকি ভারতের আদি বাসিন্দা। এটা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে ভারত মানে হিন্দু সংস্কৃতি, মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বহিরাগত, কমিউনিজমের ধারণা বহিরাগত এসব ধারণা বিক্রি করা যাবে না। অনেক রাজনৈতিক দল বিভিন্ন মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে ভোটের কাজে লাগায়। বিজেপির কাছে কিন্তু এটা কৌশল নয়। আদর্শগত ভাবেই বিজেপি-আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। এই ফারাকটা স্পষ্ট থাকা দরকার। নয়তো মহম্মদ সেলিমরা বোঝাবেন আরএসএস দুটো পার্টি চালায়-বিজেপি আর তৃণমূল। সেটা নিয়ে অনেকে নাচানাচি করবেন। 
আরএসএসের প্রশিক্ষণ
সিপিএম বা মহম্মদ সেলিমকে নিয়ে আমার মনের দূরতম কোণাতেও কোনও আশা নেই, কিন্তু ওই ভাবনা একটি মানুষকেও প্রভাবিত করলে সেটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্বল করবে। বিজেপির মৌলবাদ ঠেকানোর নামে আব্বাস সিদ্দিকির মৌলবাদের সঙ্গে হাত মেলাবেন সেলিমরা। আর তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে এই আদর্শগত অবস্থানটা আশা করাই মুর্খামি। গত বিধানসভা ভোট পর্যন্ত ভোটের লড়াইয়ে তারা বিজেপিকে ঠেকাতে পেরেছে। এই পর্যন্তই তাদের দৌড়। এরপরে তারা ১০০% শক্তি দিয়ে বিজেপিকে ঠেকানোর চেষ্টা করলেও কিস্যু লাভ নেই। 
মোদী ও বাজপেয়ী
কথায় কথায় অন্য কথায় চলে যাচ্ছি। ভাবাদর্শ মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকলে পরিকল্পিত ভাবে ইমেজ তৈরি করতে হয়। নেতা আকাশ থেকে পড়েন না। নেতা সময়ের সৃষ্টি। বিজেপির দুই প্রধানমন্ত্রী, দুজনই সংঘের একনিষ্ঠ স্বয়ংসেবক। কিন্তু দুজনের মেধা-আচরণ-রুচিতে আসমান জমিন ফারাক। সাধারণ মহিলাদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে 'দিদি, ও দিদি...' ডাক। অটলবিহারী বাজপেয়ী ওই ডাক দেবেন, সেটা স্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে পারবেন না। কিন্তু সেটাই করেছেন নরেন্দ্র মোদী। নেতাজির প্রতি সম্মান জানাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালতে বলেন মোদী। সে কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না বাজপেয়ী। কারণটা লুকিয়ে আছে সময় ও পরিস্থিতির মধ্যে।
এখন একচ্ছত্র দাপটের সময়। তাই এখন নেতাকে অতিমানব প্রতিষ্ঠার সময়। নিজেদের জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করতে হলে ইতিহাস বদলে দিতে হবে। প্রচারে পরিকল্পনায় এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে যেন সংঘ পরিবারই সব সেরা দেশপ্রেমী। 
তেরঙা না হওয়া কয়েকটি সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলের ডিপি
তেরঙা সম্পর্কে তাদের অশ্রদ্ধার ইতিহাস আড়াল করো। আরএসএস স্বাধীনতার লড়াইয়ে ছিল তো না-ই, উল্টে ব্রিটিশকে সহযোগিতা করেছিল, সেই ইতিহাস আড়াল করো। প্রতি পদে দেশপ্রেমের ব্যান্ড বাজাও। মানে, সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত, বিরাট বিরাট জাতীয় পতাকা ওড়ানো এখানে ওখানে সেখানে, হর ঘর তিরঙা, ডিপি তেরঙা করা ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
