গত বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে কোনও 'বাম' দল একটি আসনও পায়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার। সমাজবিজ্ঞান বলে, যে কোনও সুস্থ সমাজে বামপন্থার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বামপন্থার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক চিন্তার, শুধু বামপন্থীদের কাছে নয়, যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছেই। সে কারণ খোঁজার চেষ্টাই করেছি এই লেখায়। পর্ব ১৪
 |
| ২০২১ বিধানভোটের প্রচারে মমতা ব্যানার্জি |
কোনও না কোনও দল ভোটে হারবেই। সেটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। কিন্তু বিলকুল উবে যায়? ২৪ বছর ৪ মাস সরকার চালানো পবন চামলিংয়ের সিকিম ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট তো ভ্যানিশ হয়ে যায়নি। এখানে হল। কারণ গোলমালটা রাজনীতিতে, গোলমালটা মাথায়। ঘৃনার ধাক্কাটা হল ভয়ংকর। মাত্র ১০ বছরে সিপিএম ২৩৫ থেকে ০। প্রায় ৬০% থেকে ভোট কমে ৫%!
বিধানসভা ভোটে মহাবিপর্যয়ের পরে অমর্ত্য সেন বললেন, 'তাঁদের চিন্তায় একটু ঔদার্যের প্রয়োজন ছিল, চিন্তা করবার দরকার ছিল যে, এদের-বিজেপি-বিরোধী বাম ও অ-বাম পার্টিগুলোর-সঙ্গে আমাদের মতবিরোধটা কোথায়। নিশ্চয়ই বিরোধ আছে কিছু, নইলে আমরা বামপন্থী কেন আর ওরা বামপন্থী নয় কেন। কিন্তু সেই বিরোধ সত্ত্বেও আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রাধান্য দিয়ে কতটা হাত মেলাতে পারি।...ঔদার্য এবং কার্পণ্য নিয়েও একটা বড় রকম আলোচনা দরকার।... এখনও আমরা যদি চিন্তার কোনও পরিবর্তন না দেখি, যদি এমন হয় যে এক নেতার জায়গায় আর এক নেতা এলেন, কিন্তু চিন্তাভাবনা একই থেকে গেল, তা হলে বামপন্থীদের খুব উন্নতি হবে, সেটা মনে করা কঠিন।'
 |
| মহম্মদ সেলিম, সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু |
২০১১ সালে এসএফআই-এর সভায় অশোক মিত্র বলেছিলেন, 'নিজেকে চেনো। আত্মসমীক্ষা করো। যে বাংলায় মানুষের ভোটে আমরা অনন্তকাল জিতব বলে ভাবতাম, তাদের কাছেই কুপোকাৎ হয়ে গেলাম!' বামপন্থীরা যা-ই করুন, তাঁরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মত ভোটে জিতবেন, এই মানসিকতা মারাত্মক অপরাধ হয়েছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে জমিদারি মানসিকতায় গণতন্ত্র খসে যায়। রয়ে যায় কেন্দ্রিকতা। সেটাই হয়েছিল। ২৯ বছর পরপর সব ভোটে জেতার পরে ২০০৬ থেকে ২০০৮ দু'বছরের মধ্যে এমন কী হল যে মানুষ বামপন্থীদের বন্ধু ভাবতে পারল না, তা-ও ভেবে দেখো।' তাঁর মতে, সিপিএমের কিছু নেতা নিজেদের 'সর্বজ্ঞ' ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন। তাঁরা 'মাতব্বরি' পছন্দ করতেন। সঙ্গে জুটেছিল খোসামুদে আর সুযোগসন্ধানী অসাধু ব্যক্তিরা। এই মাতব্বর লোকেরা খোসামুদে পছন্দ করেন।'
কিন্তু কে শোনে কার কথা? কে চিনতে চাইছেন নিজেকে? আমরা সব ঠিকই করেছিলাম, মানুষ ভুল করেছেন-সিপিএমের রাজ্য নেতারা আজও এই চিন্তা থেকে নিজেরাও বেরোননি, দলকেও বেরোতে দেননি।
 |
| সীতারাম ইয়েচুরি ও বৃন্দা কারাত |
ডঃ অশোক মিত্র বলেছিলেন, 'পার্টির এ-রকম দুর্দশা হল, তার একটা বড় কারণ, পার্টির সঙ্গে, বিশেষ করে এই রাজ্যের পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কারণ আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, ভারতীয় সংবিধান যা-ই বলুক, পশ্চিমবঙ্গের শাসন থেকে আমাদের কেউ বিচ্যুত করতে পারবে না, বিপ্লব হোক বা না হোক, এখানে আমরা একতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেছি, সুতরাং বাইরের কারও কথা শোনবার আমাদের দরকার নেই।
(চলবে)