![]() |
| পার্থ ও অর্পিতা (উপরে)। (নীচে) অর্পিতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা। |
২০১৭ সালে এই তামিল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অর্পিতা মুখার্জি। তিনি কে, সেটা এখন বোধহয় কাউকেই বলার দরকার নেই। গুগল সার্চও নিশ্চয়ই হাঁফিয়ে গেছে। কিছু তামিল, বাংলা, ওডিয়া ছবিতে অভিনয় বা মডেলিং করলেও তাঁকে খুব একটা কেউ চিনত না।
![]() |
| অর্পিতা মুখার্জি |
চিনে ফেলল এক রাতে। বাড়ি থেকে ২১ কোটি টাকা, ৫০ লক্ষ টাকার গয়না, ২০টি মোবাইল ফোন পাওয়া গেল। ওই আবাসনেই চারটি ফ্ল্যাট আছে। বেশ কয়েকটা দামী গাড়িও আছে। এতেও হয়তো এত তরঙ্গ উঠত না।
হাওড়ার সেই ইঞ্জিনিয়ারের কথা মনে আছে? মেঝেতে পাতা কার্পেটের নীচে, কমোডে, মল যাওয়ার পাইপেও টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা। তখন সামান্য চঞ্চল হয়েছিল জনচিত্ত। এবার তরঙ্গ উঠল, কারণ অর্পিতা রাজ্যের শাসক দলের মহাসচিব, রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ।
পার্থকে গ্রেফতার করেছে ইডি। মদন মিত্র, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখার্জির পর দুর্নীতির অভিযোগে আরও এক মন্ত্রী গ্রেফতার। জেল খাটার লিস্টে সুদীপ ব্যানার্জি সহ আরও কয়েকজন তৃণমূল নেতা আছেন। কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্টের জমানায় দুর্নীতির অভিযোগে কোনও মন্ত্রী, সাংসদ গ্রেফতার হননি। তৃণমূল জমানায় লিস্টটা খুব দ্রুত বড় হচ্ছে। হওয়ারই কথা। যে দলের নেত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা জাল, দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্য পুলিশ যাঁকে গ্রেফতার করেছিল সেই লোক যে দলের মুখপাত্র, সেই দল তো দুর্নীতিগ্রস্ত হবেই। আজ থেকে নয়, জন্মলগ্ন থেকে। পঞ্চায়েত থেকে শীর্ষ স্তর পর্যন্ত তৃণমূলের সব জনপ্রতিনিধি ও নেতা বেপরোয়া দুর্নীতিতে যুক্ত। আমাদের কারও কাছে জিনিসটা নতুন নয়। তবু তুমুল উত্তেজনা। রাস্তায়-ঘাটে-বাসে-ট্রেনে। আইটি সেক্টরের কর্মী অফিস আসার পথে মোবাইলে সিনেমা বা সিরিজ দেখতে দেখতে আসেন। তিনি আসছেন খবর দেখতে দেখতে। এতটাই টান! কোটি কোটি টাকার সঙ্গে নেতার একাধিক নারীসঙ্গ। মুচমুচে ব্যাপার!
![]() |
| পুজো উদ্বোধনে মমতা। মঞ্চে কবীর সুমন, অর্পিতা, সুব্রত বক্সি, পার্থ চ্যাটার্জি |
আমরা মধ্যবিত্ত লাফাচ্ছি। কিন্তু আমাদেরই তো কেউ অফিসে-আদালতে-হাসপাতালে দিব্যি ঘুষ নেই বা ঘুষ দেই। বাসে পকেটমার ধরা পড়লে দু-চার ঘা দিয়ে মনের সুখ করি। আর বড়সড় রাঘববোয়ালের সামনে হাত কচলাই। এই হল আমাদের অসততার বিরুদ্ধে লড়াই! হয়তো অর্পিতাদের 'কপাল' দেখে মনে মনে ঈর্ষা হয়। হয়তো তাই সবাই মিলে হামলে পরি। ছিছিক্কার জুড়ে দেই। কিন্তু সুযোগ এলে ছাড়ব কজন?