খেয়াল করলে দেখবেন, দিল্লির কৃষক আন্দোলন, সিএএ বিরোধী আন্দোলন, অগ্নিপথ বিরোধী আন্দোলন...এরকম নানা আন্দোলনে জাতীয় পতাকা রাখা হচ্ছে। মানে প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ দিয়ে যাও, তুমি দেশপ্রেমী। সংঘের কল কেমন কাজ করছে বোঝা যাচ্ছে। আদ্যন্ত দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা আন্দোলন বিরোধী একটা শক্তির কাছে দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হচ্ছে! (জানি, অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের ভূমিকা সম্পর্কে। নিশ্চয়ই সে সম্পর্কে বিস্তারিতে লিখব।)
তেরঙা বা দেশপ্রেম এখন পুরোপুরি পণ্য। মাথা খাটিয়ে তৈরি করা ঝকঝকে প্যাকেজিং। মাতৃপ্রেমও তো এখন পণ্য। কখনও কখনও মনে হয়, আমাদের দেশের কোনও নেতার কখনও কোনও মা ছিলেন না। 
কিছু জিনিস থাকে একান্ত ব্যক্তিগত। সেগুলোর বিজ্ঞাপন করতে হয় না। কেউ অতিমানব হতে গিয়ে সেটা অনুভব না-ও করতে পারেন। অনেক মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ছেলে গেলেন মায়ের কাছে। মায়ের সঙ্গে নানা মুহূর্ত ক্যামেরায় তোলা হল। স্ক্রিপ্ট মেনে অভিনয় হল। সেই ছবি ছড়িয়ে গেল দুনিয়াজুড়ে। কামনা করি, এমন দুর্মতি যেন আর কোনও ছেলের না হয়। কোন অনুষ্ঠানে কী পোশাক পরবেন, কী পাগড়ি পরবেন, কী বলবেন, কীভাবে বলবেন, কেমন দাড়ি রাখবেন (যেমন, বাংলার ভোটের আগে রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি) সব ছক কষা। তাঁর হাঁটা, চোখ তুলে তাকানো, ঘাড় ঘোরানো, সব হিসেব কষে। তিনি হাঁটছেন, ব্যায়াম করছেন, ময়ূরকে খাওয়াচ্ছেন, সর্দার প্যাটেলের ইয়া উঁচু মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছেন, সব-সব-সব পরিকল্পনার অংশ। প্রতি মুহূর্তে একটা অতিমানবিক ভাবমূর্তি তৈরির পরিকল্পিত চেষ্টা। 
অনেকে ভাবতে পারেন, মোদী ফ্যাশনপ্রিয়। আমি তাঁকে অপছন্দ করি বলে খুঁত ধরছি। ভুল বুঝবেন না। ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে আক্রমণ করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। মোদী একজন স্বয়ংসেবক। যতটুকু জানি, স্বয়ংসেবকদের বিলাসী জীবন হয় না। পাশের ছবিটা দেখুন। বিজেপির সভায় বসে আছেন তরুণ মোদী। এটাই স্বাভাবিক মোদী। মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও তো এরকমটা দেখা যায়নি। আসলে প্রেক্ষিত পাল্টে গেছে। তাই পাল্টে গেছে ধরণ। তাই অন্য রকম ইমেজ তৈরি করতে হচ্ছে।
খেয়াল করলে দেখবেন, সত্তরের দশকে দেশের আর্থিক সংকট ক্রমশ জনজীবনে ছাপ ফেলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে রাজ কাপুর, দেব আনন্দের নরম নরম ভাবমূর্তি সরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে অমিতাভ বচ্চনের অ্যাংগরি ইয়ংম্যান ইমেজ, যিনি একা হাতে সব অন্যায়কে হারিয়ে দেন। সংকটের সামনে অসহায় সাধারণ মানুষ এরকম এক অতিমানবের কাছেই তো আত্মসমর্পণ করতে চান। সারা দুনিয়ার অর্থনীতি এখন গভীর সংকটে। মুনাফার অর্থনীতি সংকট কাটিয়ে ওঠার কোনও রাস্তা পাচ্ছে না। এরকম সময়েই অতিমানব নেতার দরকার হয়। যেমনটা তিরিশের দশকে জার্মানিতে হিটলার ছিলেন। 
নাটকের মঞ্চে ছেলেবেলার মোদী
