![]() |
| 'অগ্নিপথ' বিরোধী আন্দোলনে ট্রেনে আগুন |
(প্রথম পর্বের পর)
https://jachchetaii.blogspot.com/2022/06/agnipath-bulldozer.html)
সেনাবাহিনীতে নতুন নিয়োগ পদ্ধতি 'অগ্নিপথ' (Agnipath)। তিন বাহিনীর প্রধানকে পাশে বসিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করার পরের দিন থেকেই দেশের একাধিক রাজ্যে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। কোথায় কোথায় বেশি অশান্তি হল? কারা করল?
দেখা যাবে, উন্নয়নের দিকে থেকে দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোয় বেশি অশান্তি। বিশেষত পূর্ব ও উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোয়। (Protests against Agnipath recruitment scheme)
এরকম সব হিংসাত্মক বিক্ষোভেই যুক্ত থাকে কমবয়সী, শিক্ষা ও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকারাই। সেটা 'নবীর সম্মান রক্ষা'র নামে হোক কিংবা 'অগ্নিপথ' প্রকল্পের বিরোধিতায়। কখনও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শুরু হয়, কখনও তা সংগঠিত করা হয়।
কখনও দেখেছেন দাঙ্গা বা কোনও হিংসাত্মক বিক্ষোভে আর্থিক-সামাজিক-শিক্ষাগত ভাবে উপরের দিকের লোক জড়ান বা তাঁদের ক্ষতি হয়? দেখা যাবে, দাঙ্গায় লড়াই হয় মুসলিমদের সঙ্গে দলিতদের। দুই অংশই আর্থিক-সামাজিক-শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে। 'নবীর সম্মান রক্ষা' বা 'অগ্নিপথ' প্রকল্পের হিংসাত্মক বিরোধিতাতেও তারাই সক্রিয়। আবার হিংসা ছড়ানোয় তাঁরাই শাসকের শাস্তির মুখ পড়েন।
ডোমজুড়ে ১১ ঘণ্টা বোম্বে রোড অবরোধ, উলুবেড়িয়ায় ভাঙচুর-আগুন কিংবা 'অগ্নিপথ' প্রকল্পের বিরোধিতায় যে হিংসাত্মক আন্দোলন হচ্ছে, তা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু দাবিগুলো? (Violence over Prophet row)
সত্যিই তো নূপুর শর্মা (Nupur Sharma) মন্তব্য হজরত মহম্মদকে অসম্মান করার জন্যই। অনেকে বলছেন, মহম্মদের আয়েশাকে বিয়ে সংক্রান্ত যে তথ্য দিয়েছেন নুপূর, সেটা কি অসত্য? সে তথ্য তো কোনও মুসলিমও অস্বীকার করেন না। কিন্তু সেই তথ্য দিয়ে নূপুর শর্মা মহম্মদকে বললেন 'শিশুকামী'। এ তো ইচ্ছাকৃত অপমান।
আবার 'অগ্নিপথ' প্রকল্প সত্যিই তো সেনাবাহিনীতে নিয়োগ কমাবে, জীবনের নিরাপত্তা কমাবে। তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করলে দেখা যাবে, মোদী জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলোতে শূন্যপদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হত রেলে। সেখানে গত ৬ বছরে ৭২ হাজার পদ তুলে দেওয়া হয়েছে। এগুলোর প্রতিবাদ তো হওয়া দরকার। বন্ধ করা দরকার।
তবে ভেবে দেখা দরকার, এরকম হিংসাত্মক প্রতিবাদের ফলে লাভ কাদের হচ্ছে? এসবের ফলে সবচেয়ে বেশি মূল্য চোকাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে। মেঘের আড়ালে থেকে কারা কলকাঠি নাড়াচ্ছে তাঁদের কিছু হয়?
