link text

Breaking Posts

6/trending/recent

Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

কেষ্ট মণ্ডলের জন্মবৃত্তান্ত, গরুর ডানা, অধীরের সিগনাল ও ধর্মতলার ধর্ণা WB-SCAM-&-ALTERNATIVE-POLITICS

শুরুতেই একটা প্রশ্ন, আমার লেখার বক্তব্য কি বোঝা যায় না? প্রশ্নটা তৈরি হয়েছে আমার এক পরিচিতের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পেয়ে।
‘তুমি বা তোমার কোনও খুব কাছের লোককে দিনের পর দিন, রোদ ঝড়, জলে রাস্তায় ধর্নায় বসে থাকতে হলে এই সব লেখাগুলো লিখে যেতে পারতে? তোমাকে কিছু বলার নেই।’ ‘তৃণমূল দুর্নীতি করেছে, কিন্তু বিজেপি যে করেছে--এগুলো কোনও যুক্তি হল? এগুলো তৃণমূলের লোকজন অবশ্য নিরন্তর বলে যাচ্ছে। তুমিও বলছ। তাই তোমার সঙ্গে তৃণমূলের তুলনা টানলে তোমার খারাপ লাগে।...একবার ভেবে দেখলে হয় না কি যে, একই রকম ভাবে যে কেউ বলতেই পারে, ‘অমুকে খুন করেছে, অপরাধ করেছে, আর আমি করলেই দোষ?’ এই ভাবে অপরাধের গণতন্ত্রীকরণ করতে চাইছ? যাকে বলে সামান্যীকরণ। চালিয়ে যাও...। শুধু আবারও একটাই কথা, তোমার যদি আজকে চাকরি না থাকত বা তোমার খুব কাছের কোনও লোককে এই সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হত, তখন এই লম্বাচওড়া লেখাগুলো কি বেরতো?’
মেসেজটা পড়ে তো আমি হাঁ। আমি তো মনে করি, ‘চোর ধরো, জেল ভরো’ নামক নাটক ছেড়ে অধিকারের লড়াইয়ে মন দেওয়া দরকার। যাঁরা চাকরি চেয়ে ধর্নায় বসে আছেন, তাঁদের মতো অধিকারের লড়াই। বারবার বলছি, খেটে খাওয়ার পক্ষে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলায় একমাত্র অধিকারের লড়াইয়ের হাত ধরেই। ও করেছে তাই আমিও করতে পারি, এসব ছেঁদো কথা বলেই মনে করি। সেই সব অভিযোগই আমার বিরুদ্ধে! তাই প্রশ্ন জাগছে, লেখা পড়ে সত্যি কি বোঝা যায় না?
মমতা ব্যানার্জি তিন বার ভোটে জিতেছেন। একবারও ইতিবাচক ভোটে জিতেছেন? ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী ভোট, ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেসের দ্বিধাভরা জোটে ভরসা রাখতে পারেননি মানুষ, ২০২১ সালে বিজেপি বিরোধী ভোট। কেন অধিকারের লড়াই তৈরি করা গেল না? গোলমালটা কোথায়? এগুলোই তো বলতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির কথাবার্তা উদ্দেশ্যপূর্ণ। তার মানে তৃণমূলের দুর্নীতিকে আড়াল করা? পুরো রাজনীতিটাই চলবে কোর্ট-এজেন্সি আর মিডিয়ার ভরসায়? এই ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতির উপর। তাই সততা প্রতিষ্ঠায় নয়, রাজনৈতিক লাভের জন্যই দুর্নীতির বিরোধী খেলা হয়। 