এখন এদেশে সে কাজটাই চলছে। মোদী জমানায় দেশের মানুষের হাল কী সেটা লেখার শুরুতেই বলেছি। কিন্তু ইমেজ তৈরি করা হচ্ছে, মোদী এক প্রবল শক্তিমান নেতা যিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন অপার সুখের দেশে। তাঁর পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে অন্যায়, দুর্নীতি, অসাম্য, খারাপ খারাপ সব কিছু। সেই ইমেজ তৈরির ভাবনা থেকেই বলার ধরণ, বলার ভাষা, পোশাক বা পাগড়ি বাছাই। তাই স্বয়ংসেবক মোদী যা করেননি, মুখ্যমন্ত্রী মোদী যা করেননি, প্রধানমন্ত্রী মোদী তাই করছেন। বলা ভাল, করানো হচ্ছে। ছোটবেলায় অভিনয় করতে ভালোবাসতেন মোদী। ভালোবাসতেন অতিমানব চরিত্র হতে। তাই তাঁর মানসিকতার সঙ্গেও মানিয়ে গেছে এই অতিমানব ভাবমূর্তি তৈরির কৌশল। কয়েক মাস আগে দিল্লিতে টানেল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর হুড খোলা গাড়িতে টানেল পরিদর্শনে যান। অনেক পরে একটা ভিডিও সামনে আসে। টানেলের রাস্তায় পরে থাকা নোংরা, বোতল সাফ করছেন প্রধানমন্ত্রী। কোনও মিডিয়ার ক্যামেরায় ছবিটা তোলা হয়নি। এমনকি কোনও সংবাদসংস্থাও তোলেনি। ভিডিওটি সংবাদসংস্থাকে পাঠিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর।
অত্যন্ত গরীব ঘর থেকে উঠে আসা প্রবল শক্তিমান নেতা প্রবল মাতৃভক্ত। তিনি প্রবল দেশপ্রেমিক। সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজে রাস্তা সাফ রাখতেও পিছপা হন না। ভাবমূর্তিটা কেমন? বাজারে হিট হতে বাধ্য। 
দেখবেন, এই জমানায় কোনও কিছুই ছোট হয় না।
গুজরাটের কেড়ওয়াড়িতে নর্মদার তীরে ২৪০ মিটার উঁচু (প্রায় ৬০ তলা বাড়ির সমান উঁচু) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি বসেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মূর্তি। খরচ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা (নতুন সংসদ ভবন তৈরিতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা)।
নতুন সংসদ ভবনের মাথায় বসানো সাড়ে ৬ মিটার উঁচু (প্রায় ২১ ফুট) অশোক স্তম্ভের ওজন প্রায় ৯৫০০ কেজি। তাকে ধরে রাখবে সাড়ে ৬ হাজার কেজির কাঠামো।
প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচে অযোধ্যায় তৈরি হচ্ছে রাম মন্দির। ৭০ একর জমির উপর দৈর্ঘে ৩৬০ ফুট, প্রস্থে ২৩৫ ফুটের মন্দিরটি তৈরি হবে। আগে ঠিক ছিল মন্দিরের উচ্চতা হবে ১৪১ ফুট। পরে ঠিক হয়েছে মন্দির ১৬১ ফুট উঁচু হবে। মূল মন্দির দোতলার পরিবর্তে তিনতলা হবে।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার বরহাটা গ্রামে সরজূর তীরে তৈরি হবে ২৫১ মিটার উঁচু রামের মূর্তি। সর্দার প্যাটেলের মূর্তিকে পিছনে ফেলে সেটাই হবে দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু মূর্তি।
কর্ণাটকের হাম্পিতে বসছে হনুমানের ২১৫ মিটার উঁচু মূর্তি। খরচ হবে ১২০০ কোটি টাকা। 