হুজুগে মাততে জুড়ি নেই আমাদের। এই এখন লাফাচ্ছি। মনে আছে, সিপিএম নেতা গৌতম দেব কুপন কেলেঙ্কারির কথা বলেছিলেন। তখনও তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় আসেনি। আমরা বেশির ভাগই তাঁকে ব্যঙ্গ করেছিলাম। পিঠে বুলেট বিঁধে থাকায় স্নায়ুরোগে আক্রান্ত গৌতম দেব। সেজন্য স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে সমস্যা হয়। তা নিয়েও টিটকিরি করেছি অনেকে। মনে আছে? সিপিএমের অনেক লোকও তাঁদের দলের নেতার কথা বিশ্বাস করেননি।
![]() |
| গ্রেফতার পার্থ চ্যাটার্জি |
-সিপিএম সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য কোর্টে জব্বর লড়েছেন বলে?
-হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি খুব কড়া মনোভাব নেন বলে?
ওই তিন জিনিসের প্রভাব কিছুটা আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ যেটা, যাঁদের জানকসম লড়াইয়ে এত কাণ্ড, তাঁদের খোঁজ কজন নিয়েছি? পার্থ চ্যাটার্জি গ্রেফতারের দিনটা ছিল তাঁদের ধর্নার ৪৯৬ তম দিন। তাঁদের একজনেরও নাম জানি আমরা? জানার চেষ্টা করেছি? তাঁরাই তো আসল হিরো। তাঁরা আপনার-আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ। বাচ্চা কোলে নিয়ে মা বসে ধর্নায়। কথায়-কথায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বমি না করলে যাদের পেটের ভাত হজম হয় না, তাঁরা শুনুন, আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম চাকরিপ্রার্থীরা একসঙ্গে লড়ছেন। ইয়াস-আমফান-ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-শীত অগ্রাহ্য করে তাঁরা লড়ছেন তাঁদের হকের লড়াই। টানা এতদিন ধরে আন্দোলন দিল্লির কৃষকরাও করেননি।

![]() |
| চাকরির দাবিতে হবু শিক্ষকদের ধর্না |
![]() |
| মন্ত্রী কন্যার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জয়ী শিলিগুড়ির ববিতা সরকার |
এটাই আমাদের রাজ্য রাজনীতির সাম্প্রতিক সময়ের বৈশিষ্ট্য। খেয়াল করলে দেখবেন, গত অন্তত দুই দশক ধরে কোনও রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে মানুষের স্বার্থে জানকসম কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। হ্যাঁ, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কথা মাথায় রেখেই বলছি। সাধারণ মানুষ নিজেরা আন্দোলন শুরু করেছেন। কিছু সময় কোনও রাজনৈতিক দল সেটা হাইজ্যাক করেছে, কখনও পারেনি।
একটা জিনিস স্পষ্ট, মানুষের আশা-আকাঙ্খা-দুঃখ-যন্ত্রণাকে বুঝতে পারার ইচ্ছে বা শক্তি চালু রাজনীতির নেই।
৪৯৬ দিন ধরে চলছে অধিকারের লড়াই। এরকম লড়াই আরও অনেক চলছে। অধিকারের লড়াই। কৃষকদের, উদ্বাস্তুদের, কৃষকদের, ছাত্রদের অধিকারের লড়াই নিয়েই গাঁথা হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মালা। সে জন্যই ১৯৪৬ দাঙ্গায় রক্তাক্ত কলকাতায়, বাংলায় দীর্ঘ সময় কোনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথা তুলতে পারেনি। অধিকারের লড়াই না থাকলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথা তোলে, ক্রমশ শক্তি বাড়ায়, ভিত শক্ত করে।
![]() |
ভাবুন তো, মেডিক্যাল রিপ্রেসেনটেটিভদের কাজটা কী? ডাক্তারদের বুঝিয়ে ওষুধ বিক্রি করা। ওষুধের গুণমানেই কি ডাক্তারদের মন ভরানো হয়? নাকি সঙ্গে নানা 'গিফট' আসল খেলাটা খেলে? কোনও জিনিস কিনলে, তার সঙ্গে ফ্রি। সে-ও তো ঘুষ। ঘুষ দেওয়া যে সমাজে, যে ব্যবস্থায় এরকম আইনি, সেখানে দুর্নীতি কোনও ইস্যু হতে পারে? সোজা কথাটা সোজা করেই বলা যাক, ভারতের সমাজ ও রাজনীতিতে দুর্নীতি কোনও ইস্যু নয়। কিন্তু তা নিয়েই আমরা মেতে আছি। বলা ভাল, আমাদের মাতিয়ে রাখা হয়েছে। আমার এই কথাটায় একটু ভুল বোঝার সুযোগ আছে। সেটা পরে বলার চেষ্টা করেছি।