অধীরের সিগনাল

রাজীব গান্ধীর পাশে অনুব্রত
যা হচ্ছে, পরিকল্পনা মাফিকই হচ্ছে, সেটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। ১৩ জুলাই দার্জিলিঙে হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জি মিটিং করলেন। ২৩ জুলাই পার্থ চ্যাটার্জি গ্রেফতার হলেন। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী-মমতা ব্যানার্জি বৈঠকের পর অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার। কাকতালীয়? 
মহারাষ্ট্র মডেলের কথা শোনাচ্ছেন সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা। সুকান্ত মজুমদার খোলাখুলি বলছেন, তাঁরা একনাথ শিন্ডের খোঁজে আছেন। শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে খেল খতম। সরকার কার্যত থাকবে না। চব্বিশে লোকসভা আর বিধানসভা ভোট হবে একসঙ্গে। মাথায় রাখুন, বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে নবান্ন অভিযান করবে ৭ সেপ্টেম্বর। মাসখানেক পর। তার অর্থ, তদ্দিন এই ইস্যু চলবে।
অভিষেক ব্যানার্জি আবার জুলাই থেকে বলছেন, ৬ মাসের মধ্যে নতুন তৃণমূল গড়বেন।
লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কী বললেন?
'কেন তৃণমূলে মমতার লোক বলে পরিচিতরা গ্রেফতার হচ্ছেন? কেন ভাইপোর কোনও লোককে ধরা হল না? দিল্লিতে থাকি। খবর পাই। ৯ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে ইডি-র কাছে সব উগড়ে দিয়ে এসেছেন ভাইপো। সব, মানে সব।' বাজে কথা হলে অভিষেক নিশ্চয়ই অধীরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবেন।

ডানাওয়ালা গরু

কয়লা আর গরু চুরির ব্যাপারটা ভাবুন। বাম জমানাতেও কয়লার রং কালোই ছিল। সেই কালি নানা জায়গায় লেগেওছে। সেটা আরও খুল্লামখুল্লা, বেপরোয়া হয়েছে তৃণমূল জমানায়। কিন্তু কয়লা মানে তো ইসিএল, কেন্দ্রীয় সংস্থা। শুধু এখানকার জেনারেল ম্যানেজাররাই যা করার করতেন? বিশ্বাস করতে হবে?
গরু পাচারও বাম রাজত্বে শুরু হলেও রমরমা তৃণমূল জমানায়। কোথা থেকে আসে গরু? বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পঞ্জাব...। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যায় বাংলাদেশে। তার একটা এন্ট্রি পয়েন্ট ঝাড়খণ্ড হয়ে বীরভূম। সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে বাংলাদেশ। বিভিন্ন রাজ্য থেকে গরু উড়ে উড়ে আসে? গরু বাংলাদেশ যায় মানে সীমান্ত টপকাতে হয়। সীমান্ত তো সামলায় বিএসএফ। সেটাও কেন্দ্রের হাতে। গরু কি উড়ে উড়ে বিদেশ যায়? বিএসএফ কিস্যু জানে না? অন্য রাজ্যের পুলিশ কিস্যু জানে না? আর কেউ কিস্যু জানেন না? শুধু অনুব্রত মণ্ডল একা এত কিছু করতে পারেন?
গরু ও কয়লা মামলায় অন্যতম কিংপিন বিনয় মিশ্র। তাঁকে যুব তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন অভিষেক। বাড়ি রাসবিহারীতে। বিনয়কে নিরাপত্তা দিত রাজ্য সরকার। তাঁর বাড়িতে সিবিআই তল্লাশি চালাতে গেলে স্থানীয় থানার পুলিশ দৌড়ে যায়। বিনয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু কেন এত গুরুত্ব অঙ্কের গৃহশিক্ষককে? তাঁর হাত দিয়েই নাকি গরু কয়লা কারবারের টাকা পৌঁছত অভিষেকের হাতে। মজা দেখুন, অন্য সব অভিযুক্ত এখানেই আছেন। শুধু নেই বিনয়। নেই মানে দেশেই নেই। আছেন দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুতে। সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। নিয়ম হল, অন্য দেশের নাগরিকত্ব পেতে হলে ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়। সেটাও ছেড়েছেন দুবাইয়ে ভারতীয় দূতাবাসে কাগজপত্র জমা করে। করেছেন সিবিআই গরু ও কয়লা কাণ্ডের তদন্ত শুরুর পরে। তারও পরে বিনয়ের মা-বাবাও দেশ ছেড়েছেন। কী বুঝলেন? বিনয়ের আইনজীবী কে? তৃণমূলের সমর্থনে রাজ্যসভায় যাওয়া কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি। বিনয় তো দেশছাড়া, আইনজীবীর অত ফি কে জোগাচ্ছেন? কী মিষ্টি ব্যাপার বলুন! গরু পাচার উপলক্ষ মাত্র। দুর্নীতি তাড়ানো লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাই বেছে বেছে...।

