ভালো ফুটবল খেলতেন। গোলকিপার।
ভলিবলেও দক্ষ ছিলেন।
ওপার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন স্বাধীনতার আগেই। গুপ্তিপাড়ায় মামাবাড়িতেই লেখাপড়া। মামারা ছিলেন কংগ্রেস। তাঁদের প্রভাবে জড়ান গ্রাম সংস্কারের কাজে।
স্কুলের এক শিক্ষক আর কলেজপড়ুয়া দাদার পাল্লায় পরে বামপন্থায় হাতেখড়ি।
গুপ্তিপাড়া স্কুল, হুগলি মহসিন কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এম কম, কস্টিং, তারপর এজি বেঙ্গলে চাকরি। তখনই চুটিয়ে রাজনীতি শুরু।
জরুরি অবস্থার সময় মিসা আইনে গ্রেফতার। চাকরিও যায়।
১৬ মাস বন্দি ছিলেন আলিপুর সেন্ট্রাল আর বহরমপুর জেলে। সহবন্দিদের মধ্যে ছিলেন সুশীল ধাড়া (স্বাধীনতার আগে তৈরি হওয়া স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সরকারের সশস্ত্র সেনাদল 'বিদ্যুৎ বাহিনী'-র সর্বাধিনায়ক। বাংলা কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ), দীপেন ঘোষ (কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের নেতা, প্রাক্তন সাংসদ) প্রমুখ।
রাজনৈতিক কারণে বন্দি, কিন্তু রাজবন্দীর মর্যাদা নেই। খাবারদাবার জঘন্য। তাই অনশন। তাতে কাজও হয় কিছুটা।
সাতাত্তরে কেন্দ্রে জনতা পার্টি আর রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার। চাকরি ফিরে পেলেন। মামলাও উঠল।
সবাই জানি, মেরুদন্ড টানটান মানুষদের কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়।
মহিলা সহকর্মীর অনৈতিক বদলি রুখতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়লেন ১৯৮৭ নাগাদ। ইউনিয়ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপসের রাস্তায় হাঁটার ইঙ্গিত দিলেও তিনি নারাজ। নেতারা পাঠালেন জ্যোতি বসুর কাছে। তিনি বললে ফেলতে পারবেন না।
তিনি আগেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। সব শুনে জ্যোতি বসুও সহমত। আশ্বাস দেন, তাঁর পাশে ইউনিয়ন থাকবে। ছিলও।
অতঃপর ১৯৮৭ সালে ভিআরএস।
পরে মামলায় জয় হয়। কিন্তু তদ্দিনে অবসরের বয়স হয়ে গিয়েছে।
শান্ত, অল্প কথা বলা মানুষটাকে দেখলে বোঝা যেত না, এতো আগুন জমা ভেতরে।
সাধারণ, খুব সাধারণ অনেক মানুষের মধ্যে অসাধারণ জীবন লুকিয়ে থাকে। কেন জানি না, বরাবর সেরকম মানুষদের কাছ থেকেই আমি বেশি শিখি, বেশি শিখেছি। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আবার ধ্রুবতারার মতো থেকে যান।
তেমনই এক মানুষ পরিতোষ বিশ্বাস। রবিবার কাকভোরে ঘুম ভাঙলো তাঁর মৃত্যু সংবাদে।
ওঁর মেয়ে পৃথা তখন সম্মিলিত গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। ওর জ্যাঠতুতো দিদি শান্তা ছিল এসএফআই লোকাল কমিটির নেত্রী, আমার সহযোদ্ধা। স্কুল ছুটির পর পৃথার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কুসুমকানন মোড় বা ওদের বাড়ির কাছাকাছি যেতাম প্রায় দিনই। পৃথা এসএফআই-এর কাজে যুক্ত হওয়ার পর একদিন ওদের বাড়িতে কাকুর সঙ্গে পরিচয়।
আমাদের অন্যরা কাকুর সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেত। প্রথম দিকে আমিও কথা বলতাম ভয়ে ভয়ে। খুব কম কথার মানুষ। গম্ভীর। ভয় একটু কাটতে কথা বাড়ল। কথা বলে বেশ আরাম হত। গভীর জীবনবোধ, টনটনে রসবোধ ভরা টুকরো টুকরো কথা। তবে খুব গভীর সম্পর্ক যে গড়ে উঠেছিল, তা নয়। ওঁর বাড়ি গেলে বা পার্টির কোনও কর্মসূচিতে দেখা হতো।
২০০১ সালে আমি রাজনীতি থেকে সরে আসার পর সম্ভবত কাকুর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
আমার অদ্ভুত একটা মনে হওয়া আছে, এরকম প্রিয় মানুষদের মরদেহ খুব বাধ্য না হলে, দেখতে যাই না, তাতে পরের সময়টাতেও কেমন যেন মনে হয়, তিনি বেঁচে আছেন। কাকুর মরদেহও দেখতে যাইনি।
আমার স্মৃতিশক্তি বড় দুর্বল। তাই বহু ঘটনা ভুলে যাই, ভুলে গেছি। আর কাকু নিজের সম্পর্কে বলতেন বড্ড কম। পৃথা বলল, ওই জ্যোতি বসুর কাছে যাওয়ার ঘটনাটা ও প্রথম বার শুনেছে মাস দুই আগে।