আমি যে খুব বইপত্র পড়েছি, তা নয়। রাজনীতি করার সময়ও না। আমার রাজনীতির ভাবনার দুটো ভিত হল, ১) লড়াই একটাই খেটে খাওয়া বনাম লুটে খাওয়া আর ২) দার্শনিকেরা নানা ভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কথা তাকে পরিবর্তন করা। যে কোনও রাজনৈতিক ঘটনা ঘটলে এই দুটো ভিত্তিকে সামনে রেখে আমি বোঝার চেষ্টা করি।
![]() |
| পার্থর বান্ধবী অধ্যাপিকা মোনালিসা দাস |
এই যে ঘটনা, সেটা তো সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। এবারের বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে সময়ের নানা বৈশিষ্ট্য দেখে, বারবার বলছি, মমতা ব্যানার্জির 'মেয়াদ শেষ'। মমতা নিজেও জানেন, সরকার না থাকলে দলও থাকবে না। তৃণমূলের বেশির ভাগ নেতাই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের। তাঁদের বিজেপি বিরোধিতা পুরোটাই ক্ষমতার জন্য। মমতা হয়তো তাই চাইছেন, সরকার বা দল না বাঁচুক, পরিবার তো বাঁচুক। খেয়াল করুন, মহারাষ্ট্রের ঘটনার পর থেকে কেমন নগ্ন ভাবে অবস্থান বদলালেন মমতা। একুশের সমাবেশ থেকেও কি একুশ কোটির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?
![]() |
| তৃণমূলের অনুষ্ঠানে অর্পিতা |
পার্থ চ্যাটার্জির গ্রেফতারির ইঙ্গিত নিশ্চয়ই আগে থেকেই ছিল। ২১ জুলাই মানচিত্রে পার্থ কার্যত অনুপস্থিত। বাকিরা পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বললেও দলের মহাসচিব সামান্য সময় বললেন চেয়ারে বসে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পাড়ার নিজে থানায় গিয়ে পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের ছাড়িয়ে এনেছিলেন মমতা। রাজীব কুমার বা ববিদের গ্রেফতারির সময়ও মমতা নিজে রাস্তায় নেমেছিলেন। রুজিরাকে বিমানবন্দর থেকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দলের মহাসচিবের গ্রেফতারির ১২ ঘণ্টা পর তৃণমূল প্রেস কনফারেন্স করল। মমতা একটি কথাও বললেন না। অভিষেকও না। একটা টুইটও করেননি।
বাম-কংগ্রেস-বিজেপি, তিন শিবিরই আওয়াজ তুলছে, চোর ধরো, জেলে ভরো। যে সিস্টেমে চুরি নৈতিক, সেখানে এই স্লোগান তোলা তো মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিয়ে সিস্টেমকেই শক্তিশালী করবে।রাজ্যের বাম শিবিরের ফোঁসফাঁস মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় আর মিডিয়ায়। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, ২০১১ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গে 'সত্যযুগ' ছিল। তখন আসানসোল শিল্পাঞ্চলে কয়লার রং কালো ছিল না, তখন খাদানের বালি চোখে ঢুকত না...। বামমনস্ক শুভেন্দু মাইতি একটা গান লিখেছিলেন, '....হাতছানি দেয় জমি বেচার টাকা...আমরা দাঁড়াব কোনখানে বলো, দাঁড়াব কোনখানে?' মিছিমিছি লিখেছিলেন।
আমি নিজেও ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এবং মাঠে ঘুরেই রাজনীতি করতাম। ফলে সাপের গর্ত, ইঁদুরের গর্ত দেখার সুযোগ হয়েছে। রাজনীতি থেকে সরে আসার পরেও খোঁজখবর রাখার সুযোগ ছিল ও আছে। মুশকিল হল, তখনকার মতো এখনও সিপিএমের ভিতরে একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। এই নেতা ওই নেতার বিরুদ্ধে। এই নেতার অনুগামীরা ওই নেতার অনুগামীদের বিরুদ্ধে। কখনও কখনও সোশ্যাল মিডিয়া বা পাড়ার ঠেকও মাতিয়ে দেন। তাই না?
![]() |
| সিপিআইএম নেতা গৌতম দেব |
আমি নিজেও ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এবং মাঠে ঘুরেই রাজনীতি করতাম। ফলে সাপের গর্ত, ইঁদুরের গর্ত দেখার সুযোগ হয়েছে। রাজনীতি থেকে সরে আসার পরেও খোঁজখবর রাখার সুযোগ ছিল ও আছে। মুশকিল হল, তখনকার মতো এখনও সিপিএমের ভিতরে একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। এই নেতা ওই নেতার বিরুদ্ধে। এই নেতার অনুগামীরা ওই নেতার অনুগামীদের বিরুদ্ধে। কখনও কখনও সোশ্যাল মিডিয়া বা পাড়ার ঠেকও মাতিয়ে দেন। তাই না?