রাজা-মহারাজা-সম্রাটরা কি ছোট কিছু তৈরি করেন? তিনি তো 'হিন্দু হৃদয় সম্রাট'। সামান্য সাংবাদিকদের প্রশ্ন শোনা তাঁর কাজ হতে পারে না। তাই তিনি কখনও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। তিনি শুধু বলেন। বাকিরা শোনে। এটা যদি ব্যক্তি মোদীর অভ্যাস হত তাহলে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ও তাই করতেন। দিল্লির এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে শুনেছি, এক সময় টিভি চ্যানেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন মোদী। লালকৃষ্ণ আদবানি বা অরুন জেটলিরা যেতে না পারলে তিনি চ্যানেলে বিজেপির কথা বলতে বসতেন।
ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী বা দল হিসেবে বিজেপি বা সংগঠন হিসেবে আরএসএসের সঙ্গে বিরোধ নয়, বিরোধ তাদের 'অসভ্য, বর্বর' মতাদর্শের সঙ্গে। 'মাথা গুঁড়িয়ে দেব' বলে হুমকি দিয়ে তাকে আটকানো যায় না। সেই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত আধুনিক, পরিকল্পিত, শক্তিশালী প্রচার কৌশল, আইটি সেল। সেখানে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিয়ে সেরা মেধার নিয়োগ, সেরা প্রযুক্তির ব্যবহার বোঝায় সংঘ নিজেদের লক্ষ্য পূরণে কতটা জেদি, মরণপণ মনোভাব নিয়ে চলে।
মায়ের শততম জন্মদিনে ছেলে তাঁর পা ধুইয়ে দিলেন। সেই ছবি ফলাও করে প্রচার হল। আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রীর অন্য ভাইরা কিছু করলেন না? তার তো কোনও ছবি নেই। কেন তাঁদের ছবি থাকবে? তাঁদের ভাবমূর্তি তৈরির দরকার আছে কোনও? কেদারনাথে গিয়ে গুহায় ধ্যানে বসলেন। সঙ্গে অসংখ্য ক্যামেরা। মুনি ঋষিরা শুনলে নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যেতেন। তাঁদের তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভাবমূর্তি তৈরির তাগিদ ছিল না। তাঁরা এর মাহাত্ম্য বুঝবেন কী করে!
তিনি 'হিন্দু হৃদয় সম্রাট'।
মা হিরাবেনের ১০০ তম জন্মদিনে ব্লগে লিখলেন আব্বাস ভাইয়ের কথা। সে বিবরণ এখন অনেকেরই জানা। তিনি লিখলেন, আব্বাস তাঁর সেরা বন্ধু। অনেকের মতো আমারও আব্বাস সম্পর্কে জানার ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল কেন মোদী এতদিন সেরা বন্ধুর কথা বলেননি সেটা জানার। জানা গেল, আব্বাস সিডনিতে ছোট ছেলের কাছে থাকেন। তাঁর বড় ছেলে গুজরাটেই থাকেন। আজকের যুগে স্পেস স্টেশনে থাকা লোকের সঙ্গেও অনায়াসে কথা বলা যায়। সেখানে সিডনি! কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কোনও মিডিয়ায় আব্বাসের কোনও ইন্টারভিউ নেই। গুজরাটে থাকা তাঁর বড় ছেলের কথাও নেই। অনেক খুঁজে একটি মাত্র জায়গা ( এবিপি) পেলাম যাঁরা আব্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
কী বলেছেন আব্বাস? তিনি নরেন্দ্রর ছোট ভাই পঙ্কজের সহপাঠি ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর মোদী পরিবারে তিনি এক বছর ছিলেন। তখনই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। আব্বাসের জন্ম ১৯৫৮ সালে। নরেন্দ্র মোদীর জন্ম ১৯৫০ সালে। ১৭ বছর বয়সে নরেন্দ্র যখন ঘর ছাড়েন তখন আব্বাসের বয়স ৯। তিনি ১৯৭২-৭৪ সাল নাগাদ এক বছর মোদী পরিবারে ছিলেন। তখন নরেন্দ্র কোথায়? দু বছর পর বাড়ি ফিরে ১৭ দিন ছিলেন। তারপর চলে যান আরএসএস স্বয়ংসেবকের কাজে। অর্থাৎ আব্বাসের সঙ্গে নরেন্দ্রর দেখা হয়েছিল কিনা সেটাই সন্দেহ, সেরা বন্ধু হওয়ার তো পরের বিষয়।  
নানা জনের কথা থেকে কয়েকটি জিনিস স্পষ্ট।