পৃথা মাধ্যমিকের পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে গেছে। তখনই ওর মা মারা যান। কাকুই পৃথাকে সেন্টার থেকে আনতে যান। রাস্তাতেই মেয়েকে মায়ের মৃত্যু সংবাদ জানান। বাপ কি বেটি। মা মারা যাওয়ার পরের দিন অঙ্ক পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল পৃথা। সেবার অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ায় আবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিয়েছিল পর্ষদ। পৃথা সে সুযোগটা নিতে চায়নি। আমাকে অবাক করে কাকু জিজ্ঞেস করেছিলেন, পৃথার কি পরীক্ষায় বসা উচিত? বলেছিলাম, ও যা চায় সেটাই করুক। কাকু খুশি হয়েছিলেন। তিনিও সেই মনোভাবেরই ছিলেন। পৃথা অঙ্কে ৯৯ পেয়েছিল।
পৃথা উচ্চমাধ্যমিকের আগে টিউশন পড়তে যাওয়ার পথে হঠাৎ গড়িয়া কলেজে আমার কাছে এল। ও পরীক্ষায় বসবে না। কারণ কী একটা বলেছিল, ঠিক খেয়াল নেই। কলেজ থেকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে টিউশন বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে ফিরে আসতাম। দিন দুই-তিন হয়েছে এরকম। একদিন হঠাৎ দেখি, কাকু কলেজে হাজির। কোনও ভাবে জেনেছেন। হয়তো পৃথাই বলেছিল। বললেন, জোর করে ওকে পরীক্ষায় বসিও না। কী অদ্ভুত মানুষ! ছেলেমেয়ের স্বাধীনতার জন্য কতটা বিস্তৃত ক্ষেত্র দিয়েছিলেন। তাদের বিবেচনা বোধের ওপর কী অসীম আস্থা ছিল। পৃথা আর ওর ভাই প্রদীপ, তার ফসল।
পরবর্তীতে পৃথার একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার আপত্তি আছে বুঝতে পেরে বলেছিলেন, ওকে ওর মতো সিদ্ধান্ত নিতে দাও। তুমি বললে ও দ্বিধায় পড়ে যেতে পারে।
বাঘাযতীন বয়েজ স্কুলের সম্পাদক, নাগরিক আন্দোলন, প্রান্তপল্লি স্কুলের উন্নয়ন...নানা কাজে মেতে থাকতেন। আর ছিল লাইব্রেরি গড়ার নেশা। লাইব্রেরি বানিয়েই ছেড়ে দিতেন না, তাকে সচল রাখতে দিনের পর দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে লোক জোগাড় করতেন।
আদ্যন্ত রাজনৈতিক একজন মানুষ আজীবন সক্রিয় থেকেছেন সামাজিক নানা উদ্যোগে, অতি অনায়াসে পার্টিগত পরিধি অতিক্রম করে।
ফরাসি, জার্মান, উর্দু জানতেন। বাংলা ইংরেজি হিন্দি তো ছিলই।
এতো বহুমুখী প্রতিভা। কিন্তু দেখনদারি ছিল না। দেখে বোঝাই যেত না কতটা গভীর মানুষ ছিলেন তিনি।
![]() |
| 'গণদর্পণ' সংস্থার সম্পাদক শ্যামল চ্যাটার্জি |
এমন মানুষদের শেষবেলাটাও হয়তো এমনই হয়। দেহ আর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছিলেন কাকু।
আমার এক সহকর্মী 'গণদর্পণ' সংস্থার সম্পাদক শ্যামল চ্যাটার্জির নম্বর দিলেন। সাতসকালে ফোন করতেই সক্রিয় সেই প্রবীণ মানুষটি। দ্রুত চক্ষুদানের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু সেদিন যে রবিবার। কোনও হাসপাতালে মরদেহ দান করা যাবে না।
একদিন মরদেহ রাখতে হবে। শ্যামলবাবুর কথা পৃথাকে বলতেই ও রাজি। ওর ভাইও রাজি।
-দাঁড়াও, বড়মার (জেঠিমা) সঙ্গে কথা বলি। বড়মা যা বলবে তাই হবে।
ওদের আশ্চর্য বাড়িটার মানুষগুলোকে চিনতাম। তাই জানতাম পৃথার বড়মার রায় কী হবে। একদিন মরদেহ রাখতে বললেন। পরদিন দেহ দান করা হলো এনআরএসে।
টানা দু'দিন ঘন ঘন ফোন করে গেলেন শ্যামলবাবু। সব ব্যবস্থা করলেন। 'গণদর্পণ' বলতে সবাই চিনি ব্রজ রায়কে। তাঁর মৃত্যুর পরে সংস্থার সম্পাদক এখন শ্যামলবাবু।
শ্যামল চ্যাটার্জি, যিনি প্রৌঢ় বয়সেও ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। লেগে আছেন দেহদান আর চক্ষুদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, তাকে শক্তিশালী করতে। কী আশ্চর্য নিষ্ঠা! দেহদান করা হবে।হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়েই ছেড়ে দিতে পারতেন। করেননি। লেগে ছিলেন শেষ পর্যন্ত।
সব মিটে যাওয়ার পর আমাকে ফোন করলেন।
-ওঁরা ফোন করেছিলেন। বললেন, কোনও অসুবিধা হয়নি। তবে ওঁরা সংকোচে না-ও বলতে পারেন। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কোনও অসুবিধা হয়নি তো?
কী বলব? শ্যামলবাবু, আপনার মতো মানুষেরা থাকতে অসুবিধা হতে পারে?
http://www.ganadarpanindia.in/
এক আশ্চর্য সাধারণ মানুষের অ-সাধারণ জীবন। তাঁর মৃত্যুর পরেও আরও কত সাধারণ জীবনের অ-সাধারণ গল্প।
শ্যামল চ্যাটার্জি। পৃথার বড়মা। পৃথা আর ওর ভাই প্রদীপ।
কত অ-সাধারণ সব সাধারণ মানুষ! এঁদের জন্যই পৃথিবীটা রঙিন। ফুল ফোটে। পাখি গায়।
ওঁদের সবাইকে আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন।








