_________________________________
![]() |
সেনাবাহিনীর ডাক্তার ছিলেন। অবসরের পর মেজর ইন্দ্রনীল চৌধুরী অক্লান্ত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে। সঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকসের সাম্মানিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছের। আমার সঙ্গে পরিচয় বেশ কয়েক বছর আগে। লেখালেখির শখ বহু বছরের। তাঁর কিছু লেখা পরপর পাবেন 'যাচ্ছেতাই'-এ। মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত।
_________________________________
প্রতি ১৫ আগষ্ট, সেনাতে এক নিয়ম আছে। সেদিন অফিসারদের নিমন্ত্রণ থাকে জওয়ানদের মেসে। বড়াখানা। পতাকা উত্তোলন করে সুস্বাদু খাবার।
বেলপুরের মানুষ হয়তো খাওয়া নিয়ে আলোচনা করবেন। খরচ। সেনাদের মাসমাইনে নিয়ে বেলপুর মাঠের ধার সরগরম করবে কিছু অলস, না-খেটে-খাওয়া, পরশ্রীকাতর, হয়তো মানুষেরা। যাঁরা গরীবিয়ানাকে বাজি রেখে সমাজে বিষবায়ু ছড়াচ্ছেন। এঁরা সেটাই বিশ্বাস করেন যা ওঁরা বিশ্বাস করতে চান। গরীবি হটাও, দেশ বাঁচাও। প্ল্যানিং কমিশনের টেন্ডুলকর গরীবি লাইনের থেকে লাখডাওয়ালা গরীবি লাইন নেমে এসেছে। '৭৩-'৭৪ সালে ৫৪%। '৮৩-'৮৪ তে ৪৪%। '৯৩-'৯৪ তে ৩৬%। লখনউ ট্রেনিংয়ের ডাটা কিছু মনে আছে। কমছে না খেয়ে মরার দিন।
আমি জানি এসব। ছুটিতে বাড়ি আসার পথে এসব ভাবছিলাম প্লেনে। হয়তো অনেক আশা নিয়ে বেলপুর ফিরেছিলাম। স্টেশনে পৌঁছে দেখা পঞ্চায়েতের ফন্টেদার সঙ্গে। সে অবাক।
-কি রে রণ পালিয়ে এলি নাকি?
-মানে?
-মানে তুই এখানে?
-ছুটিতে এসেছি।
-ও।
আমার ইচ্ছে হল ঠাস করে এক চড় মারি। সামলে নিয়ে কোনও মতে বললাম,
-যাই বাড়ি।
বাড়িতে মায়ের কত প্রশ্ন।
-ঠিকমতো খেতে দেয়? ঘুম হয়? উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে না তো?
আমি অবাক।
-কেন মা এসব হবে?
-না রে। পাড়ার সবাই এসব বলে।
-এই পাড়া?
-হু
-ছাড়ো।
বাবাও বেশ গম্ভীর।
-জানিস রণ, তোর ওই অঙ্কের মাস্টার, যে পার্টি করত, সে এসে হুমকি দিয়ে গেছে। বাড়ির একদিক ওকে দিতে হবে। কারণ ও নাকি কী সব। নইলে...
-বাবা ভয় পেয়ো না। তোমার ছেলে এখন ক্যাপ্টেন। অনৈতিক কিছু করে বেঁচে থাকতে হবে না।
বাবার মন মানে না।
-নারে এদের চিনিস না। এরা সব পারে। প্রশাসনও ওদের হাতে। ওরা সব পারে, রণ। কবে যে এই নৈরাজ্য শেষ হবে?
