![]() |
| অর্পিতা মুখার্জি |
পকেট থেকে টিকিটটা বের করে দিলাম।
-কপালে বিশ্বাস করতাম না। আজ থেকে করব।
-মানে?
-না, কোনওদিন টিকিট কাটি না। আজ কী হল কাটলাম। আজই আপনি! তাও সন্ধ্যার পর।
আমার কথা শুনে চেকারও হেসে ফেললেন।
তখন ট্রেনের ভাড়া ছিল বোধহয় ১০ টাকা, আমাদের কাছে বিশাল টাকা। অতএব বিনা টিকিটের যাত্রী।
কলেজ স্ট্রিটে কী একটা কর্মসূচি থেকে ফিরছি। তখন দক্ষিণ আর উত্তর শাখা জোড়া ছিল না। দক্ষিণ শাখায় ঢোকার গেটের পাশে নার্সারি ছিল। তার পাশে একটা গলতা, আমাদের মতো ডব্লিউ টি দের জন্য। আমরা ৮ জন ছিলাম। জোড়ায় জোড়ায় গল্প করতে করতে ঢুকছিলাম। আমি ছিলাম শেষ জুটিতে। হঠাৎ কে একটা খপাত করে হাতটা ধরল।
-টিকিট।
-নেই।
-চলুন।
চেকার নিয়ে গেলেন ঘুপচি ঘরে। তন্নতন্ন করে আমাদের তল্লাশি করলেন। দুজনের যাদবপুর থেকে গড়িয়া যাওয়ার বাস ভাড়াটুকু ছিল। আমরা কী করি, কেন টাকা নেই, শুনলেন। তারপর নিজেই দুটো টিকিট কেটে হাতে ধরিয়ে দিলেন।
-পারলে টিকিট কেটে ট্রেনে চড়বে।
টিকিট না কাটা তো দুর্নীতি। কারণে বা অকারণে দুর্নীতি আমাদের জীবনজুড়ে।
টালিগঞ্জে ২১ কোটি ৯০ লক্ষ, বেলঘরিয়ায় ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ। সঙ্গে সোনা, সোনার পেন, সোনার বিস্কুট। সারা রাত ধরে গণনা। মিডিয়ায় টানটান সম্প্রচার...কেউ টানা ১৪০ ঘণ্টা তো কেউ টানা ১৬০ ঘণ্টা।
কোটি কোটি টাকা। সঙ্গে নারীসঙ্গ। এক না একাধিক? এক্কেরে রগরগে ব্যাপার। সেক্স টয়ও নাকি উদ্ধার হয়েছে। পাগলা খাবি কী, ঝাঁঝে মরে যাবি!
![]() |
| অর্পিতার বেলঘরিয়ার বাড়িতে তল্লাশি |
ফুল মস্তি। রকমারি কমেন্ট, রকমারি মিম। সোশ্যাল মিডিয়ায় দমদার সব কাণ্ডকারখানা!
আমাদের রাজ্যে কখনও এত বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার হয়নি। আগে একবার হয়েছে হাওড়ার ঘুসুড়িতে সেই ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি থেকে। দেওয়ালে, মেঝেতে, বক্স খাটে, কমোডের ফ্লাশে, বিছানার গদির তলায়, আলমারিতে পাওয়া গেছে ২৪ কোটির বেশি টাকা, ৫৮ লক্ষ টাকার ডাকঘরের ফিক্সড ডিপোজিট, প্রায় ১৪ লক্ষ টাকার সোনা-হিরের গয়না। স্থানীয় কিছু সিপিএম নেতার নাম উঠেছিল। রাজ্যের দুর্নীতি দমন শাখার সেই তদন্তের হাল এখন কি? কেউ জানে না।