আচ্ছা, অনুব্রত কী করতেন সেটা কে না জানত? সারা রাজ্যে তৃণমূলের ছোট বড় মাঝারি নেতারা কোন রাজত্ব কায়েম করেছেন, সেটা কে না জানে? কোথায় প্রতিরোধের লড়াই হয়েছে?
বর্ধমান শহর থেকে খানিকটা দূরে কালনা যাওয়ার রাস্তায় হাটগোবিন্দপুর বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে সিপিএম নেতা-কর্মীদের উপর নির্মম হামলা চালিয়েছিল তৃণমূল। ঘটনার দিন বর্ধমানে ছিলেন বিমান বসু। কিন্তু ওই গ্রামে যাননি। বর্ধমান শহরেও ধর্নায় বসেননি। পরবর্তীতে নেতাদের ভরসায় না থেকে হাটগোবিন্দপুরে প্রত্যাঘাত হয়েছে। গুন্ডাদের সাহস বড্ড কম হয়। আর সাহস কম হয় ভদ্দরলোকদের।
আমার অনেক বন্ধু তৃণমূল কংগ্রেস করেন। যেমন রাজ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ করেন। তাঁদের বেশির ভাগই অসৎ নন। বরং তাঁরাও নির্যাতিত। তেমনই এক বন্ধু মেসেজ করেছিল। খুব ভেঙে পড়েছে। তবু বিশ্বাস করতে চায়, নেতারা ক্লিন চিট পাবেন। জানে দুর্নীতির জালে দলের আগাপাশতলা জড়িয়ে গেছে। তবু যেন বিশ্বাস করতে চায় না। লিখেছে, তৃণমূল আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ল।
ঠিক। কারণ এবার আর কোনও ভাবেই মমতা ব্যানার্জির সৎ, মানবিক ভাবমূর্তি রক্ষা করা সম্ভব নয়। ওকে লিখেছি, এটা কোনও দলের সমস্যা নয়, এটা ব্যবস্থার সমস্যা। যে সংকট বামফ্রন্ট সরকারের সময় তৈরি হয়েছে তৃণমূল সেটাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালে তৃণমূলের সরকার তৈরির সময় থেকেই বলছি, সিপিএমের জুতোয় পা গলিয়েই হাঁটছেন মমতা। জুতোটা তাঁর মাপে তৈরি নয়। তাই ওই জুতো পরে হাঁটতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছেন আর সবার চোখে পরে যাচ্ছে। 