-বাবা, তুমি অযথা ভয় পাচ্ছ। আমি আছি। দাঁড়াও ফিরে গিয়ে দেখছি। আর পার্টির কথা বলছ? যে পার্টিই আসুক না কেন, এরাই তখন ও পার্টিতে হাজির হবে। যারা রাজনৈতিক প্রফেশনাল তাদের রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করে গেছেন সংবিধানের স্রষ্টারা। "Citizens get the government they deserve"। এরা পার্টির নামে সংসার চালায়। ভয় দেখিয়ে। হুমকি দিয়ে। প্রশাসনকে গোলাম বানিয়ে।
-তোর রক্ত এখন গরম, রণ। বুঝতে সময় লাগবে।
-ছাড়ো। আমার মা ডাকাত তাড়িয়েছিল। আমায় ছোট্ট ভেবো না, বাবা। আমিও একদিন তোমার মতো বড় হব। মস্ত বড়। ভয় পেয়ো না।
সারা ছুটি মায়ের হাতে পায়েস , গোকুলপিঠে, চিতলমাছের মুইঠ্যা, লাউ চিংড়ি খেয়ে, ১০ কিলো ওজন বাড়িয়ে যেদিন ট্রেন ধরতে স্টেশনে, যীশু, দীপ্ত, জগা, সবাই এসেছিল। কতদিনের বন্ধু সীমান্তে যাচ্ছে।
ট্রেন ছাড়ার আগে বলেই ফেললাম যীশুকে।
-একটা কথা বলি যীশু। তোর পার্টির কিছু লোক বাবা-মাকে বৈষয়িক লোভে মানসিক চাপ দিচ্ছে। দেখিস।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছি। যীশু দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করে বলল,
-রণ, তুই সীমান্তে পাহারা দে। আমরা কাকু কাকিমাকে পাহারা দিয়ে যাব। জয় হিন্দ।
![]() |
দিল্লি অবধি জানতে পারিনি কোন লোকেশনে যেতে হবে। দিল্লি থেকে উড়ে গেলাম শ্রীনগর। এয়ারপোর্টে চাপা গলায় ডাক,
-সেলাম সাব। গাড্ডি বাহার খাড়া হ্যায়।
গাড়িতে উঠে বাড়ির চিন্তায় আচ্ছন্ন। চার ঘণ্টা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নিজের ইউনিটে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল।
আমার তাঁবু সিও কর্নেল সিং-এর তাঁবুর পাশে। তার পাশে টুআইসি কর্নেল বাদুড়িয়া।
রাতে সিও ডাকলেন তাঁর তাঁবুতে। সঙ্গে বাদুড়িয়া। সিং বাঙ্গালোরে থাকেন। ওঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। কাল বা পরশু ইডিডি। সব জিজ্ঞেস করলেন। ওঁরও দুশ্চিন্তা। কী হয় কী হয়। মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি ম্যাডাম। ডাক্তারের উপস্থিতি সিওকে ভরসা দিয়েছে। রেজিমেন্টের চিকিৎসক। অগাধ আর অবাধ বিশ্বাস ইউনিটের সবার। ডকটর সাব। সবার। মন আমার গর্বে ভরে ওঠে। বেলপু্রের মানুষের কি এই অগাধ বিশ্বাস আছে তাঁদের ডাক্তারদের প্রতি?
তাঁবুর বাইরে নিঃশব্দ অন্ধকার। আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ। শত্রুর স্নাইপার চনমন করে উঠতে পারে দূর থেকে আলোর বিন্দু দেখে। কর্নেল বাদুড়িয়া বললেন,
-ডক্, কাল সুভে জিপসি মাঙ্গা লিয়া। ট্রাউট পাকাড়নে চলতে হ্যায়। মজা আয়েগা।
আমি অবাক।
-সেকি। আমিও ?
-ডর গ্যায়া ক্যা?
-না না ডরের বাত নেহি। মছলি পাকড়া নেহি কভি।
-আরে বাঙালি বাবু, মাছের ঝোল দম সে খাতে হো।পাকড়না নেহি আতা?
-কি আর বোলেগা?
-জায়েগা। গুড নাইট।
পরদিন ভোর চারটা। বাদুড়িয়া আমায় প্রায় কোলে করে তুলে নিলেন জিপসিতে। দূরে কোনও উপত্যকা জোনাকির আলো জ্বেলে জ্বলজ্বল করছে। এক ঝর্ণার ধারে গাড়ি থামল। বাদুড়িয়া তাঁর মালপত্র নিয়ে নামলেন। আমিও পিছুপিছু।
-ছিপ কই?
বাদুড়িয়া হেসে খুন।
-ঝর্ণো মে ছিপ? বেটা গ্ৰেনেড সে।
অবাক কাণ্ড।
একটু নিচে একটা জাল। গ্ৰেনেডের চাবি দাঁত দিয়ে খুলে ঝর্ণার জলে। কিছুক্ষণ বাদে জল তোলপাড়। তার কিছুক্ষণ বাদে ট্রাউট মাছ জালে। বাদুড়িয়া বলছিলেন, ওই গ্ৰেনেডের কম্পনে ওদের কানের পর্দা ফেটে ব্যালেন্স হারিয়ে ধরা পড়ে।
![]() |
ভোরের আলো সবে উঠেছে। একটা জংগা বিচ্ছিরি ভাবে থামল। এক সুবেদার, তাঁকে চিনি, পাশের ইউনিটের। লাফিয়ে নেমে বলে অস্ফুটে বললেন,
-সাব আপকা পুরা ইউনিট কাতল্ হো গ্যয়া।
বাদুড়িয়ার চোয়াল শক্ত । ভোরের চোখ আগুন। অস্ফুট স্বরে বলল...
-বাস্টার্ড। আই উইল কিল উ।
আমরা ইউনিট পৌঁছতে সেখানে শোকের ছায়া। ২২ জনকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে শহিদ করেছে শত্রুরা। এবার বুঝলাম ফিরতি পথে বাদুড়িয়া কেন নিজের মনে বলে চলেছিলেন,
-ডি মাইনাস ওয়ান। উনকো খবর থা।
শুধু খবর ছিল না বেঙ্গালুরুতে। ভূমিষ্ঠ হয়ে যে জানল না তাঁর বাবা শহিদ হয়েছে আজ ভোরে। সূর্যোদয়ের আগেই।
.jpeg)

.jpeg)
.jpeg)