১. নরেন্দ্রর বাবার মুসলিম বন্ধু ছিলেন। তিনি আব্বাসের বাবা। 
২. আব্বাসের সহপাঠী ছিলেন নরেন্দ্রর ছোটভাই পঙ্কজ। বন্ধুর বাবার মৃত্যুর পর তিনি বন্ধুকে তাঁদের বাড়িতে এনে রাখার জন্য বাবাকে অনুরোধ করেন।
৩. বিনা দ্বিধায় বন্ধুর ছেলেকে নিজের পরিবারে আশ্রয় দেন নরেন্দ্রর বাবা। 
৪. আব্বাস জানিয়েছেন, ইদের দিন তাঁর জন্য সেয়োই বানাতেন হিরাবেন। অর্থাৎ মোদী পরিবারের উদারতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। 
সেই পরিবারের সন্তান নরেন্দ্র আরএসএস স্বয়ংসেবক, যাঁদের মতে, 'হিন্দু সংস্কৃতিকে মেনে না নিলে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় সারির নাগরিকের মর্যাদা ছাড়া আর কোনও অধিকারই দেওয়া উচিত নয়।' 'জাতীয়তাবাদের প্রধান তিন শত্রু হল-মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্ট।' 'জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি হিটলারের আচরণ যেমন ছিল, ভারতেও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তেমনটাই করা উচিত।' (বাঞ্চ অফ থটস, গোলওয়ালকার)
প্রশ্ন হল, আব্বাসের কথা লিখলেন কেন মোদী? খেয়াল করুন, তখন নূপুর শর্মার মন্তব্যে দুনিয়ার দরবারে খানিকটা চাপে মোদী সরকার। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সেরা বন্ধু মুসলিম, মুখ রক্ষায় এর চেয়ে ভাল রাস্তা আছে? 
আব্বাস বলেছেন, আহমেদাবাদে থাকলেও তিনি কখনও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেননি। কোনও সাহায্যও চাননি। না বলেও শীতল প্রতিক্রিয়ায় অনেক কথাই বলে দিয়েছেন তিনি। 
আব্বাস বলেছেন, তাঁরা সবাই একসঙ্গে দোল, দীপাবলি, ইদ পালন করতেন। তখন সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন আর সেরকম পরিস্থিতি নেই। 
এরপর আর আব্বাসকে নিয়ে হইচই করতে দেওয়া যায়? কে প্রশ্ন তুলবে? মিডিয়া বশংবদ। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে আছে বিরাট নেটওয়ার্ক। আর রাজনৈতিক বিরোধীরা ছন্নছাড়া, জেদ নেই কোনও। তারপরেও কেউ ট্যাঁফো করলে মুখ বন্ধ করার নানা রাস্তা আছে।
মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি হয়ে যায় অবশ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বালাকোট অভিযানের রাতে ঝেঁপে বৃষ্টি নামায় বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধবিমান পাঠাতে দ্বিধা করছিলেন। অভিযান পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি তখন তাঁদের বলেন, ‘আমি বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, মেঘ থাকলে আমরা পাকিস্তানি রেডারের থেকে বাঁচতে পারি।’ তখনও নাকি চিন্তা ছিল। মোদীর বক্তব্য, ‘আমি বললাম, ঠিক আছে। মেঘ থাকুক। ওরা রওনা হল। এই প্রথম এ সব কথা বলছি। জানি না আমাদের অফিসারদের কেমন লাগবে।’
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘মোদী যা বললেন তার অর্থ, আমাদের বায়ুসেনা অপেশাদার এবং অশিক্ষিত। উনি তো বায়ুসেনাকে অপমান করলেন!’ মোদীর কথা মানলে মানতে হয়, নিজেদের অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান— সমস্ত বিসর্জন দিয়ে স্রেফ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযান চালায় বায়ুসেনা। 