কেষ্ট মণ্ডলের জন্মবৃত্তান্ত

নানুনের হাটসেরান্দি গ্রামের অনুব্রত মণ্ডলের লেখাপড়া ক্লাস এইট পর্যন্ত। পরিবারের জমি সংক্রান্ত ঝামেলায় সিপিএম বিরোধী হন কিশোর বয়সেই। বইপুস্তক পড়ে নয়, বেশির ভাগ মানুষ এভাবেই কোনও পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
তদ্দিনে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে একটা নতুন সম্প্রদায় তৈরি হতে শুরু করে, রাজনৈতিক জমিদার। সংকটের বর্ণনাটা ডঃ‌ অশোক মিত্রর কথায় দেওয়াই ভাল।
'ভূমিসংস্কারের পরবর্তী অধ্যায়ে উৎপাদন বাড়ানোর চিন্তা করা হয়নি। সমবায় নিয়েও তেমন আলোচনা হয়নি। ছোট চাষিরা জমি পেলেও জীবিকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পারলেন না। কয়েক বছর পর থেকেই তাঁদের অনেকে মাঝারি বা বড় জোতদারদের কাছে জমি বিক্রি করে ফের ভূমিহীন খেতমজুর হয়ে গেলেন। এই মাঝারি ও বড় জোতদাররা এখন রীতিমত জমিদার, অনেকে জমির মালিকানার ঊর্ধ্বসীমার আইনি ব্যবস্থার ফাঁকফোকরও রপ্ত করে ফেললেন। আবার তাঁদের হাতেই দলের গ্রামীণ নেতৃত্ব, তাঁরা পঞ্চায়েতেরও মাতব্বর, প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও তাঁরা শিক্ষক। তাঁরা নামেই বামপন্থী, মানসিকতায় সম্পন্ন শ্রেণিভুক্ত।' শিক্ষক ছাড়াও রেশন-সারের ডিলার, সুদ ব্যবসায়ীরাও ছিল সেই দলে।
আর্থিক ভাবে অত্যন্ত দরিদ্র নানুর রাজনৈতিকভাবে বীরভূমের সবচেয়ে বেশি অশান্ত এলাকা ছিল। ২৭ জুলাই, ২০০০। নানুরের সূচপুরে ১১ জন খেতমজুর খুন হন। এলাকার সাংসদ সোমনাথ চ্যাটার্জি নিহতদের বলেছিলেন ভাড়াটে গুন্ডা, ডাকাত ও কুখ্যাত সমাজবিরোধী। পরে অবশ্য অনিল বিশ্বাসরা মেনে নেন নিহতরা খেতমজুর। কিন্তু দাবি করেন, এটা রাজনৈতিক খুন নয়,  জমিসংক্রান্ত কারণে ওই ঘটনা।  বামকর্মীদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, একথা বলেও মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বারবার তাঁদের সংযত থাকার আবেদন জানান। তাঁর কথার ইঙ্গিতেই স্পষ্ট হয়, সূচপুরে কী হয়েছিল।
তারপরেও ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে গণহত্যার দুই প্রধান অভিযুক্ত নিত্যনারায়ন চট্টোপাধ্যায় ও মণিরুজ্জামানকে প্রার্থী করে সিপিএম। ১২ মে, ২০০৫ আক্রান্ত হন নানুর হত্যাকাণ্ডের প্রধান সাক্ষী আব্দুল খালেক ও তাঁর দেহরক্ষী। কিন্তু গণহত্যার পর থেকেই নানুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের সন্ত্রাসের অভিযোগে থুপসারা পঞ্চায়েতের ১৯টির মধ্যে ১৭টি বুথেই পুনর্নির্বাচন দাবি করে শাসক সিপিএম। সই সময় তৃণমূলকে নেতৃত্ব দেন অনুব্রত মণ্ডল।
বীরভূমের রাজনীতিতে কেষ্টর  উত্থানের সেই শুরু। তৃণমূল জমানায় ক্রমশ তিনি হয়ে ওঠেন হত্তা কত্তা বিধাতা। পুলিশ প্রশাসন চলে তাঁর সুতোর টানে। মাথার উপর মুকুল রায় আর মমতা ব্যানার্জির হাত।
সূচপুর যেমন কেষ্টর উত্থানের মঞ্চ, তেমনই সে সময়ের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতি ও রাজনীতির বাস্তব ছবিও ফুটে ওঠে। কৃষি সংকট তৈরি হয়েছে বলেই কাজের জন্য দু'দল খেতমজুরের লড়াইয়ে গণহত্যা। খেতমজুর খুনের পরও চঞ্চল হয় না কমিউনিস্ট চিত্ত। নাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও উদ্বেল করে না। ভুলটা কোথায় হল, গ্রামের চেহারাটা কী হচ্ছে, সেটা খুঁজে দেখার চেষ্টা হয় না। প্রান্তিক মানুষ দূরে সরছেন, তার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েও ক্রমাগত অস্বীকার করতে থাকেন সিপিএম নেতারা। জ্যোতি বসুর কথা কানে তোলার মত অবস্থা আর ছিল না। তখন গ্রামে গ্রামে রাজনৈতিক জমিদারির কেন্দ্র সিপিএমের লোকাল কমিটি। তার হাতেই সব ক্ষমতা। গণহত্যার দুই প্রধান অভিযুক্তকে প্রার্থী করা রাজনৈতিক জমিদারদের ঔদ্ধত্যের প্রমাণ। প্রমাণ লোপাটে সাক্ষী খুনের চেষ্টা। পরবর্তী এক দশকে বারবার সেই ছবি দেখা যায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। 