২০১৫ সালের ঘটনায় একটু শিরশিরানি হয়েছিল। এবার কম্পন। হবেই তো। অপারেশন চলতে চলতেই ছবি, ভিডিও টুইট করে দিচ্ছে ইডি। রাতভর টাকা গোণা (হাওড়ায় টাকা গুণতে লেগেছিল ২৪ ঘণ্টার বেশি)। স্ক্রিপ্ট ঠিকঠাক হলেই ঠিকঠাক আবেগ তৈরি করা যায়। আর ঠিকঠাক আবেগ তৈরি করা গেলে রাজনীতির ফুল ফয়দা।
দুটো বাড়ি থেকে নগদ ৫০ কোটি টাকা উদ্ধার। তারসঙ্গে আরও কত সম্পত্তি! পিংলার স্কুলের জমিই কেনা হয় ৪৫ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে ১০০ কোটি টাকার বেশি টাকা খরচ হয়েছে। বোলপুর-বানতলা-এ ধার-ও ধার-সে ধার আরও কত জমি-সম্পত্তি।
খেয়াল করে দেখুন, সে সবের দর অনেক বেশি হলেও তেমন শিহরিত হচ্ছি না আমরা। সে সব নিয়ে খিল্লিতে মাতছি না।
কেন্দ্রের তথ্য বলছে, মোদী সরকার আসার পর বিদেশী মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন (FEMA) এবং বেআইনি অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত (PMLA) অভিযোগে ইডি-র সক্রিয়তা পাঁচ গুণ বেড়েছে। ২০১৪-১৫ সালে FEMA আইনে মামলা হয় ৯১৫টি, ২০১৮-১৯ সালে ২,৬৫৯ এবং ২০২১-২২ সালে ৫,৩১৩। PMLA-তে মামলা ২০১৪-১৫ সালে ছিল ১৭৮, ২০১৮-১৯ সালে ১৯৫ এবং ২০২১-২২ সালে হয়েছে ১,১৮০। অর্থাৎ দ্বিতীয় মোদী সরকারের সময়ে এই প্রবণতা বেড়েছে। মোট মামলার সংখ্যা ২০১৪-১৫ সালে ছিল ১,০৯৩, ২০২১-২২ সালে তা হয়েছে ৫,৪৯৩। মার্চ, ২০২২ পর্যন্ত PMLA-তে ৫,৪২২টি মামলায় প্রায় ১,০৪,৭০২ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি। PMLA মামলাতেই অভিযুক্ত পার্থ-অর্পিতা।
![]() |
| গয়না কেনা। |
অর্থাৎ ইডি মাঝেমাধ্যেই বিপুল টাকা উদ্ধার করে। কিন্তু এরকম গরমাগরম কভারেজ তো হয় না। আমাদের রাজ্যে তরঙ্গটা বেশি উঠছে, কারণ আমরা এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নই। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘৃণার বদলে তা নিয়ে মজাটাই বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
আমাদের রাজ্যে যে আলপিন টু এলিফেন্ট ঘুষ-তোলাবাজি- কাটমানি-সিন্ডিকেটের খেলা চলছে, কে না জানি? কারণে অকারণে জরিমানা। প্রত্যেকের চোখের সামনেই তো সেটা হচ্ছে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে। বিশেষত গ্রামে, মফসসলে। সেখানকার মানুষ তো এটাকেই ভবিতব্য ধরে নিয়েছেন। সরকারি প্রকল্পে ১০ হাজার মধ্যে পার্টির দাদারা নিচ্ছে ৮ হাজার। ২ হাজার তো পেলাম! তা-ও তো পেলাম! তাতেই শান্তি! ঠিক কিনা বলুন?
শিক্ষক নিয়োগে বিপুল পরিমাণ টাকার খেলা চলছে সেটা জানতাম না আমরা কেউ? হঠাৎ জানলাম?
