![]() |
| শ্যামাপ্রসাদকে শ্রদ্ধার্ঘ মোদীর |
সেটাই করেছিলেন সুভাষ।
“সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমর্থকদের বলেছিলেন হিন্দু মহাসভাকে আটকাতে। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলায় ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকের স্বেচ্ছাসেবীরা। তাঁর লোকেরা হিন্দু মহাসভার সভা ভেঙে প্রার্থীদের মারধর করত। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তা অগ্রাহ্য করে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি কথা বলার সময়ে তাঁর মাথায় একটি পাথর আঘাত করে এবং প্রচুর রক্তপাত হয়।”
ইদানিং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে নিয়ে বিস্তর হইচই শুরু হয়েছে। সেটা অবশ্য হওয়ার কথাই। তিনিই আরএসএসের প্রথম রাজনৈতিক দল জনসংঘ তৈরি করেন। পরে নাম বদলে সেটাই হয়েছে বিজেপি। তবে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলার রাজনীতিতে শ্যামাপ্রসাদ তেমন কল্কে পেতেন না, যেমন সংঘের রাজনীতি গুরুত্বহীন ছিল দেশের রাজনীতিতে।
![]() |
| শ্রদ্ধার্ঘ মোদী-শাহের |
ইদানিং পরিকল্পিত প্রচার চলছে। অনেকে আবার বলেন, শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবাংলার জনক। অবশ্য তাঁরাই বলেন যাঁরা মনে করেন, তিনি হিন্দুদের রক্ষাকর্তা। বিস্তারিতের মধ্যে না গিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাইছি।
১৯৩৯ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের কলকাতা সফরের পরে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। সে সময় কংগ্রেসের প্রতি ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র বসুকে দলে টানতে চেয়েছিলেন তিনি। বসু বাড়ির সঙ্গে মুখার্জি বাড়ির সুসম্পর্ক ছিল।
![]() |
| সুভাষচন্দ্র বসু |
সুভাষের সঙ্গে মোলাকাত কেমন হয়েছিল সেটা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি ও এবিভিপি-র প্রতিষ্ঠাতা বলরাজ মাধোকের লেখায় স্পষ্ট।
১৯৪০ সালের ১২ মে ঝাড়গ্রামে এক জনসভায় সুভাষচন্দ্র বলেন “সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে ভোট ভিক্ষায় নামিয়ে দিয়েছে হিন্দু মহাসভা। ত্রিশূল ও গেরুয়া বসন দেখলেই তো হিন্দুরা ভক্তিতে মাথা নোয়ায়। ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে হেয় করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করছে। একে ধিক্কার জানানো সমস্ত হিন্দুদেরই কর্তব্য। জাতীয় জীবন থেকে এই বিশ্বাসঘাতকদের বিতাড়িত করুন। কেউ ওদের কথায় কান দেবেন না। আমরা চাই দেশের স্বাধীনতাপ্রেমী নরনারী একপ্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুন।...হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে হিন্দুরাজের ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি পুরো অলস চিন্তা। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ আলাদা, এর চেয়ে মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না।”
কংগ্রেস সভাপতি থাকার সময় সুভাষচন্দ্র সর্বসম্মতিক্রমে গঠনতন্ত্রে একটি বদল করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “দীর্ঘ দিন যাবৎ কংগ্রেসের কিছু বিশিষ্ট নেতা হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনে যোগ দিতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের থেকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। যে কারণে কংগ্রেস নিজের গঠনতন্ত্রে নতুন একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছে। যার ভিত্তিতে হিন্দু মহাসভা অথবা মুসলিম লিগের কোনও সদস্য কংগ্রেসের সদস্যপদ পাবেন না।”
সুভাষচন্দ্রের অভিযোগ ছিল, ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে কংগ্রেসের ধ্বংসের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল হিন্দু মহাসভা। ১৯৪০ সালের মার্চে দলের মুখপত্রের সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন, “হিন্দু মহাসভা কোনও স্বচ্ছ লড়াই লড়েনি…(তাদের) প্রার্থীদের মধ্যে এমন লোকেরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা কংগ্রেস পুর সমিতি ভেঙে দেওয়ার জন্য তাদের সর্বস্তরের চেষ্টা করেছিল এবং সেই লক্ষ্যে ব্রিটিশ ও মনোনীত কাউন্সিলর গোষ্ঠীর সহযোগিতায় কর্পোরেশনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পুনরায় নির্বাচিত করা হয়েছে এবং তারা ভবিষ্যতে কী ভাবে আচরণ করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
![]() |
| কদম কদম বাড়ায়ে যা... |
হিন্দু মহাসভা কর্পোরেশনকে ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে বাঁচানোর চেয়ে কংগ্রেসকে অপসারণ করার বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ দিয়েছে।”
প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন থাকতেন ফরিদপুরে। বছর পনেরোর মৃণাল ফরিদপুর জুবিলি পার্কে গিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ভাষণ শুনতে। তারপর?