বগটুই গণহত্যা
তৃণমূলে তো আর লোকাল কমিটি নেই। সেখানে নেতাই সব। তাই সব হয়ে উঠলেন কেষ্ট। সময় যত গড়িয়েছে ততই গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট বেড়েছে। কোথাও কাজের সুযোগ নেই। পার্টিই সবচেয়ে বড় আয়ের জায়গা। তাই নেতার পাশে কর্মীদের ভনভন, একটু মধুর আশায়। কর্মীদের মধু জোগাতে রাণী মৌমাছির নেতৃত্বে নেতা মৌমাছিদের বেপরোয়া নড়াচড়া। তোলাবাজি, কাটমানি, কয়লা-বালি-গরু পাচারের চক্র...আরও কত কী! কর্মীরা পান এক ফোঁটা। বেশির ভাগটাই উঠে যায় উপরের দিকে। লক্ষ লক্ষ সরকারি পদ ফাঁকা পরে আছে। অস্থায়ী নিয়োগ হচ্ছে। অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। কাজ পাচ্ছেন মূলত দলের কর্মীরাই। যা স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে তার বেশির ভাগই বিক্রি হয়েছে। বাম জমানার সেই ক্ষমতাধর রাজনৈতিক জমিদারদের অনেকেই পক্ষ বদলে নিয়েছেন সুযোগমতো। কেউ কেউ পক্ষ না বদলালেও বোঝাপড়া করে নিয়ে চলছেন। তার সঙ্গে তৈরি হয়েছে তৃণমূলের জামা পরা নতুন নতুন জমিদার। পুরো কারবার মমতা ব্যানার্জির অগোচরে, তাঁর প্রশ্রয় ছাড়া হয়েছে? হাস্যকর দাবি।  
এই দুর্নীতির রাজনীতি কোনও দলের নয়, একটা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সৃষ্টি। জয় নিশ্চিত জেনেও বেআইনি পথে ভোট করানো তৃণমূলের অভ্যাস হয়ে গেছে। সেই অভ্যাসের ছবি তো ছিল অনিল বসুর ৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৫০২ ভোটে জয়েও। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে অনেকে ভাব দেখাচ্ছেন, যেন আগে কখনও দেখেনইনি। নিজের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা নীতিগত কারণেই বলব না। আগে অন্য একটি লেখায় উদাহরণ দিয়েছি, কিভাবে সিপিএমের একজন ব্রাঞ্চ সদস্যের বেআইনি কাজ থামাতে পারেনি রাজ্য সম্পাদক।  ডাঃ অশোক মিত্রর লেখার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি। 
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্রের শপথ
বোলপুর থেকে ট্রেনে কলকাতায় ফেরার পথে বর্ধমান বা গুসকরা থেকে ওঠা এক কিশোরের সঙ্গে কথাবার্তার বিবরণ দিয়ে অশোকবাবু লিখেছিলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়নরত, পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ। ছেলেটি আমাকে চেনে না। নামও শোনেনি কোনওদিন। জিজ্ঞাসা করলাম, কলেজে কেমন পড়ানো হয় পদার্থ বিজ্ঞান? ম্লান মুখে, পৃথিবীর সঞ্চিত বিষন্নতা নিয়ে সে জানাল, এতদিন অমুকদা পড়াতেন। ওঁর প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি। বোঝানও চমৎকার। কিন্তু উনি তো পার্টির সদস্য নন। পাকা চাকরি পাবেন না। পাকা কাজে যিনি আসছেন তাঁকেও তারা চেনে—তমুকদা। কিছু পড়াতে পারেন না, ছাত্রও ভাল ছিলেন না।
কাহিনিটি আমি জ্যোতিবাবুকে বলেছিলাম। উনিও শুনে আতঙ্কিত। তবে ততদিনে ঘুণ অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে।...যাঁরা বিশ্বস্ত পেটোয়া, তাঁদের বাছা হবে। যাচ্ছেতাই বা অপদার্থ হলেও যায় আসে না। অপকৃষ্টরা অপকৃষ্টদেরই হাতছানি দেয়, উৎকৃষ্টরা টিকতে পারে না সেই পরিবেশে। গত কুড়ি বছরের ইতিহাস থেকে এন্তার উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।’