আমরা ধরেই নিয়েছি, দুর্নীতি আমাদের জীবনের অঙ্গ। কিস্যু করার নেই। চোখের সামনে পঞ্চায়েত থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত শাসক দলের নেতারা নানা রকম দুর্নীতির কারবারে জড়িত।
![]() |
| বগটুই গণহত্যা |
এই যে কয়েক মাস আগে বগটুইয়ে গণহত্যা হল, কিসের জন্য? বখরার গোলমাল। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নিহত ভাদু শেখের মুরগির ব্যবসা ছিল। ছোট গাড়ি, পুলিশের গাড়ি চালাতেন। তারপর গাড়ির ব্যবসা। ২০১৮ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে বড়শাল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হওয়ার পর থেকেই ভাদুর উল্কা গতির উত্থান। বগটুই গ্রামে একতলা বাড়ি। আর বগটুই মোড়ে রাস্তার ধারে মার্বেল বসানো ঝাঁ চকচকে তিন তলা রাজপ্রাসাদ। এসি, আধুনিক সব গ্যাজেটস...।
ভাদু খুনে গ্রেফতার হওয়া রামপুরহাট-১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি আনারুল হোসেন এক সময় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। এখন রামপুরহাট লাগোয়া সন্ধিপুর ঝাঁ চকচকে দোতলা বাড়ি। সামনে বাঁধানো লন। ভিতরে মোজাইক। আছে এসি-সহ অন্যান্য আধুনিক গ্যাজেটসও।
![]() |
| অনুব্রত ও তাঁর গয়না |
বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ছিল মাছের ব্যবসা। এখন? প্রতি বছর বোলপুরে তৃণমূল দফতরে কালী পুজোয় প্রতিমাকে সোনার গয়নায় সাজান তিনি। প্রথম বছর ১৮০ ভরি। তারপর ২৬০। তারপর ৩৫০। গত বছর ৫২০ ভরি সোনার গয়না পড়ানো হয়, যায় বাজারদর প্রায় ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা।
সব আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। আমরা সবাই চুপ করে থাকি। আমাদের সেই রাগ, সেই হতাশা ফেটে বেরোচ্ছে এই টাকা উদ্ধারের খিল্লিতে। সব হুজুগে ব্যাপার। হুজুগে রাজনীতি। হুজুগে পাবলিক।
![]() |
| পুজো উদ্বোধনে মমতা। মঞ্চে পার্থ, অর্পিতা |
![]() |
| মমতা-অভিষেক-পার্থ |
পার্থ চ্যাটার্জিকে সরকার ও দল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এখন চলছে মুখরক্ষার চেষ্টা। কথাটা হল, এই চেষ্টা সফল হবে কিনা! সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে আমাদের মত পাবলিকের ওপর।
আমাদের মতো কিছু পাবলিকই শিক্ষকতার চাকরি না পেয়ে কলকাতায় বিক্ষোভে বসেন। নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ, কর্মশিক্ষা-শারীরশিক্ষার শিক্ষকপদের চাকরিপ্রার্থীরা। কয়েকজনকে চাকরি দিয়ে প্রথম দফা সামাল দিয়েছিল সরকার। আবার ধর্না অন্য একদলের। তার ধাক্কাতেই এবার পাথর একটু হলেও নড়েছে। এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সেই ক্ষীর খেতে নামছে।
মুখ্যমন্ত্রী আগে দেখা করেছেন। ফোনে কথা বলেছেন। কিন্তু এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের সমস্যা মেটেনি।আচমকা তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। সেই খবর পেয়ে অভিষেকের দফতরের সামনে হাজির হলেন প্রাথমিক টেট উত্তীর্ণরা। তাঁরা অভিষেককে তাঁদের যন্ত্রণার কথা বলতে চান। কিন্তু দেখা করেননি তৃণমূলের নম্বর টু। রাতভর ফুটপাথে বসেছিলেন চাকরিপ্রার্থীরা। সকালে পুলিশ তাঁদের টেনেহিঁচড়ে তুলে প্রিজন ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়।
![]() |
| সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার কুণাল ঘোষ |
সেই ২০১৩ সাল থেকে বারবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সব ক্ষেত্রেই তৃণমূল নেতাদের নাম জড়াচ্ছে। সারদা ও চিটফান্ড কেলেঙ্কারির পর মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘কুণাল চোর? মদন চোর? টুম্পাই চোর? মুকুল চোর? আমি চোর?’ কী আশ্চর্য! দেখা গেল প্রথমে দলের সাংসদ কুণালকেই গ্রেফতার করল মমতার পুলিশ। তারপর মদন মিত্র আর সৃঞ্জয় বসু (টুম্পাই)-কে ধরল সিবিআই। বিজেপি নেতা বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ স্লোগান তুললেন, 'ভাগ মুকুল ভাগ!' মুকুল ভেগে চলে গেলেন বিজেপিতে। বললেন, 'বড় রকমের ষড়যন্ত্র হয়েছে, এর পিছনে আছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।' কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, ‘সারদা মিডিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যদি কেউ সবথেকে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ কুণাল বলেছিলেন, 'চিটফান্ডের দয়ায় যারা ক্ষমতায় এসেছেন- মুখ্যমন্ত্রী, ৮ সাংসদ, ৬ মন্ত্রী সরাসরি দোষী।'
এখন মুকুল, কুণাল দুজনই মমতার দলে।
(পড়ুন: কী বলেছিলেন কুণাল?