![]() |
| 'অগ্নিপথ' বিরোধী আন্দোলনে রেল অবরোধ |
পুরো ব্যাপারটা ছক কাটা। ক্ষোভের লাভা বের করে দিতে হিংসাত্মক, ধ্বংসাত্মক আন্দোলন। চোখ ঘুরিয়ে দিতে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ির রাজনীতি, 'বুলডোজার বাবা' যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার-দাওয়াইয়ের মতো সাম্প্রদায়িক বিষে ঠাসা নানারকম থিম।
একটা প্রচার আছে, নব্বই দশকে চালু হওয়া উদার অর্থনীতি বা বাজার অর্থনীতির হাত ধরে দেশের অর্থনীতির হু হু করে উন্নতি হচ্ছে। আমরা দুনিয়ার বড় শক্তি হলাম বলে! নীচের তালিকাটায় চোখ রাখা যাক।
কোভিড মহামারি পর্বে ভারতে ধনকুবেরের সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪২। ২০২১ সালের মে মাসের রিপোর্ট বলছে, প্রথম ১০-১১ মাসেই ২৩ কোটি ভারতীয় কাজ হারিয়েছেন। (Wealth inequality in India during pandemic)
দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১-৮১ একদম ওপরের ১% মানুষের হাতে সম্পদের মোটামুটি ১২% ছিল। '৯১-তে বেড়ে হয় ১৬.১%। তারপর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২০ সালে ৪২.৫% সম্পদই তাঁদের হাতে।

১৯৬১-৯১ ওপরের ১০% মানুষের হাতে সম্পদের ৪৩ থেকে ৫০% ছিল। বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৪.৩%।
নীচের ৫০% মানুষের হাতে সম্পদ কমতে কমতে এখন মাত্র ২.৮%।
মাঝের ৪০% মানুষের সম্পদ ৪৪.৫% থেকে কমে হয়েছে ২২.৯%।
অর্থাৎ গরীবি বাড়ছে। মধ্যবিত্তও ক্রমশ গরীব হচ্ছে। অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত অংশও কমছে। ভক্তরা খেপে যাবেন, কিন্তু তথ্য যে দেখাচ্ছে মোদী জমানায় এই বৈষম্য বেড়েছে আরও দ্রুত গতিতে। (Wealth inequality in India)
![]() |
| দুই ভারত |
মুকেশ অম্বানি (Mukesh Ambani) প্রতি ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা আয় করছেন। ২৪% ভারতীয় পরিবারের মাসিক আয় ছিল ৩ হাজার টাকার কম।
কোভিড পর্বে গৌতম আদানির (Goutam Adanai) মোট সম্পদ বেড়েছে ১৮০৮ শতাংশেরও বেশি, দুনিয়ার যে কোনও ধনকুবেরের চেয়ে বেশি (শ্রীলংকার এক আমলা কী বলেছেন মনে আছেন নিশ্চয়ই)। মুকেশ আম্বানির বেড়েছে ১৮০৮ শতাংশ। উল্টো দিকে ৮৪% ভারতীয়ের আয় কমেছে।
কোভিড পর্বে ধনকুবেরদের সম্পত্তি বেড়েছে ৩৯%। আর নতুন করে চরম দারিদ্রের মধ্যে চলে গিয়েছেন সাড়ে ৪ কোটির বেশি ভারতীয়, সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ।

![]() |
| মোদী-আদানি (উপরে) ও আম্বানি (নিচে) |
দেখা যাচ্ছে বৈষম্য বাড়ছে, দারিদ্র বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। সব মিলিয়ে জীবনে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এবং কোনও সমাধানের রাস্তা নেই। এই পরিস্থিতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে, বিশেষত দরিদ্র, কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর, কমবয়সীদের মধ্যে। একটা হিংস্র মনোভাব তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
![]() |
| প্রস্তাবিত নতুন সংসদ ভবন |
অতি সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন (Raghuram Rajan) ‘প্রো মার্কেট’ নামে একটি সংবাদসংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'বেকারত্বই দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ। বেকারত্বের হার বেশি থাকলে, নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য আরও বৈষম্য ও বিভাজন তৈরি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগান ‘উদ্যমী’ রাজনীতিবিদরা। তাঁরা বিভাজনের রাজনীতি করেন। তাঁরা হয়তো সেই কারণেই বলেন, ‘আসুন আমরা সেই সব প্রাচীন হিন্দু মন্দিরগুলি পুনরুদ্ধারে মন দিই যেখানে এখন মসজিদ আছে’। এটা তাঁরা করেন কাজের সুযোগ তৈরির দিকটি এড়িয়ে যেতেই।'
এমন একটা পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে, যেন মুসলিমরা দেশের শত্রু, এ দেশে থাকতে হলে তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। মুসলিমদের খাওয়া-পোশাক-ধর্মীয় স্থান-দেশপ্রেম-সব কিছুতেই প্রশ্ন তুলে দেওয়া হচ্ছে।
![]() |
| রাম মন্দিরের ভিত পুজোয় যোগী, মোদী, ভাগবত |
CAA-র বিষয়টা দেখা যাক। অন্য যে কোনও ধর্মের মানুষ এলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হল। বাদ শুধু মুসলিমরা। কেন?
