এক রূপকথার গল্প বলতেই এই লেখা। বলা ভাল, মনে সেই রূপকথা যে ছাপ ফেলেছে তারই প্রকাশ ঘটানোর ইচ্ছে
![]() |
'...দূরে কোথাও দু এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।'
জীবনও তো তেমনই। মন খারাপ করা, মন ভার করা নানা ঘটনা সরিয়ে রেখে হঠাৎ কখনও ইচ্ছেরা ডানা মেলে।...
...অনিচ্ছাতেও লাফায় খালি তিড়িংবিড়িং।
২৫ জুন।
![]() |
| বিশ্বজয়ী ভারত |
| বরুণ সেনগুপ্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত ও গৌরকিশোর ঘোষ |
![]() |
| জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গৌরকিশোর ঘোষ |
![]() |
| অমরনাথে ধ্যানস্থ প্রধানমন্ত্রী |
ঠিক তার পরের দিন, মানে ২৫ জুন, মানে ৪৭ বছর আগে যেদিন জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, সেদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, "শিব যেমন কণ্ঠে বিষ ধারণ করেছিলেন, ঠিক তেমনই নরেন্দ্র মোদী দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু একটি কথাও বলেননি ৷ তিনি অনেক বড় মনের বলেই পেরেছেন। সুপ্রিম কোর্ট সব অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে৷ সোনার মতোই সত্যও উজ্জ্বল৷"
গুজরাটের তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একটি সংবাদ সংস্থাকে তিনি বললেন, ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ছিলেন সমাজকর্মী তিস্তা শীতলওয়াড় সহ আরও কয়েকজন।
![]() |
| আর বি শ্রীকুমার, সঞ্জীব ভাট এবং তিস্তা শীতলওয়াড় |
কতো কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। গোধরায় ট্রেনে জ্বলন্ত পুড়ে মৃত্যু করসেবকদের। তারপর দাঙ্গা। হাজারের বেশি মৃত্যু। ২/৩ মুসলিম, ১/৩ হিন্দু। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক প্রাক্তন সংসদ এহসান জাফরিও।
![]() |
| গোধরায় ভস্মীভূত ট্রেনের কামরায় নরেন্দ্র মোদী |
![]() |
| নিহত প্রাক্তন সাংসদের স্ত্রী জাকিয়া জাফরি। |
মোদীর বিরুদ্ধে কথা বলা প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কট্টর আরএসএস কর্মী হারিন পান্ডিয়া খুন হয়ে গেলেন। গাড়িতে মৃতদেহ পড়ে থাকল ঘণ্টা দুই।
এনকাউন্টারের সোহরাবুদ্দিন শেখের মৃত্যু। অমিত শাহ গ্রেফতার।
তখন থেকে পরের ১২ বছর মোদীর কাজের সার্টিফিকেট দিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক এবার মোদী বিরোধীদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী!
দাঙ্গার পর বিধানসভা ভোটে মোদীর বিপুল জয়। যিনি ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি এখন মোদী বিরোধীদের এককাট্টা করার মূল পান্ডা!
গুজরাত দাঙ্গার দুই মুখ অশোক পারমার আর কুতুবউদ্দিন আনসারি অতীতকে পেছনে ফেলে বন্ধু হয়ে গেলেন।
![]() |
| অশোক পারমার। ২০০২ |
![]() |
| কুতুবুদ্দিন আনসারি। ২০০২ |
![]() |
| অশোক ও কুতুব। এখন |
এবছর ২৫ জুন লেখা হল আরও একটা রূপকথার গল্প।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ থেকে। নোবেল জয়ী এক বাংলাদেশী দুর্নীতির অভিযোগ করায় প্রকল্প থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, কারও টাকা লাগবে না, সরকার নিজের খরচেই এই সেতু বানাবে।
বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশ। সে একার জোরে এতবড় কাণ্ড করতে পারবে? সত্যি বলতে দুনিয়া বিশ্বাস করেনি। চিন ঝোল নিজের কোলে টানার চেষ্টা করতেই বাংলাদেশ সমঝে দেয়। প্রবল প্রতিপত্তিশালী চিনের ভয়ে গুটিয়ে থাকেনি।
![]() |
| পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা |
![]() |
| লর্ডসে মহারাজ |
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জেদের, আত্মসম্মানের প্রতীক। একটা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে একটা জাতি এ ভাবে কোথাও মেতে উঠেছে বলে জানা নেই। আসলে এটা ঠিক সেতু নয়। আমরাও কিছু করতে পারি---এই গণউন্মাদনা তারই বিজ্ঞাপন।
ও পারেই একসময় আমার পরিবারের বসত ছিল। ওপারে কখনও যাইনি। কিন্তু ওপার টানে চুম্বকের মতো। আমার কাকু কৃষিবিজ্ঞানী। আন্তর্জাতিক কোনও প্রজেক্টের কাজে বহু বছর বাংলাদেশে থেকেছে। সে সব কথা বলার সময় কাকুকে কেমন আশ্চর্য উজ্জ্বল লাগে। ওপার আমার দেশ না। তবে ওপারের বাঙালির সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে। তাই ওপারের জেদে, সাহসে অর্জিত সাফল্য এপারের এক বাঙালিকেও উজ্জীবিত করে। যারা হিন্দু-মুসলিমে নিজেদের ভাগ হতে দিইনি, তেমন এক বাঙালি হিসেবে এ যেন আমারও জয়।