![]() |
| তৃণমূলে ফিরলেন মুকুল রায় |
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ২০১৩ সালের ১ বৈশাখের আগে তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু সিবিআই-কে পাঠানো চিঠিতে মমতার হাতে থাকা রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরই জানিয়েছিল, সারদার বেআইনি কাজকর্ম সম্পর্কে রাজ্যের অর্থ দফতর আগে থেকেই জানত।
(পড়ুন: জানাই ছিল সারদা, মানল মমতা-সরকার)
![]() |
| চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তরা |
পুরনো কাসুন্দি ঘাটছি পরিণতি কী হয়েছিল সেটা বুঝতে। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, আহমেদ হাসান ইমরান, তাপস পাল, শতাব্দী রায় সহ একগাদা তৃণমূল সাংসদ-নেতার নাম জড়ায় চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে।
শুধু সারদা-রোজ ভ্যালি মিলিয়েই ২২ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি (এখন ২২ কোটি উদ্ধার হওয়াতেই কী তুমুল হইচই!) আজকের অর্পিতা মুখার্জির মতো তখন ছিলেন দেবযানী মুখার্জি। তখনও এরকম রগরগে খিল্লি হয়েছিল বিস্তর।
তখন মূল বিরোধী সিপিএম এখনকার মতোই চোর ধরো বলে হইচই জুড়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, মমতা শেষ। মমতার সরকারের বিদায় নিশ্চিত।
কয়েক মাস তোলপাড়। তারপর? ফুসসসস...।
নথিপত্র ভ্যানিশ সারদার অফিস থেকে। নথি ভরা আলমারি হাপিস রাইটার্স থেকে।
অত হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি নাড়িয়ে দেয় রাজ্য অর্থনীতির ভিতও। তবু রাজ্য রাজনীতিতে তার কোনও প্রভাব পড়েনি।
![]() |
ধারণা রাজনীতিতে বড় ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন স্টিফেন কোর্ট কিনে নিয়েছেন বলে এক সময় কমিউনিস্ট পার্টি রটিয়েছিল। আবার আরএসপি যতীন চক্রবর্তী খুব চুরি করেছেন বলেও বলা হত। মৃত্যুর পর জানা যায়, কী আর্থিক পরিস্থিতে দুজন ছিলেন।
একটা কথা এখন খুব বলা হয়, সব দুর্নীতির আসল মাথা পিসি আর ভাইপো। বছরের পর বছর বলেও মমতা দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে সেটা বিশ্বাস করানো যায়নি।
কয়লা আর গরু পাচার মামলায় নাম জড়িয়েছে অভিষেক ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রীর। সিবিআই যে চার্জশিট দিয়েছে তাতে ৪১ জনের নাম থাকলেও ওই দুজনের নেই। নাম আছে বিনয় মিশ্রর। তিনিই নাকি কিংপিন।
![]() |
| দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতু |
২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিনয়কে যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক করেছিলেন অভিষেক। অঙ্কের গৃহশিক্ষক বিনয় ততদিনে বিপুল সম্পত্তির মালিক। বিনয়কে এক্স ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিত রাজ্য সরকার। কলকাতার চেতলা, রাসবিহারী আর কালীঘাট মন্দির লাগোয়া বিনয়ের তিনটি বাড়ি ও অফিস। সিবিআই সেখানে তল্লাশি চালাতে গেলে খোঁজ নিতে পৌঁছে যায় কলকাতা পুলিশও।
বিনয় এখন অস্ট্রেলিয়া ও ফিজির মাঝামাঝি দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুর নাগরিক। ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়তে পাসপোর্টও জমা দিয়েছেন দুবাইয়ের দূতাবাসে। তারও পরে দেশ ছাড়েন বিনয়ের বাবা মা। অভিষেককে বিনয় টাকা পৌঁছে দিতেন বলে অভিযোগ করে বিজেপি। কিন্তু সিবিআই তদন্ত শুরুর কয়েক মাস পরে কিভাবে বিনয় পালিয়ে অন্য দেশের নাগরিক হয়ে গেলেন? তাঁর মা বাবাই বা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারলেন কী ভাবে?