![]() |
| দাঙ্গায় বিধ্বস্ত দিল্লি |
এসবের পরে মুসলিমদের মনে নিরাপত্তাহীনতা বোধ বাড়লে, দেশ সম্পর্কে অনাস্থা তৈরি হলে, সেটা 'দেশদ্রোহিতা'? নানা মিথ্যা-বিকৃত-অর্ধ সত্য ছড়িয়ে সেই ধারণা তৈরির কাজ চলছে সংগঠিত ভাবে। লেখাপড়া শেখা শহুরে মধ্যবিত্তের একটা অংশ পরম উৎসাহে সেই প্রচার চালাচ্ছেন। খাল কেটে যে কুমির আনছেন, সেটাও মাথায় ঢুকছে না।
পাল্টা আছে মুসলিম মৌলবাদী শক্তি। পাল্টা সাম্প্রদায়িক ইন্ধন ছড়াচ্ছে তারাও। দেশবিরোধী কাজ, জঙ্গি কাজকর্মেও মদত দিচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে খাগড়াগড়ের কথাই ধরা যাক)। সেই মনোভাব তৈরি করার চেষ্টাও চলছে অবিরত। তাই কখনও পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান ওঠে, কখনও তালিবানরা ক্ষমতায় আসায় উৎসব করেন কিছু মুসলিম। তাকেই বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজে লাগান হিন্দু মৌলবাদীরা।
'অগ্নিপথ'-বিরোধী আন্দোলনেও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও কি বুলডোজার চালাবেন যোগী আদিত্যনাথ? না। কারণ তাঁর ছকটা হিংসা-বিদ্বেষ বাড়ানো। অস্থিরতা-অবিশ্বাস আরও বাড়ানোর বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। চরম অস্থির সময়ে আই-আদালত-গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি সম্পর্কে জনমানসে অনাস্থা তৈরি হয়ে যায়। শর্টকাট রাস্তার খোঁজ চলে। সেই ফাঁদ পাততেই যোগীর বুলডোজার-নীতি, এনকাউন্টার-নীতি (এই নীতি মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় গুজরাতেও চালু ছিল)।
![]() |
| CAA বিরোধী আন্দোলনে ট্রেনে আগুন মুর্শিদাবাদে |
![]() |
| যোগী ও মোদী |
সেই ফাঁদে আমার সহকর্মী উজ্জলের মতো অ-সাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক মনোভাবের মানুষও পা দিয়ে ফেলেন।
নূপুরের মন্তব্য বা অগ্নিপথ বিরোধী আন্দোলনে যাঁরা হিংসাত্মক রাস্তায় হাঁটছে, তাঁদের কাছে দাবি আদায়ের রাস্তা সম্পর্কে বড় উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছে কৃষক আন্দোলনের সাফল্য। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় ট্রেন-বাস জ্বালিয়ে, রাস্তা আটকে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলে লাভ হয় না। বরং ধৈর্য ধরে, শান্তিপূর্ণ রাস্তায় হাঁটতে পারলেই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। সরকারের ঘুম ছুটিয়ে দেওয়া যায়। যেটা দিল্লির CAA-বিরোধী আন্দোলনও দেখিয়েছিল।
![]() |
| দিল্লির কৃষক আন্দোলন |