![]() |
| ২৬ জুন যান চলাচল শুরু হল পদ্মা সেতুতে |
তখন শিল্প গড়তে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি লাগত।
হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস। প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছিল মোরারজি দেশাই সরকার। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আটকে রাখলেন লাইসেন্স। অথচ গুজরাটে রিলায়েন্সকে পেট্রোকেম করার অনুমতি দেওয়া হল।
![]() |
| হলদিয়া পেট্রোকেমের শিলান্যাসে রাজীব গান্ধী। পাশে জ্যোতি বসু |
![]() |
| হলদিয়া পেট্রোকেম |
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন উদ্বোধন হল ১৯৮৪ সালে। কিন্তু অনেক কাজ বাকি। এক টাকাও দিল না কেন্দ্র। রাজ্যের মানুষই দায়িত্ব নিলেন।
![]() |
| যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন |
![]() |
| বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র |
বিভিন্ন সংগঠন টাকা তোলা শুরু করল। রক্ত বিক্রি করে বক্রেশ্বরের জন্য টাকা তোলার ডাক দিল বাম ছাত্র যুবরা। কোনও সন্দেহ নেই, প্রতীকী আন্দোলন এটা।
আনন্দবাজার ব্যঙ্গ করে সম্পাদকীয় লিখল, বাঙালির বাচ্চার রক্তের তেজ। বোঝাতে চাইল, রক্ত বিক্রি করে কত উঠবে? তা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়? লেখা হল, রাখার ব্যবস্থা নেই তাই সংগৃহীত রক্ত ড্রেনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
কংগ্রেসের এমপি, মন্ত্রী কেউ রাজ্যের পাশে নেই। কেন্দ্রের কাছে দাবি জানাতে যাওয়ার জন্য জ্যোতি বসু রাজ্যের সব এমপিদের মিটিং ডাকলেন। মিটিং থেকে বেরিয়ে গেলেন মমতা আর অজিত পাঁজা। প্রিয়রঞ্জনরা থেকেও কোনও কাজে লাগেননি। সিপিএম ছাড়া বাকি বাম শরিকরাও ছিল হাত গুটিয়ে।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে। শঙ্কর সেনের মন্ত্রী থাকার সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রাজ্য।
হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস হয়েছে।
সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স (এখন তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র) হয়েছে।
যুবভারতী আঅন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম হয়েছে।
বাঙালির বাচ্চা সেদিন রক্তের তেজ দেখিয়েছে।
![]() |
| সুভাষ চক্রবর্তী ও জ্যোতি বসু |
হার না মানা মনোভাব নিয়ে লড়ে যাওয়া। লড়তে লড়তে হারা ম্যাচ জিতে আসা। ১৯৮৩ সালের লর্ডসে যেমন কাণ্ড করেছিলেন কপিলরা।
তারপর থেকে ক্রমাগত আমরা ডুবে গেছি ক্ষমতা ধরে রাখা আর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার নেতিবাচক আন্দোলনে। এখন আমাদের উৎসাহ অনুব্রতর চড়াম চড়াম বা গুড় বাতাসা, শোভন-বৈশাখী, দিলীপ ঘোষ, সেলিম-আব্বাসে।
আসলে ইতিবাচক কিছু করতে গেলে সাহস লাগে। নৈতিক সততা লাগে। জেদ লাগে। মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালবাসা লাগে।
![]() |
| পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান |
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতির বিপুল বদল ঘটিয়ে দেবে। শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারত সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব দেশ সুফল পাবে। কলকাতার অনেক কাছাকাছি চলে আসবে ঢাকা। উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলো বাড়তি সুবিধা পাবে। ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে পদ্মা সেতু। ট্রেনে সিঙ্গাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে ইউরোপ।
পদ্মা সেতুর সাফল্য হয়তো আগামী বছরের ভোটে শেখ হাসিনাকে সুবিধা দেবে। হয়তো সেজন্যই বিএনপি প্রচার শুরু করেছিল, সেতুর শিলান্যাস করেছিলেন খালেদা জিয়া। হয়তো সে জন্যই ভাষণে হাসিনা বললেন, খালেদা জিয়া দেখে যান পদ্মা সেতু হয়েছে।
এসব অর্থনীতি আর রাজনীতির অঙ্কে পদ্মা সেতুকে বুঝতে চাই না।
আমাজনের পরেই সবচেয়ে খরস্রোতা পদ্মাকে বাগে এনে সেতু।পদ্মা সেতু দেখাল, বাঙালি মরে নাই। দেখাল, বাঙালির বাচ্চার রক্তের তেজ কমেনি এতটুকু।
![]() |
| পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাসিনা |
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’৪১ বছর পর তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি।’



