![]() |
| সিবিআই দফতরে রুজিরা |
বিনয় মিশ্রের আইনজীবী কে? তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে জিতে রাজ্যসভায় যাওয়া কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি, যিনি তৃণমূলের হয়েও নিয়মিত মামলা লড়েন।
অভিষেক বলেছিলেন, 'যুব তৃণমূলের ১৫ জন সম্পাদকের একজন বিনয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।' পার্থ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ তো দূরের কথা, চার্জশিটই জমা পড়েনি। তাঁকে সাততাড়াতাড়ি পার্টি থেকে বের করে দিলেন কেন? বিনয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও অভিষেকের ঘুম ভাঙে না।
অভিষেক বলেছিলেন, 'মুকুল রায় তো বিজেপি-র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে সারদা-মালিক নিজে লিখিত ভাবে অন্তত ছ’কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন। নারদ ভিডিয়োতে মুকুলবাবু বলছেন, কোথায় কার কাছে টাকা দিতে হবে। শুভেন্দু অধিকারী, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের মতো নেতাদের নারদ কাণ্ডে সরাসরি টাকা নিতে দেখা গিয়েছে। কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হল? হল না কেন? তাঁরা বিজেপিতে নাম লিখিয়ে ধোয়া তুলসিপাতা হলেন?'
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেছিলেন, ‘রাজ্যে গরু, কয়লা, বালি পাচারে অভিযুক্ত তৃণমূলের একাংশ। বিনয় মিশ্রের মাধ্যমে সেই টাকা ভাইপোর বাড়িতে গিয়েছে।’
![]() |
| ২১ জুলাই, ২০২২। ধর্মতলায় সমাবেশে বলছেন অভিষেক |
অভিষেক আবার এখন বলছেন, তাঁর কাছে এমন অডিও টেপ আছে, যা প্রকাশ্যে এলে গরু ও কয়লা-কাণ্ডে কারা জড়িত, সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। যখন সময় আসবে, ঠিক তখনই সেই টেপ প্রকাশ্যে আনবেন।
এখনই আনতে অসুবিধা কি?
বামেরা যখন ক্ষমতায় তখনও কয়লার বেআইনি কারবার ছিল, অবৈধ খাদান ছিল। শাসক নেতারা জানতেন না? কয়লার কালি লাগেনি তাঁদের গায়ে? আসানসোল রানীগঞ্জ শিল্পাঞ্চল কার্যত শূন্যে ভাসছে। তা নিয়ে সরব সংসদ প্রয়াত হারাধন রায় কেন একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন?
এই হচ্ছে দুর্নীতি সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান। তাঁদের একটাই অঙ্ক, ক্ষমতা। আর ক্ষমতা মানে করে খাওয়া। কথায় সৎ নন যাঁরা, তাঁরা কি ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন? ওসব লোক খেপানোর ধান্দা। তাই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের বদলে 'চোর ধরো, জেল ভরো' স্লোগানেই তাঁদের টান বেশি। তাতে আখেরে আম পাবলিকের কোনও লাভ নেই। তর্ক লাগলেই বলেন, ওরা তো করেছে। মানে ওরা চুরি করলে আমরাও করতে পারি। মিডিয়াও দেখবেন, কোনও ঘটনা ঘটলে বোঝানোর চেষ্টা করলে ভোটের রাজনীতির লাভ-ক্ষতির অঙ্ক। কিন্তু সেটাই তো জীবন নয়।
সবাই সব জানতাম। কিস্যু হয়নি।
আসলে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর উপর বড্ড নির্ভর করতে ভালবাসি। তারা তো ভোটের অঙ্ক ছাড়া কিছুই বোঝে না। অথচ কাজের কাজটা পাবলিকই করে।
সেবারও সাধারণ জনতা নড়াচড়া করতেই অত বড় কেলেঙ্কারি সামনে এসেছিল। এবারও তাই। তবু আমরা পার্টি ছাড়া ভাবতে পারি না। সেই সুযোগ কাজে লাগান রাজনীতিকরা।
ইদানিং একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে। কোর্ট-ইডি-সিবিআই নির্ভর রাজনীতি। তার সঙ্গে কয়েকটা মিছিল, মিডিয়ায় নেতার বাইট। তাতে যে কিছু হয় না চিটফান্ড কাণ্ড তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সেবার সিবিআই তদন্ত হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে। কী হয়েছিল তাতে?