এই যে পরেশ অধিকারী, তৃণমূল সরকারের যে মন্ত্রীর মেয়ের চাকরি গেল, তিনি তো বাম সরকারের আমলেও মন্ত্রী ছিলেন এবং পরিবারের অনেকের চাকরির বন্দোবস্ত করেছিলেন।
আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধু আছে, নন্দন ভট্টাচার্য। পড়াশোনা-লেখালেখি আর নাটক (গড়িয়া সুচর্চা) নিয়েই আছে। চারপাশটা দেখতে দেখতে ওঁর একটা পছন্দের বাক্য মনে এল, হাসি পায় মন্থরার চাপদাড়ি দেখে।
![]() |
| গ্রেফতার পার্থ |
তৃণমূল দলটার গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে। ছোট নেতাদেরই সম্পত্তি দু-চার কোটি। মাঝারি থেকে যত বড় হবে তত একশো দুশো হাজার দু হাজার পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বাড়ি গাড়ি নারী। মমতা কী বলেন? আমাদের টাকা নেই। কী বলেন? চুরি করা যাবে না। একে বলে বিশুদ্ধ ন্যাকামো। তিনি সব জানেন। তাঁর মদত ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। দল পুরোপুরি দুর্নীতিতে ডুবে। দলনেত্রী পরিচ্ছন্ন? অসম্ভব!
সারদা কাণ্ডে কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করেছিল মমতার সরকার। সে সব গল্প আর বলছি না। সেই কুণাল এখন তৃণমূলের সরব মুখপাত্র। মুখপত্র জাগো বাংলা তিনিই দেখেন। গ্রেফতার হওয়ার পর কুণালকে দল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি। আর পার্থ গ্রেফতারের পর কুণাল বলছেন, দুর্নীতি করলে তৃণমূল কড়া ব্যবস্থা নেয়।
তবু তৃণমূল ভোটে যেতে কেন? অনেকে গম্ভীর মুখে বলবেন, নানা সরকারি প্রকল্পের ঘুষ দিয়ে মানুষকে কিনে ভোটে জেতে তৃণমূল। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। তাই অসাধারণ মানুষদের মত সাধারণ মানুষকে ওরকম ভিখারি ইত্যাদি ভাবতে পারি না। অন্তর থেকে বিশ্বাস করি, মানুষই ইতিহাস তৈরি করেন। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
আবার বলছি, ভারতীয় রাজনীতিতে দুর্নীতি কোনও ইস্যু নয়। তার মানে দুর্নীতি নৈতিক সেটা বলছি না। তার মানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব না হতেও বলছি না। রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় ইস্যু বাছাই করতে হয়, যা সামাজিক-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে পারে। একমাত্র তাহলেই পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনা যায়। ভূমিসংস্কার ও অপারেশন বর্গা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক বদল এনেছিল বলেই তা দীর্ঘ সময়ের বামফ্রন্ট সরকারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। বাম জমানায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক জমিদারী ব্যবস্থার মাথাদের থেকে আমজনতাকে যখন বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছেন, তখনই মমতা ক্ষমতায় আসতে পেরেছেন। বিজেপি নিজের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেছে, করছে এবং করবেও। এই ব্যবস্থায় দুর্নীতির কথা বলে যাওয়া আসলে মূল সমস্যা থেকে চোখ ঘুরিয়ে দিতেই বলা হয়।
এখন দুনিয়ার ধনীদের মধ্যে চার নম্বরে গৌতম আদানি। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ১১,৫৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ সালে তাঁর সম্পত্তি ছিল ২৮০ কোটি টাকা আর ২০১৮ সালে ১,১৯০ কোটি টাকা। সেই ২০০০ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদীর খুব কাছের মানুষ আদানি খুব দ্রুত টপকে গেছেন আম্বানিকে। মার্চের শেষে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আদানি গ্রুপের মোট ঋণ ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবসা বাড়াতে আদানি গ্রুপের ঋণ ৪২% বেড়েছে। কে ঋণ দিয়েছে? রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ক, যেখানে আমি-আপনি টাকা জমা রাখি। মানে আমাদের টাকায় ব্যবসা করে, মোদীর কৃপায় সম্পদের পাহাড়ে চড়ে বসেছেন গৌতম আদানি।
একটা সময়ের পরে ঋণ মেটাতে না পারলে ব্যাঙ্ক কী করে? আমাদের বাড়ি-গাড়ি ক্রোক করে। আর শিল্পপতিদের ক্ষেত্রে? সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, ভারতে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির সংখ্যা ২০১২ সাল থেকে প্রায় ১০ গুণ হয়ে গিয়েছে, টাকার অঙ্ক ২,৪০,০০০ কোটি টাকা (তালিকায় মেহুল চোকসির নাম থাকলেও নেই বিজয় মালিয়া ও নীরব মোদীর নাম। মানে প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।
