link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

Kolkata Murder ভবানীপুরে জোড়া খুন, রোদ্দুর রায়ের গ্রেফতারি এবং একটি অনিবার্য পতনের গল্প

আদিবাসী মহিলাদের সঙ্গে নাচছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ঠিক পাশের দুজনের হাতে গ্লভস 

ভবানীপুরে হরিশ মুখার্জি রোডে জোড়া খুন। খবরটা এল সোমবার সন্ধ্যার পর।

মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর খবর এল, গোয়ায় গ্রেফতার ইউটিউবার রোদ্দুর রায় (Roddur Roy arrest)।

কাকতালীয়? আমি মানতে নারাজ। আমার মনে হয়, মমতা ব্যানার্জির রাজনীতিকে যাঁরা বোঝার চেষ্টা করেন, তাঁরা আমার সঙ্গে সহমত হবেন।

আলোচনাটা ঘুরিয়ে দিতে হবে। ভবানীপুরের জোড়া খুন (Bhabanipur double murder) থেকে চোখ ঘোরাতে হবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে বোঝা যাবে, মানুষের মন কতটা ভাল বোঝেন মমতা। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রোদ্দুরকে নিয়ে কথাবার্তায়।

দেখুন, আমার সোজা কথা, রোদ্দুরকে নিয়ে এত হইচই অর্থহীন। অনেকে বাক স্বাধীনতার কথা বলছেন। কথা বলার স্বাধীনতা আছে বলে, যা খুশি তা-ই বলে দেওয়া যায়? স্ট্যান্ড আপ কমেডি, স্যাটায়ার... প্রতিবাদের এইসব ধরণের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। সেখানেও তো মজার ছলে কড়া কথা থাকে। রোদ্দূরের খিস্তিখামারি ভরা ভাঁড়ামো আসলে ইউটিউব ভিউয়ার বাড়ানোর কৌশল। তাতে ওঁর আয় বাড়বে। আমার মা-মাসিকে নিয়ে খিস্তি করলে মেনে নেওয়ার মতো মহত্ আমি নই। আমার মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে খিস্তিখামারিও মানতে নারাজ। 

রোদ্দুর রায়
বাস্তবে এই রাজ্যে সাম্প্রতিক অতীতে ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর ভয়াবহ আক্রমণ হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র বা বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরীর ক্ষেত্রে। একটা কার্টুন ইমেলে শেয়ার করেছিলেন বলে অধ্যাপককে জেলে ভরা হয়েছিল। সারের দাম নিয়ে কথা বলায় 'মাওবাদী' আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল শিলাদিত্যকে। তখন হইচই হয়েছিল। শহুরে অধ্যাপক বাম রাজনীতিতে সক্রিয়, তাই অম্বিকেশ মহাপাত্রের কথা শোনা যায় মাঝেমাঝে। কিন্তু কোথায়, কেমন আছেন শিলাদিত্য চৌধুরী? খবর নেই। একরমই 'প্রতিবাদী' আমরা।

ভবানীপুরে হরিশ মুখার্জি রোডে এই বাড়িতে জোড়া খুন
আমার মতে, ভবানীপুরের জোড়া খুন ভয়ঙ্কর বার্তা দিচ্ছে। কেন?  

ভবানীপুরে খুনটা কোথায় হল? শাসক দলের নম্বর ওয়ান মমতা ব্যানার্জির বাড়ির দূরত্ব আটশো মিটার মতো। আর নম্বর টু অভিষেক ব্যানার্জির (abhisek banerjee) বাড়ি তিন-সাড়ে তিনশো মিটার। মানে হাই সিকিওরিটি জোন। কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় মোড়া হাই সিকিওরিটি জোন। 

ওই এলাকার কাউন্সিলর মুখ্যমন্ত্রীর বৌদি, অভিষেকের কাকিমা কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই এলাকার এমএলএ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। ওই এলাকার এমপি মালা রায়ও খুব একটা দূরে থাকেন না। ভবানীপুর এবং কালীঘাট---দু-দুটো থানাও খুব বেশি দূরে নয়।     

খুন দুটো কখন হল? ভরদুপুরে। কী ভাবে খুন করা হল? গুলি করে এবং কুপিয়ে।

কয়েক বছর ধরেই কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যখন-তখন যে কোনও কারণে গুলি চলছে। অনেকটাই যেন গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। গুলিতে বেমক্কা কোনও সাধারণ মানুষ মারা গেলে হয়তো আমরা ভয় পাব। কিন্তু ভবানীপুরে হাই সিকিওরিটি জোনে ঢুকে গুলি করে খুনের পর চম্পট! এই লেখার সময় পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

ভবানীপুরের জোড়া খুন সুনির্দিষ্ট বার্তা দিল। 

বেপরোয়া দুষ্কৃতীরাজ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। 

এর অনিবার্য পরিণতি, সরকার বদল। ভবানীপুরের জোড়া খুনের সুনির্দিষ্ট বার্তা, মমতা ব্যানার্জি সরকারের পতন অনিবার্য। 

ভবানীপুরের জোড়া খুনের খবরটা জানা মাত্র চোখের সামনে একটা ঘটনা ভেসে উঠল। 

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ। ২০১১
ঘটনাটা ২০১১-র ৬ নভেম্বরের।

মাস ছয় আগে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন মমতা ব্যানার্জি। রাইটার্স তখনও সেটাই ছিল রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দফতর) বাড়ি ফেরেন মুখ্যমন্ত্রী। রাতে বাড়ি থেকে হেঁটেই চলে যান ভবানীপুর থানায়। কেন? (CM mamta ransacked Bhabanipur PS)

সেবক সঙ্ঘের ছেলেরা জগদ্ধাত্রী প্রতিমা ভাসান দিতে যাচ্ছিলেন। চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের সামনের রাস্তা আটকে তুমুল শব্দে ডিজে বাজিয়ে, বাজি ফাটিয়ে নাচ চলছিল। রাস্তা আটকে যাওয়ায় পুলিস তাদের শোভাযাত্রা এগিয়ে নিয়ে যেতে বলে। হাসপাতালের সামনে শব্দ বন্ধ করতেও বলে। তারপরেই পুলিসের দিকে ইট-পাথর। ভাবনীপুর থানা ভাঙচুর। হামলার অভিযোগে পুলিস শম্ভু সাউ ও তাপস সাহা নামে দু’জনকে আটক করে। 

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই শোভাযাত্রায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই বাবুন ব্যানার্জিও।  

সেবক সংঘের শুভজিৎ গুণ সাংবাদিককে বলেছিলেন, 'আমাদের বাজি ফাটাতে আর জোরে গান চালাতে নিষেধ করায় আমরা পুলিসকে আমাদের ক্লাবের ব্যানারে লেখা ঠিকানাটা দেখতে বললাম। আমাদের ক্লাবটা দিদির বাড়ির ঠিক পাশেই। কিন্তু পুলিস অফিসার দুর্ব্যবহার শুরু করল। আমরা আর রাগ সামলাতে পারিনি।’

৬ নভেম্বর, ২০১১। ভবানীপুর থানায় ভাঙচুর
তারপর?

শুভজিতের কথায়, 'রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মমতা ব্যানার্জির বাড়িতে গিয়ে অভিযোগ করি। দিদি একটুও সময় নষ্ট করেননি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি থানায় গিয়ে আমাদের ভাইদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন।’ 

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী, আটক হওয়া শম্ভু সাউ বলেন, 'পুলিস আমাদের লকআপে ঢুকিয়ে মারতে শুরু করে। আমরা তৃণমূল করি। আমাদের দলের নেতা নির্মল মাঝি, দুলাল সেন, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম থানায় এসে বললেও পুলিস ছাড়েনি। দিদি থানায় আসায় পুলিস নড়েচড়ে বসে। দিদি আমাদের কাছে ভগবান।' 

আরেক ধৃত তাপস সাহা মমতা ব্যানার্জির কালীঘাটের পার্টি অফিসে বসতেন। রেলে চাকরিও পেয়েছিলেন।’

৭৩ ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রতন মালাকার। তাঁর ওয়ার্ডেই ওই ক্লাব। তিনি বলেন, 'আমরা বলায় কাজ হয়নি। তারপর দিদি আসে।'

৬ নভেম্বর, ২০১১। ভবানীপুর থানায় মুখ্যমন্ত্রী
থানায় সিপি রঞ্জিত পচনন্দা, ডিসিপি দক্ষিণ ডি পি সিং, থানার ওসি ইন্দ্রজিৎ ঘোষ দস্তিদারকে তুমুল ধমকান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশেই এসিপি (দক্ষিণ) তাপস বসু বিভাগীয় তদন্ত করে রিপোর্টে থানার ওসি-কে দায়ী করে লেখেন, পুলিস সেদিন জোর করে মাইক বন্ধ করতে গিয়েছিল। বুঝিয়ে শুনিয়ে কথা বলে কাজ করেনি। জনতার সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেছিল।
 
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কলকাতার সে সময়ের সিপি রঞ্জিত পচনন্দা
১১ বছর আগের ঘটনাটা সবারই জানা। তবু খানিকটা বিস্তারিত লিখলাম, কারণ ওই একটা ঘটনায় পরবর্তী সময়ে ঘটা সব ঘটনার ছাপ আছে।

কিছু ঘটনা মনে করাই। 

ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ এক নেতার বাহিনী আলিপুর থানায় হামলা চালায়। প্রাণ বাঁচাতে পুলিশ টেবিলের নিচে ঢুকে পরে।

আইপিএস রঞ্জিত পচনন্দা
গার্ডেনরিচের কলেজে ফিরহাদ ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলরের বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরী। তার কিছুক্ষণ পরেই মেদিনীপুরে নচিকেতার সঙ্গে গলা মেলাতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। ওই কাউন্সিলরের কোনও শাস্তি হয়নি। নিহত অফিসারের মেয়েকে চাকরি দিয়ে ম্যানেজ করেন মুখ্যমন্ত্রী। মন্ত্রীর কথা শুনে এক কংগ্রেস নেতাকে ফাঁসাতে রাজি না হওয়ায় সরিয়ে দেওয়া হয় সিপি পচনন্দাকে। 

মমতার দুই ভাইপো অভিষেক ও আকাশ ব্যানার্জি
মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো আকাশ ব্যানার্জি অন ডিউটি ট্রাফিক অফিসারকে চড় মারায় গ্রেফতার হন। কিন্তু দু'দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে যান (mamta nephew arrested)।

এরকম আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ অনেকেই আমার চেয়ে অনেক ভাল করতে পারবেন। মমতা সরকারের প্রথম দিকের কিছু ঘটনা লিখলাম, কী ভাবে পুলিশকে গ্রাস করে নেওয়া হল সেটা বোঝাতে। 

পার্টির কথায় পুলিশ চলে, পার্টির প্রয়োজনে পুলিশ অফিসারের পোস্টিং হয়, এটা নতুন কথা নয়। মমতা ব্যানার্জির সরকারের আমলে অন্য একটা প্রবণতা তৈরি হল। পার্টি আর পুলিশ মিশে গেল। আবার বলছি, পার্টি আর পুলিশ মিশে গেল। 

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আইপিএস রাজীব কুমার
সারদা দুর্নীতির নথিপত্র গায়েব হয়ে গেল। কাজে লাগানো হল একসময় মমতা ব্যানার্জির বিষনজরে থাকা অত্যন্ত দক্ষতাসম্পন্ন, মেধাবী, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সাবলীল এক আইপিএস-কে। পরে সিবিআই সেই আইপিএস-এর বাড়িতে যেতেই বেশ কয়েকজন আইপিএস-কে সঙ্গে নিয়ে ধর্নায় বসে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। পার্টি আর পুলিশ, মেড ফর ইচ আদার। 

মুখ্যমন্ত্রীর রাতভর ধর্নায় একাধিক আইপিএস
থানায় থানায় তৃণমূলের কর্মীদের সিভিক পুলিশ (এখন বলে সিভিক ভলান্টিয়ার) হিসেবে নিয়োগ করা হল। সংখ্যাটা প্রায় ৬০ হাজার। পুলিশের মূল বাহিনী এখন তারাই।

পার্টি নেতাদের কথায় পুলিশ চলতে চলতে কোথায় পৌঁছেছে তার টাটকা উদাহরণ বগটুই গণহত্যা (bogtui mass killing)। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখের খুনের পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি তৃণমূলের নেতা ব্লক সভাপতির নির্দেশে। বললেন কে? স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, যিনি আবার পুলিশমন্ত্রীও। বাড়িগুলো তখনও জ্বলছে। মানুষ জ্যান্ত পুড়ছে। এসপি, এএসপি, এসডিপিও, আইসি বগটুই মোড়ে গেলেও ঘটনাস্থলে যাননি। তারাপীঠে গিয়ে মিটিং করেছেন। পরে ডিএম-এসপি-দের সঙ্গে মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, সেদিন পুলিশ সময়মতো পদক্ষেপ করলে সরকারের 'ফেস লস' হত না। হাঁসখালি গণধর্ষণের দায় চাপালেন আইসি-র ঘাড়ে। 

বগটুইয়ে মুখ্যমন্ত্রী
আবার ধরুন আনিস খানের মৃত্যু (anis khan)। টাটকা ঘটনা। সবারই মনে আছে। তাই বিস্তারিতের মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু খেয়াল করুন, হাইকোর্টের চাপ, আন্দোলনের চাপ সত্বেও সরকার অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি।

আবার বরাকর ফাঁড়িতে পুলিশ লকআপে এক কিশোরের মৃত্যুর পরে তা ধামাচাপা দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। 

তৃণমূল আর পুলিশ, মেড ফর ইচ আদার।

নানা ঘটনায় স্পষ্ট তৃণমূল পার্টিটা পুলিশই চালাচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের এসপি থাকার সময় তৃণমূলের অঘোষিত জেলা সভাপতি ছিলেন ভারতী ঘোষ। প্রকাশ্য মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে হাতে দিয়ে প্রণাম করে বলেছিলেন 'জঙ্গলমহলের মা'। এখন অবশ্য 'মা'-কে ছেড়ে 'মেয়ে' বিজেপিতে। 

জেলায় জেলায় তৃণমূলের গোষ্ঠীলড়াই সামলাচ্ছে কে? পুলিশ।      

শুধু সাহায্য করাই নয়, বহু জায়গায় তৃণমূলের পক্ষে 'ভোট করানো'র দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে পুলিশকে। 'দায়িত্ব' পালন করতে না পারলে? 'মডেল তাহেরপুর'। ১০৮-এর মধ্যে ১০৭ পুরসভা তৃণমূলের দখলে। শুধু নদিয়ার তাহেরপুর সিপিএমের হাতেই থেকে যায়। তাই ফল ঘোষণার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই থানার আইসি বদলি।

শোনা যায়, তৃণমূলের তহবিলের জন্য মাসে মাসে থানাভিত্তিক নির্দিষ্ট টাকাও তুলে দিতে হয় পুলিশকে। 

শোনা যায়, সারা রাজ্যের পুলিশ নাকি সামলান মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছের এক থানার আইসি। কীভাবে? সেটা বলা নিষ্প্রয়োজন।  

তবে কথায় বলে আইপিএস-দের কব্জা করা অত সহজ নয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনফিডেন্সের অনেক আইপিএস এখন মমতার কনফিডেন্সের। তবু বুদ্ধ-আমলের একটাও 'কারবার' এখনও ফাঁস করতে পারেননি মমতা ব্যানার্জি।  

মমতা ব্যানার্জি
ফলাফল?

'২০০০ টাকায় বন্দুক কিনে নিয়ে এসে গুলি চালিয়ে খবর হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।'

'পালং শাকের নীচে বন্দুক নিয়ে আসছে। পুলিশ টেরও পাবে না।'

মুখ্যমন্ত্রী কথাতেই স্পষ্ট কেমন চলছে? 

গুলি এখন আমাদের রাজ্যে জলভাত। বন্দুক বানানোর কারখানা তৈরি হয়েছে জায়গায় জায়গায়। বোমা তৈরি, বোমাবাজি তো 'ছোটদের খেলা'। 

মনে রাখা দরকার, তৃণমূল দল তৈরির পরে ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রামবাংলায় সিপিএমের সন্ত্রাস মোকাবিলার নামে আগ্নেয়াস্ত্র ঢোকান হয় মমতার পরিকল্পনাতেই। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আগে গ্রামে খুন হত টাঙ্গি-ভোজালি-লাঠি-বর্শা-কাস্তের মতো গ্রাম্য অস্ত্র দিয়ে। ১৯৯৮-এর পর ধীরে ধীরে অস্ত্র বদলে যায়। 

আগে রাজনীতিকরা দুষ্কৃতীদের ব্যবহার করতেন। মমতা-জমানায় দুষ্কৃতীদের অনেকে নেতা হয়ে গিয়েছেন। এগুলো হল বিপজ্জনক ফারাক।

এসব যোগ হতে হতে 'কমপ্লিট ল-লেসনেস' (বাংলায় উপযুক্ত প্রতিশব্দ পাচ্ছি না, নৈরাজ্য খানিকটা কাছাকাছি)। যখন-তখন যেখানে-সেখানে গুলি-বোমা-খুন-গণহত্যা-ধর্ষণ-গণধর্ষণ। বেপরোয়া নৈরাজ্য।  

শাসক দলের এক আর দু'নম্বরের বাড়ির আটশো মিটারের মধ্যে ভরদুপুরে খুন। গ্রেফতার করতে কেটে গেেছে প্রায় ৭২ ঘণ্টা। ঘটনা নয়, দুষ্কৃতীদের মনোভাব খেয়াল করুন। হাই সিকিওরিটি জোনে ঢুকেও নিশ্চিন্তে খুন করে পালিয়ে যাওয়া যায়। সেটা ভাবতে পেরেছে বলেই না কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। মানে শুধু রাজনীতির আশ্রয়ে থাকা, রাজনীতির নেতা হয়ে থাকা দুষ্কৃতীরাই নয়, সাধারণ দুষ্কৃতীরাও মনে করছে, যেখানে-সেখানে যা খুশি তাই করা যায়। কেউ কিস্যু করতে পারবে না।

ভবানীপুরে নিহত দম্পতির মেয়েকে সমবেদনা মুখ্যমন্ত্রীর
উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরেই হরিশ মুখার্জি রোডের সেই বাড়িতে যান মুখ্যমন্ত্রী। নিজস্ব ঢঙে বলে আসেন, পরিচিতরাই খুন করেছে। ৯৯ শতাংশ তদন্ত শেষ। শিগগিরই ধরা পড়বে। 

দৃশ্যত মচকালেন না নিজেকে 'রাফ অ্যান্ড টাফ' বলতে পছন্দ করা মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তাঁর ভেঙে যাওয়াটা। কবে কোথায় খুনের পরে মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছেন? 

বগটুই আর ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোড। চাকরি দিয়ে বগটুই 'সামলানোর' চেনা খেলা খেলেছেন। হাইকোর্ট সিবিআই দিয়ে দেওয়ায় হিসেব ঘেঁটে গেছে। আনিশের বাবা তো আবার চাকরির প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিয়েছেন। হরিশ মুখার্জি রোডের জোড়া খুন সামলাবেন কী করে? 

আনিস খানের বাবা
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময়ে ২০০৭ সালের পর থেকে রাজ্য এরকম প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। সে সময় আর এ সময়ের মৌলিক ফারাকগুলোর কথা আগেই বলেছি। সে সময়ও এমন পরিস্থিতি ছিল না, যাতে সাধারণ মানুষকে যখন-তখন খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকতে হত। 

অভিজ্ঞ রাজনীতিক মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যের নাড়ির খবর সবচেয়ে ভাল জানেন। শেষের বাদ্যি নিশ্চয়ই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার গতি ঘুরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু 'রোদ্দূর রায় গ্রেফতারি'-র 'শাক' দিয়ে যে আর নৈরাজ্যের 'মাছ' ঢাকা যাবে না সেটাও ভালই বুঝতে পারছেন মমতা ব্যানার্জি। 

ড্রয়িং রুমের ঠান্ডায় বসে 'রোদ্দুরের নিঃশর্ত মুক্তি চাই' দাবি উঠবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় গরম গরম বচন। আর ঠিক তখনই পুলিশকে ঘোল খাইয়ে দিয়ে টপমোস্ট সিকিউরিটি কর্ডনে নবান্নের নর্থ গেটে পৌঁছে যাবেন চাকরি না পাওয়া টেট-উত্তীর্ণরা। তাঁদের কথাগুলো খেয়াল করুন একবার।

'মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, আমরা বঞ্চিত। আপনি কিছু করুন।'

'মাননীয়া, আমাদের অগ্নিকন্যা। আপনি তো এক কথার মানুষ। আপনি তো কথা দিয়েছিলেন।'

'দিদি প্রেস কনফারেন্স করে আমাদের সবার চাকরি হবে বলেছিলেন। আমরা তো চাকরি পেলাম না। আমরা ৫০০ টাকা ভাতা চাইনি। আমাদের যোগ্যতায় চাকরি চেয়েছি। এই কি দিদির ওয়েস্ট বেঙ্গল? আমরা তো দিদিকে ভালবাসতাম।'

নবান্নে চাকরি না পাওয়া টেট উত্তীর্ণদের বিক্ষোভ
টার্গেট সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী। ভোটবিজ্ঞান বলে, কোনও সরকারের বিরুদ্ধে যতই ক্ষোভ থাক যতক্ষণ শীর্ষ নেতার উপর মানুষের আস্থা থাকে, ততক্ষণ সরকার নিরাপদ। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের যাই যাই করেও না-যাওয়া, আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের বিদায় দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়। অনাস্থা, অবিশ্বাস এখন মমতাকে ঘিরেই তৈরি হচ্ছে। 

এ তরঙ্গ রোখার শক্তি নেই কারও।    

প্রশ্ন হল, অতঃপর? 

বিকল্প খুঁজে না পেয়ে পেয়ে এক সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বামফ্রন্ট সরকারের উপর বিরক্ত হয়ে, হাল খারাপ হবে বুঝেও মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন রাজ্যের মানুষ। 

বিধানসভা, উপনির্বাচন, পুরভোটের ফল দেখিয়ে অনেকে বলবেন, মমতাকে সরানো অসম্ভব। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০৬ সালে বিপুল শক্তি নিয়ে আসা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারকে নিষ্কর্মা বনে যেতে হয়েছিল এক বছরের মধ্যেই। আর পাঁচ বছর বাদে বিদায়। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা-সহানুভূতির ঝড়ে কংগ্রেস জমানার সব সেরা ফল করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। পাঁচ বছর বাদেই সবচেয়ে খারাপ ফল করে বিদায়।

ভোটের বর্তমান দেখে সব সময় ভোটের ভবিষ্যত বোঝা যায় না। রাজনীতি পাটিগণিত নয়। রাজনীতি রসায়ন। রাজনীতি তো সমাজবিজ্ঞান। বিজ্ঞান তো স্থির হতে পারে না। গুণগত বদল আচমকাই হয়। বিজ্ঞান তো তাই বলে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
নামহীন বলেছেন…
লেখাটা ভালো লাগলো ধন্যবাদ। আমি তোমার লেখা পড়ি কোনো দিন মন্তব্য করিনা আজকে শেষের লাইন গুলো ভালো এবং ঠিক মনেহলো তাই লিখলাম। চালিয়ে যাও তুমি।
Keya Ghosh বলেছেন…
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

Top Post Ad