ধর্মতলার ধর্ণা 

বাম জমানায় হয়েছে তাই তৃণমূল জমানায় হতেই পারে, এরকম কোনও ভাবনা আমার নেই। আমার কথাটা হল, দুর্নীতি রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। রোগ সারানোর দাওয়াই অধিকারের লড়াই। ধরুন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি। যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা কবে থেকে ধর্না দিচ্ছেন। কেউ কান দিয়েছেন? ধর্মতলার ধর্না থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে দিয়েছে পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রিজন ভ্যানে। অভিষেকের অফিসের সামনে থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে দিয়েছে পুলিশ। কেউ ছিলাম ওঁদের পাশে?  কোর্ট বলতেই নেতাদের ভিড়। মমতাও এক সময় গিয়েছিলেন ধর্নায়। সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। সমস্যা মেটেনি। মিটবে কী করে? না মেটার ব্যবস্থা তো তাঁর নির্দেশেই হয়েছে। এখন মিটিং করছেন অভিষেক। পার্থ-কেষ্ট ইত্যাদি নিয়ে খিল্লিতে মেতে থাকা আমরা বা মিডিয়ায় গরমগরম বাইট দিতে ব্যস্ত নেতারা, কে খোঁজ রাখছি ধর্নায় বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর? 
অভিষেকের অফিসের সামনে থেকে
সরানো হচ্ছে ধর্নাকারীদের
আগে লিখেছিলাম আমার ভাবনার কথা। হবু শিক্ষকদের আন্দোলন আর আনিস খুন, রাজ্য রাজনীতির দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। বছরের পর বছর শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। স্কুলগুলোর কী হাল? ছাত্রছাত্রীদের কী হাল? দূরের স্কুল থেকে বাড়ির কাছের স্কুলে বদলির জন্য প্রকল্পে লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার। শিক্ষকহীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের অনেক স্কুল। গণপরিবহণ উঠে যাওয়ার জোগাড়। সবার উপর আছে জিনিসপত্রের দাম। বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে উঠছে। কার হুঁশ আছে? 
সবচেয়ে বড় জায়গা কাজের সুযোগ। কাজের সুযোগ তৈরি করা গেলে আয়ের একমাত্র উত্স আর পার্টি থাকবে না। রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের সুযোগ তৈরি হবে। রাজনীতিতে বদল মান তো সরকারের বদল নয়, বদল মানে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল।
দরকার শক্তপোক্ত নেতৃত্ব। নামী নেতৃত্ব নয়, শক্তপোক্ত নেতৃত্ব। দরকার ছোটলোকের রাজনীতি। যারা দুর্নীতি করে, যারা দুর্নীতির রাজনীতি করে, যারা লুটে খাওয়ার লোক, তাদের ভয় খুব বেশি। বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরের উদাহরণটা দেখুন।
অভিষেকের বাড়ির সামনে নিরাপত্তা
দামী গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ানো অভিষেকের বাড়ি ঘিরে বিরাট নিরাপত্তা। তিনি রাস্তায় বেরোলে ঢেকে রাখে নিরাপত্তা। চারপাশের গাড়িঘোড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কে তিনি? একজন সাংসদ ছাড়া তো কিছু নন। অনুব্রত কে? কেন তাঁরা জন্য সরকারি নিরাপত্তা? কেন বিনয় মিশ্রের জন্য সরকারি নিরাপত্তা? তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গেলে পাড়ার নেতার জন্যও বরাদ্দ কেন্দ্রীয় বাহিনী। আবার বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গেলে বরাদ্দ পুলিশি পাহারা। ভয় না থাকলে হয়?
স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার আকাশ ভয়মুক্ত রাখতে ৪০০ ঘুড়িবাজ থাকছে। ভয় কয় যাহারে!
ভয় করে আমারও। ভয়ের রাজনীতি যে ক্রমশ চেপে বসছে জীবনে। আর আমাদের ব্যস্ত রাখা হচ্ছে দুর্নীতির খিল্লিবাজিতে। মাঝেমধ্যেই ভয় হয়। মাঝেমধ্যে হতাশ লাগে। আবার মনে হয়, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। মানুষ, একমাত্র মানুষই ইতিহাস তৈরি করে। 
ধর্মতলার ধর্ণা 
(অনুব্রত মণ্ডলের ব্যক্তি জীবনের ছবিগুলো TheWall নিউজ পোর্টাল থেকে নেওয়া)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
Keya Ghosh বলেছেন…
দরকার ছোটলোকের রাজনীতি "---সেটা কি? কারা ছোটলোক? কোন প্যারামিটারে ?
নামহীন বলেছেন…
আমরা আম জনতা ছোটলোক, তাই আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও ছোটলোক

Top Post Ad