![]() |
| শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি |
শ্যামাপ্রসাদ সুবক্তা। মানুষ তাঁর কথা শুনলও। কিন্তু যখনই তিনি বলতে শুরু করলেন যে, ‘সুভাষচন্দ্র বসু মুসলিম লিগের সঙ্গে এবং তা হিন্দুদের পক্ষে ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, তখনই জনতা হইহই করে উঠল।’
![]() |
| সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল |
সুভাষচন্দ্রকে ঘিরে বাঙালির তুমুল আবেগ। সেই আবেগ ব্যবহার করে শ্যামাপ্রসাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরি আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁকে অস্বীকার বা অশ্রদ্ধা করার কোনও ইচ্ছেও নেই।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে স্বাধীনতার লড়াই চালাচ্ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁর শিষ্য সুভাষচন্দ্র, সে সময়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালি মননের প্রতীক, যাতে সাম্প্রদায়িক ভাবনার কোনও জায়গা ছিল না। তিনি হিন্দু, এ কথা কখনও অস্বীকার করেননি সুভাষচন্দ্র। আবার তিনিই বলেছেন, "হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে হিন্দুরাজের ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি পুরো অলস চিন্তা। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ আলাদা, এর চেয়ে মিথ্যা কথা আর কিছু হতে পারে না।”
ধার্মিক আর সাম্প্রদায়িক মানুষের ফারাকটা স্পষ্ট।
![]() |
| উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ |
![]() |
| গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ছাত্র সমাজ' |
![]() |
| বিনায়ক দামোদর সাভারকার ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি |
'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের বিরোধী শ্যামাপ্রসাদ ২৬ জুলাই, ১৯৪২ বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন আর্থার হারবার্টকে চিঠিতে লেখেন, ‘‘এই যুদ্ধের সময় কংগ্রেস খুব শীঘ্রই যে ব্যাপক আন্দোলনের ডাক দিতে চলেছে, তা প্রতিরোধের জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছি। যুদ্ধের জন্য হয়তো তা একটু সীমাবদ্ধ, কিন্তু জনসাধারণের ভোটেই তো আমরা মন্ত্রী হয়েছি। আমরা মন্ত্রীরা মানুষকে বোঝাব যে ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ভারতের জনসাধারণের স্বার্থেই আমাদের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে। ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারকে বিশ্বাস করতেই হবে... এই প্রদেশের সুরক্ষারই স্বার্থে। আপনার সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে,আপনি আমার তরফ থেকে সবরকম সহযোগিতা পাবেন।”
১৯৪৩ সাল। বাংলায় মন্বন্তর। নভেম্বরে চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য যান বন্যা ও মন্বন্তরে বিধ্বস্ত মেদিনীপুর জেলায়। তিনি লিখছেন, "গত দুই বছর কোনও বাঙালি যদি ন্যাশনাল ফিগার হিসেবে উঠে এসে থাকেন তাহলে তিনি হলেন ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। হবেন নাই বা কেন? তিনি হলেন আশুতোষ মুখার্জির ছেলে। যে আশুতোষ আধুনিক বাংলার অন্যতম স্থপতি, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাসংস্কৃতির আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে গভর্নরের সাথে টক্কর দিয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালে বাংলায় আমেরির শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রাতারাতি ন্যাশনাল ফিগার হয়ে যান। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় গভর্নরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠস্বরটি ছিল তাঁরই। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর বেঙ্গল রিলিফ কমিটিতে লাখ লাখ টাকা এসেছিল। বাংলা বাঁচাতে যাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হল সেই লোকটি তাঁর নিজের গ্রামে জীবনশিখা জ্বালিয়ে রাখতে কী করেছিলেন? আপনারা নিশ্চয় সেকথা জানতে চাইবেন।
তাই আমি, একজন সামান্য বাঙালি আর্টিস্ট, গেলাম হুগলি জেলার জিরাট গ্রাম দর্শনে। আশুতোষ ও শ্যামাপ্রসাদের বাড়ির গ্রাম।...সটান গিয়ে হাজির হলাম আশুতোষের সাবেক প্রাসাদে।...রয়াল বেঙ্গল টাইগারের (ওই নামেই বাংলায় জনপ্রিয় আশুতোষ) ভেঙ্গে পড়া, ধসে যাওয়া, বিষণ্ণ এক স্মারকগৃহ দেখতে পেলাম।...
![]() |
| মন্বন্তর। স্কেচ: চিত্তপ্রসাদ |
![]() |
| চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য |
বন্যা যখন বলাগড়ের সব বাড়িগুলিকে ধসিয়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন আশুতোষের পুত্রেরা একটি ঝকঝকে নয়া অট্টালিকা বানানো মনস্থ করলেন। আশুতোষের পুরানো বাড়ি আর তাঁদের জন্য তেমন যোগ্য ছিল না। দুর্ভিক্ষের মাঝে শ্যামাপ্রসাদ ঝাঁ-চকচকে এক নয়া অট্টালিকা কেন বানাতে বসলেন তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। আমি সেই ঘৃণ্য, কদর্য নতুন বাগানবাড়ি দেখতে চললাম।
![]() |
| জিরাটে শ্যামাপ্রসাদের নতুন বাড়ি। স্কেচ: চিত্তপ্রসাদ |
![]() |
| জিরাটে শ্যামাপ্রসাদদের নতুন বাড়ি। স্কেচ: চিত্তপ্রসাদ |
এখানে জমা হওয়া সম্পদের পাহাড় চারপাশের হাজার হাজার ভুখা মানুষকে অপমান করে চলেছে। বিতৃষ্ণায় বিরক্তিতে আমি ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম।...আমি বাংলার অনেক গ্রামে গেছি, যেসব গ্রাম আমাদের অনেক মনীষীদের জন্মস্থান। কিন্তু ধনীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত গ্রামের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এমন তিক্ত ঘৃণা আমি আর কোথাও দেখিনি।'
হিন্দুদের বহু-বিবাহ ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, হিন্দু নারীর ডিভোর্স ও খরপোশ চাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নিয়েছিল 'হিন্দু কোড বিল'। তার পক্ষে প্রচারে নেমেছিলেন মণিকুন্তলা সেন প্রমুখ। তিনি লিখছেন,'আমরা সেই সময় প্রচারমূলক কর্মসূচির সমাপ্তি উপলক্ষ্যে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে একটা জনসভা ডেকেছিলাম। প্রধান বক্তা শ্রীযুক্তা সরোজিনী নাইডু আর সভানেত্রী ছিলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী।
![]() |
| দিল্লির বাড়িতে শ্যামাপ্রসাদ |
মিটিং-এর ঘণ্টাখানেক আগে আমরা হলের দুয়ারে গিয়ে তাজ্জব। হল তখন পরিপূর্ণ। রাস্তা বা গেট দিয়ে প্রধান বক্তা বা সভানেত্রীকে নিয়ে আমরা ঢুকতেই পারছি না ভিড়ের ঠেলায়। ভাবলাম হয়তো আমাদের মিটিং শুনতেই এত লোকের আগমন।...কিন্তু তাদের চেহারা আর হাবভাব দেখেও কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। অতিকষ্টে ভেতরে ঢুকে দেখি মঞ্চে উপবিষ্ট রয়েছেন স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ ও রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।...অনুরূপা দেবীও উপস্থিত।
আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কী করব এখন? শ্যামাপ্রসাদকে বললাম, এটা তো আমাদের ডাকা সভা, মিসেস নাইডু এসেছন বক্তব্য রাখতে। উনি বললেন, 'বেশ তো করুন না মিটং'। মিসেস নাইডুকে যেন তিনি চেনেন না এমন ভাব দেখালেন। কোনও মতে মিসেস নাইডুকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমরা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিসেস নাইডুর কণ্ঠস্বর ডুবে গেল সভাস্থ লোকের হল্লায়। খানিকক্ষণ বলার বৃথা চেষ্টা করে তিনি বসে পড়লেন। এই মিটিং করতে পারব না বুঝে বিশেষ অতিথিদের নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা।...
খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, গাড়ি গাড়ি মেয়ে আনা হয়েছিল পাথরেঘাটা থেকে এবং তাদের বলা হয়েছিল সমস্ত হিন্দুকে মুসলমান করে দেবার আইন বন্ধ করার জন্য তোমাদের যেতে হবে। বেচারারা মুসলমান হবার ভয়ে এসে হল্লা করে গেল। দুটো করে টাকাও নাকি প্রত্যেকে পেয়েছিল।'
হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতায় একাধিক সভা করে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস। রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং মদনমোহন মালব্যের নেতৃত্বে কংগ্রেসের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীদের সমর্থনও পেয়েছিল তারা। সংসদে ভোটাভুটির সময়ে বিলের বিরোধিতা করতে মুসলিম ও শিখ কট্টরবাদীদের সঙ্গে যোগ দেন নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, "হিন্দু সংস্কৃতির যে ধারা, তাতে আঘাত হানবে হিন্দু কোড। হিন্দু সংস্কৃতির যে স্বাধীন স্বাভাবিক ছন্দ, তা-ও ধাক্কা খাবে।"
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলতেন, ‘‘অখণ্ড ভারতে দু’খণ্ড বাংলা।’’ মানে ভারত অখণ্ড থাকলেও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। তিনি কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, কেমন ছিল তাঁর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, কীভাবে-কেন- কাদের সমর্থনে তিনি বাংলা ভাগের দাবি তুলেছেন এবং তা বাস্তবায়নে কী ভূমিকা নিয়েছেন সেসব নিয়ে বহু বিদগ্ধ আলেচনা আছে। সে সব কথা বলার জন্য এ লেখা হয়। কেমন ছিলেন ব্যক্তি শ্যামাপ্রসাদ, কেমন ছিল তাঁর ভাবনা-সে সম্পর্কে ধারণা দিতেই কিছু উদাহরণ দিলাম। এরকম আরও অসংখ্য ঘটনার কথা বলা যায়।
![]() |
| লর্ড লিটনের সঙ্গে সর্দার প্যাটেল, নেহরু ও শ্যামাপ্রসাদ |
বলা হয়, শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা। হিন্দু বাঙালির রক্ষাকর্তা। বলা হয় এখন, এই সময়।
অখণ্ড বাংলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কিন্তু দেখা যাবে, আর্থিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতা ছিল হিন্দুদের হাতেই। বেশির ভাগ জমিদারই ছিলেন হিন্দু আর কৃষকরা মুসলিম।
নানা কারণে বাংলা ছিল ব্রিটিশের চক্ষুশূল। তাই ধর্মকে ভিত্তি করে বাঙালির মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা শুরু করে ব্রিটিশ। যার পরিণতি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। ভিন্ন ভিন্ন কারণে হিন্দু ও মুসলিমদের একাংশ ছিল বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। তবু বাঙালির চেতনায় তখনও সাম্প্রদায়িক ধারণা তেমন শক্তিশালী না থাকায় দুই সম্প্রদায়ের যৌথ আন্দোলনে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ। কিন্তু ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ আর ১৯১৫ সালে হিন্দু মহাসভার জন্ম হয়। সে সময় ১৯২৬ ছাড়া আর কবে দাঙ্গা হয়েছিল? হিন্দুরা কী ভাবে বিপন্ন হয়েছিল? বরং ব্রিটিশের বন্ধু হিসেবে মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশের ভূমিকায় ধর্মের ভিত্তিতে আইনসভায় আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়।
ব্রিটিশের মদতে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কে ভয়, বিদ্বেষ, ঘৃণা তৈরির কাজটা শুরু হয়। দেখা যাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগের কোনও ভূমিকা নেই। তারা বাংলা-সহ তিন প্রদেশে একসঙ্গে সরকারও চালিয়েছে। সে সব ইতিহাসতে অস্বীকার করে এখন বলা হচ্ছে, বাংলা ভাগ না হলে হিন্দুরা বাঁচত না। সে কাজ করেছিলেন বলে শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে তুমুল হইচই। শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করেছিলেন, তা নিয়ে বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। তবে তিনি যে বাঙালির সর্বনাশ করেছেন তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
![]() |
| ১৯২৬। কলকাতায় দাঙ্গা। |
দেখা যাচ্ছে, ১৯৪৬ সালের ভোটে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা পেয়েছিল ১০ শতাংশেরও কম ভোট আর ১৯৫২ সালে তাঁর নতুন তৈরি দল জনসঙ্ঘ পেয়েছিল ৫.৫৮ শতাংশ ভোট। যিনি পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা, যিনি হিন্দুর রক্ষক, তিনি কেন এত কম সমর্থন পেলেন?
স্বাধীন ভারতের প্রথম মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। স্বাধীনতার পরে ওপার বাংলা থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর জন্য জওহরলাল নেহরু সরকার হাত গুটিয়ে থাকল। কী করেছিলেন প্রবল প্রতাপশালী নেতা? হিন্দুর স্বার্থেও তো লাগলেন না!
শ্যামাপ্রসাদ বাংলাভাগের অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি বাঙালিকে বাঙালি হিসেবে দেখতে না শিখিয়ে হিন্দু-মুসলিমে দেখতে শিখিয়েছেন। বাংলা তো ভাগ হল। পাটের খেত রয়ে গেল ওপারে আর পাটের কল এপারে। বাংলার অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ চটশিল্প ধ্বংসের অন্যতম কারণ শ্যামাপ্রসাদদের রাজনীতি।
স্বাধীনতার সময় পূর্ব ভারত ছিল শিল্পে এগিয়ে। দেশের অন্য রাজ্যগুলিতে শিল্প তৈরির নামে নেহরু সরকার চালু করল মাসুল সমীকরণ নীতি। বাংলা-সহ পূর্ব ভারতের অর্থনীতিকে চুরমার করে দেওয়া সেই নীতির কোনও বিরোধিতা করেননি 'ভারতকেশরী'। এসবও তো হিন্দুর সর্বনাশ করল।
![]() |
| আজকের কলকাতা |
তবু শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুর রক্ষক!
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ভাল ছাত্র, সুদক্ষ, উপাচার্য, প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী। তাঁকে অস্বীকার করা যাবে না। অস্বীকার করা উচিতও না। তাহলে বাংলার, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ঠিকঠাক বোঝা যাবে না।
যাঁরা বাঙালিকে বাঙালি হিসেবে না দেখে কেবল হিন্দু-মুসলমানে দেখতে চান, যাঁরা মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে কেবল হিন্দু-মুসলমানে দেখতে চান, তাঁদের কাছে শ্যামাপ্রসাদ প্রণম্য হতেই পারেন, কিন্ত সাধারণ বাঙালির কাছে তাঁর তেমন গুরুত্ব থাকার কথা নয়।
শতকের পর শতক ধরে গড়ে ওঠা বাঙালিয়ানার ধারণায় সাম্প্রদায়িক চিন্তার কোনও জায়গা নেই।
সব শেষে ঝাড়গ্রামে সুভাষচন্দ্রের বলা কথা আরেকবার উল্লেখ করছি।
![]() |
| সময়ের ভাষা। তরুণের ভাষা |
"...সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে ভোট ভিক্ষায় নামিয়ে দিয়েছে হিন্দু মহাসভা। ত্রিশূল ও গেরুয়া বসন দেখলেই তো হিন্দুরা ভক্তিতে মাথা নোয়ায়। ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে হেয় করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করছে। একে ধিক্কার জানানো সমস্ত হিন্দুদেরই কর্তব্য। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ আলাদা, এর চেয়ে মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না।"
Source: Forward Bloc Weekly; Balraj Madhok, Portrait of a Martyr : A Biography of Dr. Shyama Prasad Mookerjee, 1953 (Rupa, 2001); Syama Prasad Mookerjee, Leaves from a Diary, p. 32, Oxford University Press, 1993; আনন্দবাজার পত্রিকা; শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি: রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায়; গৌতম চট্টোপাধ্যায়: স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ছাত্র সমাজ


