বগটুই-হাঁসখালি-দুই কাউন্সিলর খুন...রাজ্যে পরপর অনেক ঘটনা ঘটছিল। কোর্ট থেকে একের পর এক সিবিআই তদন্তের নির্দেশ। সেসময় একটা লেখায় আমার মনে হওয়াটা বলেছিলাম। শিক্ষক-চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন আর আনিস খানের মৃত্যু, এই দুটো নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে হয়েছিল। আনিসের বাবাকে দলের মঞ্চে বসিয়ে তার বারোটা বাজানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মাননীয় মহম্মদ সেলিম। আর চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের খেল তো দেখতেই পাচ্ছি।
![]() |
| অভিষেক ও শুভেন্দু |
বিজেপির ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, দুর্নীতি তাদের কাছে অস্পৃশ্য। নারদ ফুটেজে শুভেন্দু অধিকারীকে দেখা গিয়েছিল। ওই মামলায় ৪ তৃণমূল নেতা গ্রেফতার হলেও শুভেন্দুর কিস্যু হয়নি। চার্জশিটেও তাঁর নাম নেই। যেমন কয়লা পাচার মামলার চার্জশিটে নাম নেই অভিষেক বা তাঁর স্ত্রী রুজিরার। বিমানবন্দরে রুজিরা নেরুলার গয়নার ব্যাপারটাও বেশি দূর গড়ায়নি কিন্তু। সারদা কাণ্ডে তৃণমূলের একাধিক নাম যেমন জড়িয়েছে তেমনই জড়িয়েছে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার নাম। হিমন্ত কেন কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গেলেন? জাতীয় স্তরের কোন তারকা সাংবাদিক দলবদলে মধ্যস্থতা করেছিলেন? আশা করি, উত্তরটা দেবেন বিজেপি নেতারা। মুকুল রায়কেও জেলে যেতে হয়নি।
দুর্নীতি বিজেপির অস্ত্র, যা ব্যবহার করে অন্যদের ঘর ভাঙানো যায়।
এখানে আমরা একশো-দুশো কোটি নিয়ে হইচই করছি। কারণ আমরা অভ্যস্ত নই। ঘুষ দিয়ে চাকরি কেনার টাকা। আর বিজেপি তো ঘুষ দিয়ে আস্ত সরকারই কিনে নেয়। যেমন এই কিছুদিন আগে মহারাষ্ট্র্রে হল। কত খরচ হয়েছে? কেউ বলছে তিন হাজার কোটি, কেউ বলছে পাঁচ হাজার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, না খায়ুঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। তা নিয়ে ভক্তকূল খুব হইচই করে।সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাঙ্কগুলিতে ভারতীয়দের জমা টাকার পরিমাণ ৩০,৫০০ কোটি, গত ১৪ বছরে সর্বোচ্চ।
২০২১ সালের দুর্নীতি সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে ভারত ৮৫ নম্বরে। রিপোর্টে ভারত সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বিশেষত ভারতের ব্যাপারটা খুব দুশ্চিন্তার। তাদের স্কোর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও দুর্নীতি কমানোর ব্যবস্থাপনা দুর্বল হচ্ছে। দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মৌলিক স্বাধীনতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা কমছে। সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা পুলিশ, রাজনৈতিক জঙ্গি, দুষ্কৃতী গ্যাং, দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় অফিসারদের হামলার শিকার হচ্ছেন। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে, তাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তোলা হচ্ছে, ঘৃণ্য ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, বিদেশী টাকা নেওয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। দুর্নীতি ঠেকানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানুষের কথা বলার অধিকার।
অশোক স্তম্ভ লাগানো নোটিশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক ভাবে টাকা নেওয়া হয়েছে পিএম কেয়ার ফান্ডের জন্য। পরে জানা গেল, ওই তহবিল সরকারি নয়। আরটিআই করে তার হিসেব জানা যাবে না। সিএজি-ও তার তহবিলের লেনদেন দেখতে পারবে না।
![]() |
| গৌতম আদানি ও নরেন্দ্র মোদী |
![]() |
| আদানির জন্য মোদীর ওকালতির নথি |
এগুলোকে চুরি বললে কম বলা হবে। পুকুর চুরি বলাও ভুল হবে। সমুদ্র ডাকাতি বললে কিছুটা বোঝা যেতে পারে। এর কাছে অভিষেক-পার্থ-অনুব্রতরা নেহাতই শিশু। তাই না?