একটি চ্যানেল আবার দাবি করে, সে রাতে মেঘের জন্যই বালাকোটের জইশ ঘাঁটি ধ্বংসে ‘ক্রিস্টাল মেজ়’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা যায়নি। এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা পর্যন্ত গোটা পথের ভিডিয়ো পাঠাতে পাঠাতে যায়। সেই ক্ষেপণাস্ত্র কাজে না লাগায় সারা বিশ্বকে বালাকোট অভিযানের অকাট্য প্রমাণ দিতে পারেনি ভারত।
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে অনায়াসে বায়ুসেনাকে অপদার্থ বানিয়ে দিলেন। আর মেঘ যে রেডারের কিছুই করতে পারে না, বিজ্ঞানের এই প্রাথমিক জ্ঞানটাও নেই প্রধানমন্ত্রী সেটাও বুঝিয়ে দিলেন।
মুশকিল হল, তিনি তো শুধু ভক্তদের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি আমারও প্রধানমন্ত্রী। তাই তিনি খেলো হলে আমার ভালো লাগে না, লাগতে পারে না। তিনি যদিও নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন, ‘যে পণ্ডিতেরা মোদীকে গাল পাড়েন, এমন অবস্থায় তাঁদের মাথা কেন কাজ করে না!’
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'সম্ভবত আমিই দেশে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করি। ১৯৮৭-’৮৮ সাল হবে। তখন খুব কম মানুষের ই-মেল ছিল। বীরমগামে আদবানির সভা ছিল। তখন ডিজিটাল ক্যামেরা অনেক বড় হত। আমার কাছে ছিল। আমি ছবি তুলে ই-মেলে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিই। পরের দিন রঙিন ছবি ছাপা হয়। আদবানিজি আশ্চর্য হয়েছিলেন। এক দিনের মধ্যে দিল্লিতে কী ভাবে রঙিন ছবি ছাপা হল?’
তথ্য যদিও বলছে, ভারতে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা বাণিজ্যিক ভাবে বিক্রি হয় ১৯৯১ সালে। আর ইন্টারনেট চালু হয় ১৫ অগাস্ট, ১৯৯৫। তাও তখন শুধু টেক্সট পাঠানো যেত, ছবি নয়।
চোখটা কোন দিকে দেখুন
ধীরে ধীরে একটা ইমেজ তৈরি করা হয়েছে, তৈরি করা হচ্ছে, মোদী জনগণের ত্রাতা। তাই তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়। 
দর্শক মনে কোনও প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে চাইলে আবহ তৈরি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নেতাকেই আমরা মঞ্চে উঠতে দেখেছি, দেখি। দর্শকদের কেউ চিৎকার করে, কেউ সিটি বাজায়, কেউ হাততালি দেয়। কিন্তু মোদী উঠলে? ছন্দে ছন্দে 'মোদী, মোদী, মোদী'।
জনতা কেমন উদ্বেল তাঁদের প্রিয় নেতার জন্য! তাঁদের দিকে হাত নাড়ছে নেতা। করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায় তো। তাই কখনও কাশ্মীরের ডাল লেকে বা কখনও অটল টানেল উদ্বোধন করে নেতা হাত নাড়েন অদৃশ্য দর্শকদের দিকে তাকিয়ে।

অভ্যাস হয়ে যায়। এখন প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারেন ক্যামেরা ঠিক কোথায় রাখা।  

ক্যামেরা কোথায় তিনি জানেন
ক্যামেরা থেকে তাঁকে আড়াল করাটা একদম মানতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী। সে তিনি ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ বা এসপিজি কমান্ডো, যাই হন না কেন! গুজরাটের ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রেও সেই এক কাণ্ড!   
মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। আর কী দরকার! তিনিই সর্ব রোগহর। সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন...আলাদা করে এসব কিছুর আর দরকার কি? তিনি যা চাইবেন, সেটাই নিয়ম, সেটাই আইন, সেটাই গণতন্ত্র। তাই রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান বিনা বাধায় দখল হয়ে যাচ্ছে।
জনতার ত্রাতা মোদী কেমন জনতার স্বার্থে? 
আচমকা লকডাউনে
মনে করে দেখুন, নোটবন্দির ঘোষণা কতক্ষণ আগে হয়? কারা টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরল? টাকার লাইনে দাঁড়িয়ে মরল? আমজনতা। তবু জনতা নেতার ওপর ভরসা রেখেছিল। কালো টাকা, জাল নোট সব ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে। সেটা হল কী? না। হওয়ার কথাও ছিল না। পেটিয়েমের মত সংস্থার বাজার তৈরি করিয়ে দেওয়া আর জনচিত্তে তাঁর লাগাম কতটা তার পরীক্ষা, এই দুটো ছিল লক্ষ্য। 
জনতার হয়রানিতে ত্রাতার যে কিস্যু যায় আসেনি তার প্রমাণ হঠাৎ করে লকডাউনের ঘোষণা। পরিযায়ী শ্রমিকদের হাজার হাজার ছবি দেখিয়ে দিয়েছে নেতার হৃদয়টা!
প্রতি মুহূর্তে বলে যাওয়া হয়, তিনি চা-ওয়ালার ছেলে। যেন ভারতের সব নেতানেত্রীরা সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছেন! তা বেশ। তিনি গরীবের যন্ত্রণা বুঝবেন। 
ওবামার সঙ্গে মোদী
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতে আসছেন। তাই বিশেষ পোশাক বানানো হল তাঁর জন্য। প্রায় ১০ লক্ষ টাকা দামের ‘পিন স্ট্রাইপ উলেন স্যুট’। গাঢ় নীল সেই স্যুটের গায়ে পিন স্ট্রাইপে লেখা, ‘নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী’। সেই স্যুট নিলামে ৪ কোটি ৩১ লক্ষ টাকায় কেনেন সুরাতের এক ব্যবসায়ী। নিলামে বিক্রি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামী স্যুট হিসেবে সেটাই জায়গা করে নিয়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। নেতার চোখ কোন দিকে, কাদের দিকে তা স্পষ্ট। তার আট বছরের রাজত্বে দেশের মানুষের হাল দেখলেই সেটা বোঝা যায়। 
চরম সর্বনাশের রাস্তায় যাচ্ছে দেশ। অথচ পরিকল্পিত প্রচারে আমাদের ভাবানো হচ্ছে, আমরা যাচ্ছি সব পেয়েছির দেশে। ভোটের অংকে, ক্ষমতার স্বপ্নে বুঁদ দেশের সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলো এই জন্ডিসের কথা না বলে দিব্যি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই নামক তেলেভাজা খাওয়ার কথাই বলে যাচ্ছেন। 
শেষ করার আগে, আরও একবার বলছি, আদর্শগত অবস্থানের জন্যই আরএসএস-বিজেপি-গৈরিক বাহিনী ভয় পায় শুধু কমিউনিস্টদের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad