গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ১৫
২০১১ সালে পালাবদলের পরে সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা বারবার আক্রান্ত হলেন। আশ্চর্যের হলেও সত্যি, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া জেলা বা রাজ্য স্তরের কোনও নেতা কিন্তু আক্রান্ত হলেন না। আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের পাশেও দাঁড়ালেন না রাজনৈতিক আমলা বনে যাওয়া নেতারা। বাঁচার আশায় সিপিএমের নিচু তলার কর্মী-সমর্থকরা আশ্রয় নিলেন শক্তি বাড়াতে থাকা বিজেপিতে।
![]() |
| বিমান বসু, জ্যোতি বসু, গীতা মুখার্জি |
ক্ষমতা ছাড়া সিপিএম যেন জল ছাড়া মাছ। তাই ২০১৬ সালে দলের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে সরে গিয়ে কংগ্রেসের হাত ধরলেন রাজ্যের নেতারা। ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে নিশ্চিত সিপিএম নেতারা ভোটের ফল বেরোলে দেখলেন কংগ্রেসের কাছে প্রধান বিরোধী জায়গাটা খুইয়ে ৪০ থেকে ২৬ হয়ে গেছেন তাঁরা।
ডঃ অশোক মিত্রর ব্যাখ্যা, 'মুশকিল হল, খবরের কাগজগুলির কাছ থেকে সতত উৎসাহ পান, এমন কিছু নাম-কা-ওয়াস্তে বামপন্থী নেতা আছেন, যাঁরা নিছক মানুষের জোটে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কোনও দিন ছিল না, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে তাঁদের সুখদুঃখের ভাগীদার হওয়ার কর্তব্য এড়িয়ে গিয়ে এ সব ব্যক্তি নেতা-মন্ত্রী হয়েছিলেন। হঠাৎ সেই সুখের নীড় ভেঙে চুরমার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুরনো সুখের মন্ত্রীগিরিতে আবার কী করে দ্রুত অধিষ্ঠিত হতে পারেন, সেই ভাবনায় তাঁরা অস্থির। তাঁদের ধারণা, মানুষ-ফানুসের জোট নয়, একটি বিশেষ সর্বভারতীয় দলের সঙ্গে সরকারি ভাবে জোট বেঁধে নির্বাচনে নামলেই কেল্লা ফতেহ্! নিজেদের দলের মধ্যে এঁরা এই প্রস্তাব নিয়ে সরব হয়েছেন, ওই সর্বভারতীয় দলের দু’একটি রাজ্য নেতাদের কাছ থেকে উৎসাহও পেয়েছেন। মানুষদের নিয়ে কোনও দিন আন্দোলন না-করা এই নেতারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত তাঁদের আর্জি নিয়ে গেছেন।জায়গা তো আর ফাঁকা থাকে না। ক্রমশ বিরোধী রাজনীতির শূন্যস্থান পূরণ করতে উঠে এল বিজেপি।
![]() |
| মীনাক্ষি মুখার্জি ও মহম্মদ সেলিম |
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে একই সঙ্গে তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ল বামেরা। দেখা গেল সিপিএমের ভোটাররা দলে দলে চলে গেলেন বিজেপির দিকে। প্রভাত পট্টনায়েক বললেন, 'তৃণমূল ও মোদির থেকে সমদূরত্বের নীতি বাস্তবসম্মত নয়। এর ফলে ভোটব্যাংকের একটা বড় অংশ বিজেপিতে চলে গেল।...বিজেপিকে মূল শত্রু হিসেবে দেখা উচিত ছিল।'
![]() |
| ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে ব্রিগেডে সংযুক্ত মোর্চার সমাবেশ |
সর্বজ্ঞ, উদ্ধত নেতারা কেন শুনবেন সে কথা? ২০২১ ভোটের আগে তাই এল 'বিজেমূল' তত্ত্ব। কংগ্রেস তো ছিলই, তার সঙ্গে যোগ হল ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সদ্য তৈরি হওয়া ISF। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ প্রথমবার উঠল বঙ্গ সিপিএমের বিরুদ্ধে।
ভোটযুদ্ধ আর ভোটের ফল তো সবারই জানা।
![]() |
| বর্ধমানে ভোটপ্রচারে সিপিআইএম প্রার্থী পৃথা তা |