পাবলিকের মতো আমাদের রাজ্যের রাজনীতিও টি-২০। খিল্লি-মিম-কয়েকটা মিছিল। খেল খতম, পয়সা হজম। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, টি-২০ ক্রমশ ওয়ান ডে ক্রিকেটকে হটিয়ে দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট শেষ হচ্ছে না। বরং আকর্ষণ বাড়ছে। সমাজ বা রাজনীতিতেও তাই।
খুব ভাল করে ভেবে দেখুন। যাঁদের আন্দোলনের হাত ধরে এই কাণ্ডের শুরু, তাঁরা কিন্তু দুর্নীতির বিরোধিতা করতে বসেননি। তাঁরা যোগ্য, তবু চাকরি পাচ্ছেন না। তাই ধর্না। শুরুতে যাঁরা ধর্নায় বসেছিলেন সরকার তাঁদের চাকরি দিয়ে আন্দোলন ভেঙে দিয়েছিল। তারপর আসেন অন্যরা। খেয়াল করে দেখুন, সরকার অতিরিক্ত ৫ হাজার পদ তৈরি করেছে। যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁদের চাকরি দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা। আবার টাকা দিয়ে যাঁদের চাকরি হয়েছে তাঁদেরও যাবে না। কিন্তু এবার মেজাজটা অন্য। অভিষেক একদলকে ডেকে কথা বলেছেন। তাঁর অফিসের সামনে বসে পড়েছেন অন্য একদল। প্রাথমিক টেট-পাশ চাকরিপ্রার্থীরা।
যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া অধিকার। দুর্নীতি সেই অধিকারটা কেড়ে নিচ্ছে। লাখ লাখ সরকারি পদ ফাঁকা। হাজার হাজার শিক্ষক পদ ফাঁকা। ভুগছে ছাত্রছাত্রীরা। যেখানে যতটুকু নিয়োগ, সেখানেই টাকার খেলা। সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে শুরু করে হরেকরকম অস্থায়ী কাজ। তাতেও টাকা। ১০০ দিনের কাজের মজুরি বা সরকারি কোনও প্রকল্পের টাকা? সেখানেও চুরি।
![]() |
| গলসিতে জমি উদ্ধারে কৃষক সভা |
রাস্তা? অধিকারের লড়াই। কদিন আগে দেখলাম, গলসিতে জোর করে নেওয়া জমির অধিকার ফেরাতে কৃষকরা আন্দোলনে নেমেছেন। ওটাই রাস্তা।
(পড়ুন: গলসিতে জমি ফেরতের লড়াই)
স্কুল কলেজে ঠিক মতো লেখাপড়ার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। কাজের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। মন খুলে কথা বলার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। পার্টিগুলোর মতো লোকদেখানো ভোটসর্বস্ব রাজনীতি নয়। জীবন মানে তো ভোটের অঙ্ক নয়, জীবন মানে অধিকারের হিসেব নিকেশ।
এলাকায় এলাকায় ৫-১০-১৫ জন মিলে। সেক্ষেত্রে বাম মনোভাবের মানুষের বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া দরকার (বাম বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলছি না)। কথায় বলে, মানুষ যেমন হবে, সে শাসকও তেমনই পাবে।
ঈশ্বরচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্র, সূর্য সেন, মাতঙ্গীনি হাজরাদের মতো একরোখা মানুষেরা আমাদের পূর্বপুরুষ। একরোখা মেজাজটা চাই। রাজ্যের জন্য গর্ব বোধটা চাই। রাজ্যের মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে মস্করা করলে তো রাজ্যের মাথাই হেঁট হয়।
![]() |
ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তুমি গেছ, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে।এখন কি আমাদের রাজ্যটা ভীতুতে ভরেছে?
অভিজ্ঞতায় দেখেছি গুন্ডাদের সাহস থাকে না। তর্জন গর্জনই সার। কাগুজে বাঘই নিজেকে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলে দাবি করে বা ছাতির মাপ দিয়ে বেড়ায়।

