না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। শ্রীলঙ্কায় একটি বায়ু-বিদ্যুৎ প্রকল্পের বরাত আদানিদের দেওয়ার জন্য স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে বলেছিলেন। তা নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছে এবং সংসদীয় কমিটির কাছে ওই কথা বলা আধিকারিক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
না খায়ুঙ্গা, না খানে দুঙ্গা!
![]() |
| রাজ্য রাজনীতির মাইলস্টোন। চাকরির দাবিতে হবু শিক্ষকদের ধর্না |
আদালতের নির্দেশে এক মন্ত্রীর মেয়ের চাকরি গেছে। সেই মন্ত্রীর চাকরি কিন্তু আছে। তাঁকে সরানোর দাবিতে আন্দোলন আছে? আদালতের নির্দেশে মন্ত্রীর মেয়ের বিরুদ্ধে মামলাকারী চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ধর্নায় বসে আছেন ন্যায্য চাকরির দাবিতে, তাঁদের কী হবে? অবিলম্বে তাঁদের চাকরিতে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন আছে কোনও?
রাজনীতি করতে গিয়ে শিখেছি, লড়াই না করে খেটে খাওয়া কিছু অর্জন করতে পারে না। সেই লড়াই থেকেই খেটে খাওয়া তাঁর বন্ধু চেনে, শত্রু চেনে। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের চোয়াল কষা লড়াই শেখাচ্ছে। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার লড়ে নিতে হয়। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, লোকদেখানো না হয়ে আন্দোলন আন্তরিক ও শেষ দেখে ছাড়ব মনোভাবের হলে তা সফল হতে বাধ্য।যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে। তাতে আমজনতার পেট ভরবে না। তাঁর জন্য চাই অধিকারের লড়াই। কাজ। কাজ। এবং কাজের দাবিতে এসপার-ওসপার লড়াই। কাজের ব্যবস্থা করা গেলেই রাজ্যের এই নোংরা হতে থাকা রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশটা বদলানো যাবে। দেশ-দুনিয়ার সামনে রাজ্যের হেঁট হয়ে যাওয়া মাথাটা তুলে দাঁড়ানো যাবে। নয়তো রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বিদ্বেষ ভরা কুঠুরিতে বন্দি হতে হবে। শুধু সম্প্রীতির গান গেয়ে বেড়ালে সম্প্রীতি হয় না। সাপ তাড়াতে কার্বলিক অ্যাসিড লাগে।
আমাদের রাজ্যে কাজের সুযোগ নেই। একমাত্র আয়ের জায়গা পার্টি। সেখান থেকেই দুর্নীতি-খুনোখুনি। পার্টির একাধিপত্য। কাজের সুযোগ তৈরি করা গেলে কেউ আর ওই রাজনীতির উঠোন মাড়াবে না। শুধু দিতে হবে, দিতে হবে আন্দোলন নয়, কী ভাবে কাজের সুযোগ তৈরি করা যায় সেটাও আন্দোলনকেই ভেবে বের করতে হবে। তার সঙ্গে একের পর এক দুর্নীতিতে চোখ বন্ধ করে থাকা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি।
আবার বলছি, শুধু দুর্নীতি নিয়ে হইচই করলে দুর্নীতি যাবে না। তৃণমূলের আস্ত সরকার ও দলটাকেই জেলে ঢুকিয়ে দিলেও লাভ হবে না। ওষুধ একটাই-রূপসী বাংলার উপোসী মানুষের লড়াই। (একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এক ভদ্রলোকের লেখা লাইনটা বেশ ভাল লাগল, তাই সেটাই ব্যবহার করলাম।)
ইতিবাচক মনোভাবের নতুন রাজনীতির উপর ভর করে তৈরি হবে নতুন পশ্চিমবঙ্গ। নয়তো হারিয়ে যেতে হবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চোরাবালিতে, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও।

