অধ্যাপক প্রণব বর্ধনের ব্যাখ্যা, 'এই একটা পার্টি, যার একটা শৃঙ্খলা ছিল। সেটা নষ্ট হয়ে গেল, লোকাল কমিটির আর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বাড়তেই লাগল। এর ফলে সারা রাজ্যের মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। 'তৃণমূলের সন্ত্রাস' বললে তাঁরা বলেন, 'তোমরাই বা কী এমন কম করেছ?' আর সংগঠন? ওই মাস্তানরা এখন দল ছেড়ে দিয়ে অন্য পার্টিতে চলে গেছে। আগে যারা লোকাল কমিটি করত, এখন তাদের অনেকে তৃণমূলের ছাতার তলায় সিন্ডিকেট ইত্যাদি করছে। ফলে তৃণমূলের দৌরাত্ম্যে যাঁরা ক্ষুব্ধ, তাঁরাও বিশেষ তফাত দেখছেন না। তাঁরা বলছেন, তোমাদের সব কাণ্ডকারখানা তো চৌত্রিশ বছর দেখলাম, এ বার না হয় দেখি ওরা কী করে।'
![]() |
| ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের দুই মুখ্যমন্ত্রী |
২০১৬ সালে সূর্যকান্ত মিশ্রর করা টুইটটা মনে আছে? 'gobment, poblem, theat, poposal, popaganda...if you want the 'R' back, vote judiciously...'। মমতা ব্যানার্জির উচ্চারণকে কটাক্ষ করতে গিয়ে সিপিএমের গোড়ার গলদটা বুঝিয়ে দিলেন সিপিএমের সে সময়ের রাজ্য সম্পাদক।
'ছোটলোকের পার্টি' এখন 'ভদ্রলোকের পার্টি' হয়ে গেছে। তাই 'ছোটলোকের' উচ্চারণ gobment, poblem, theat, poposal, popaganda নিয়ে অনায়াসে ঠাট্টা করতে পারলেন 'ভদ্রলোকের পার্টির' পলিটব্যুরো সদস্য। গরীব-গুর্বো, চাষা-ভুষা মানে 'ছোটলোকের পার্টি' এখন 'ভদ্রলোকের পার্টি'।
মনে পড়ে যায়, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র বলতেন, 'আমি কমিউনিস্ট, ভদ্রলোক নই। কমিউনিস্ট হতে গেলে ভাল মানুষ হতে হয়। আর ভাল মানুষের মূল কথা বিনয়ী হওয়া।' পরিণতি চোখের সামনে দেখাই যাচ্ছে। তবু সত্য থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা 'বিশ্বম্ভর রায়' এখনও জমিদারি গুমোড় ছাড়তে পারছেন না।
![]() |
| বাম দলগুলোর সমাবেশ |
বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, সিপিএমের শুধু নয়, আসলে বামপন্থার পরাজয় হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, নিজেদের 'বাম' বলে দাবি করা দলগুলো আদর্শগত ভাবে বামপন্থার রাস্তা থেকে সরে গেছে। তাহলে রাজ্যের 'বাম' দলগুলোর বিপর্যয় কোনও ভাবেই বামপন্থার পরাজয় নয়। বাস্তবে বামপন্থার রাস্তা ছাড়া সভ্যতার টিকে থাকা অসম্ভব।
![]() |
| দুই ভারত |
ডঃ অশোক মিত্রের কথা ধার করছি, 'যদি দেশ থেকে বাম আন্দোলন উধাও হয়ে যায়, তা হলে গরিব ও মধ্যবিত্তদের ওপর শোষণ অত্যাচার অনাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে বাধ্য। যাঁরা বলেন, গোটা দেশের আর্থিক উন্নতি হলেই সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র মিলিয়ে যাবে, তাঁরা বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। যদি বাধাবন্ধহীন মুনাফা করার একচ্ছত্র ক্ষমতা সমাজের ওপরের শ্রেণির মানুষের হাতে চলে যায়, তাঁদের বিবেক তাঁদের সংযত হতে বলবে না, যদি বলত তা হলে কোনও শিল্পপতি পাঁচ থেকে দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মুম্বই শহরে নিজের বসবাসের জন্য বাহারি অট্টালিকা তৈরি করতেন না, যে মুম্বইয়ের ষাট শতাংশ মানুষ ঝুপড়িতে বাস করেন। সুতরাং যত দিন দারিদ্র থাকবে, অসাম্য থাকবে, বামপন্থী আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা আদৌ কমবে না, বরঞ্চ আরও বাড়বে।
শেষ







